গত মাসে সংঘটিত দেশের কয়েকটি ঘটনা মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বেশ আলোচিত হয়েছে। ঘটনাগুলো নিয়ে পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সংবাদ পরিবেশন, বিশ্লেষণ ও ফলোআপের ধরন গণমাধ্যমের একচোখা নীতিকে আবারও দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে তুলল। চোখে আঙুল দিয়ে আরও একবার দেখিয়ে দিয়ে গেল যে, নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণ ও তত্ত্ব-তালাশ ব্যতিরেকে গণমাধ্যমের কোনো খবর গ্রহণ করা উচিত নয়।
লতা সমাদ্দার নাম্নী টিপপরা জনৈকা মহিলার সঙ্গে একজন পুলিশ সদস্যের বাদানুবাদ হয়। ঘটনাচক্রে সেই পুলিশ সদস্যটি ছিলেন শ্মশ্রুমণ্ডিত। মহিলা এই সুযোগটি গ্রহণ করলেন। বাসায় ফিরে তিনি নিজের পরিচিত মহলে অভিযোগ তুললেন—নিতান্ত টিপ পরার কারণে তাঁকে দাড়িওয়ালা এক পুলিশ সদস্য অপমান করেছে! তারপর চটকদার শিরোনাম দিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে একের পর এক সংবাদ পরিবেশিত হতে লাগল। বাংলাদেশে নারীদের স্বাধীনতা হরণ, নারীঅধিকারের অবনতি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, মৌলবাদের জয়জয়কার ইত্যাদি নানা বিষয়ে টকশোর টেবিল গরম করে তুললেন কথিত বুদ্ধিজীবীরা। নারীবাদের এহেন ‘অপমানে’ নারীবাদী অনেক পুরুষ অ্যাক্টিভিস্ট প্রতিবাদ-স্বরূপ নিজেদের কপালে টিপ সাঁটালেন, লতা সমাদ্দারের কাছে তামাম পুরুষকুলের তরফে ক্ষমা চাইলেন এবং লজ্জিত হলেন। ফলে স্থানীয় প্রশাসন ২৪ ঘণ্টার ভেতরে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই পুলিশ সদস্যকে সনাক্ত করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে শোকজ করা হয়। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল ঘটনা আসলে কিছুই না। ওই পুলিশ সদস্যের সঙ্গে রাস্তায় লতা সমাদ্দারের কী একটা বিষয় নিয়ে অতি সাধারণ একটি বাদানুবাদ হয়। সেখানে পুলিশ সদস্য কর্তৃক টিপ, পোষাক বা ধর্ম নিয়ে মহিলাকে কোনো কট‚ কথা বলার বা ব্যক্তিআক্রমণের প্রমাণ পায়নি তদন্ত কমিটি।
একটি হাওয়াই অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে টিপ পরার অধিকার নিয়ে যখন মূলধারার সবগুলো গণমাধ্যম সোচ্চার, তখন নওগাঁর একটি স্কুলে কিছু ছাত্রী প্রতিবাদে নেমেছিল তাদের হিজাব পরার অধিকার নিয়ে। তাদের অভিযোগ—স্কুলে হিজাব পরে আসার কারণে তাদের এক হিন্দু শিক্ষিকা তাদেরকে প্রহার করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সেই প্রতিবাদের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লেও মূলধারারার গণমাধ্যমগুলো ছিল এ ব্যাপারে একদমই চুপ। ছাত্রীদের অভিযোগ তারা আমলেই নেয়নি। পরে, ওই হিন্দু শিক্ষিকা যখন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ক্যামেরার সামনে এলেন, তাঁকে সহায়তা করার জন্য যা যা লাগে, গণমাধ্যমগুলো এর সব আয়োজনই করে।
একই ধরনের দ্বিচারিতা দেখা গেছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের নারী-কেলেঙ্কারির ব্যাপারে। ছাত্রীদেরকে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের একাধিক ঘটনা প্রমাণিত হবার দায়ে বিশ্বজিৎ ঘোষ নামক ওই অধ্যাপককে গত মাসে বিশ^বিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত হবার পরও গণমাধ্যমগুলো খুবই নীরিহ ভাষা ও আবহে খবরটি প্রকাশ করে। এমনকি অব্যাহতিপ্রাপ্ত ওই অধ্যাপকের ছবিটি পর্যন্ত প্রথমে প্রকাশ করেনি কোনো গণমাধ্যম। কিন্তু আমরা দেখে এসেছি দেশের বহুল সমাদৃত একজন আলেমে দ্বীনের অপবাদের একটি ঘটনাকে মিডিয়া কীভাবে রঙচঙ মাখিয়েছিল! ঘটনাটি গতবছরের, সকলের স্মৃতিতে নিশ্চয় দগদগে হয়ে আছে এখনো। অপবাদ ওঠানোর পর ওই আলেমের অপ্রস্তুত অবস্থায় তোলা যত ধরনের ছবি আছে, সেসব ছবি দিয়ে একের পর এক চটকদার সংবাদ পরিবেশিত হতে থাকে। টকশোগুলো গরম করে তোলা হয় নৈতিকতার সবক দিয়ে। অথচ অব্যাহতিপ্রাপ্ত চরিত্রহীন এই অধ্যাপকের বেলায় কী দেখা গেল? টকশোতে আলাপ তো দূরে থাক, সংবাদমাধ্যমগুলো যেন এ বিষয়ক নিউজটি করতেও লজ্জাবোধ করছে।
এই হলো মিডিয়া। এই হলো মিডিয়ার রঙবাজি ও কারসাজি। অতএব, গণমাধ্যমে পরিবেশিত সংবাদ ও বিশ্লেষণগুলো নিয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কোনো সংবাদই আমরা হুট করে বিশ্বাস করব না। একটু চোখ-কান খুলব, খোঁজ-খবর নেব, তারপর নিজের বিচার-বিশ্লেষণকে কাজে লাগিয়ে দেখব পরিবেশিত সংবাদের সত্যতা আসলে কতটুকু। এতটুকু সুযোগ ও সময় যদি আপনার থাকে, তাহলে গণমাধ্যমের খবরগুলো আপনি পড়ুন, দেখুন, শুনুন। আর এ সুযোগ ও সময় যদি না থাকে, তাহলে গণমাধ্যমের চটকদার সংবাদ ও বিশ্লেষণগুলো আপনার জন্য এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। কেন?
সূরা আহযাবের ৬ নম্বর আয়াতে আছে এর উত্তর। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, যদি তোমাদের নিকট কোনো ফাসিক/পাপাচারী লোক কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখো; যাতে কোনো কওমকে অজ্ঞতাবশত তোমরা আক্রমণ করে না বসো, ফলে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য পরে অনুতাপ করবে।’
—হামমাদ রাগিব