সংগ্রহ করতে কল করুন-
সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর
প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫
ঘটনা মে মাসের ১৮ তারিখের। আপনাদের মনে থাকার কথা। নরসিংদী রেলস্টেশনে স্বল্পবসনা এক তরুণীকে হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছিল। তরুণীটি তার কয়েক ছেলেবন্ধুকে নিয়ে শেষ রাতের ট্রেনে ঘুরতে এসেছিল ঢাকা থেকে। তার পরনে কাপড়ের পরিমাণ এতই স্বল্প ছিল যে, ন্যূনতম সভ্যতা জ্ঞান যাদের আছে তারাও ইতস্ততা বোধ করবে। সকালে রেলস্টেশনে এমন পোষাক পরে হাঁটাচলা করায় স্থানীয় এক নারী তাকে বোঝান যে, জনপরিসরে এ ধরনের পোষাক মাননসই নয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, তরুণীটি তখন ওই নারীকে অপমান করার চেষ্টা করে। তাকে সঙ্গ দেয় সাথে থাকা তার ছেলেবন্ধুগুলোও। ফলে, নারীর পক্ষ নিয়ে স্থানীয় কিছু লোক তাদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়ায়। সেই বাদানুবাদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলো ‘নারী স্বাধীনতা’র বোল আওড়িয়ে মেয়েটিকে হেনস্তা করা হয়েছে বলে শোর তোলে। একে ইস্যু বানিয়ে গরম করা হয় টকশোর টেবিল। টানা কয়েক দিন চলে নারীবাদীদের প্রতিবাদ। তাঁরা একই ধরনের স্বল্পবসনা হয়ে দলবদ্ধভাবে নরসিংদী রেলস্টেশনে গিয়ে ছবি তোলেন। এর জেরে স্থানীয় সেই নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিন মাস পর আগস্টের ১৭ তারিখে সেই নারীর জামিন মঞ্জুর করেন উচ্চ আদালত। পাশাপাশি ওই ঘটনায় তরুণীর পোষাক নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আদালত। তরুণী যে ধরনের পোশাক পরেছিল তা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই কি নাÑ এ প্রশ্ন তুলে আদালত বলেন, ‘আমাদের দেশের কৃষ্টি-কালচার অনুযায়ী গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার কোনো অনুষ্ঠানেও এ ধরনের পোশাক দৃষ্টিকটূ।’
তরুণীকে হেনস্তার প্রতিবাদ করতে ঢাকা থেকে নরসিংদী যাওয়া ব্যক্তিদের পোশাক নিয়েও প্রশ্ন তোলেন হাইকোর্ট।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘জামিন আবেদনকারী আইনজীবীর শুনানি অনুযায়ী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী নরসিংদী রেলস্টেশনে স্বল্প পোশাক পরিহিত এক তরুণীকে সতর্ক করেছিলেন। কারণ, ওই তরুণীর পোশাক দেশের কৃষ্টি-কালচার, সামাজিক রীতিনীতি ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়নি তাঁর।’
সভ্য দেশের আদালত হিসেবে হাইকোর্টের এ পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত যৌক্তিক এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু যে মিডিয়া এত হৈচৈ করেছিল এ ঘটনায়, আদালতের পর্যবেক্ষণের পর এখন তারা নীরব!
মিডিয়া হচ্ছে সমাজ ও সভ্যতার মুখপত্র। বাংলাদেশের সভ্যতা ও কালচার এখনো যথেষ্ট উন্নত এবং শালীন। তরুণীটি ছেলেবন্ধুদের নিয়ে শেষ রাতের ট্রেনে অপরিচিত এলাকায় ঘুরতে যাওয়ার কী কারণ, এত স্বল্পবসনে পাবলিক পরিসরে সে কেন ঘুরে বেড়ায়, ঘটনার পর মিডিয়ার কর্তব্য ছিল সেই প্রশ্ন তোলা। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো। মিডিয়া তরুণীটির পক্ষ নিয়ে অসভ্যতা ও বেহায়ামির বৈধতা তৈরির চেষ্টা চালায় ।
স্থানীয়দের ভাষ্য—নরসিংদী রেলস্টেশনের আশপাশে আগে অনেক বস্তি ছিল। পুরো নরসিংদীর মাদক এবং বেশ্যাবৃত্তির প্রাণকেন্দ্র ছিল সেগুলো। এমনকি রেলস্টেশনে মালবাহী কিংবা যাত্রীবাহী রেলের যেসব পরিত্যাক্ত বগি থাকত, সেগুলোও অঘোষিতভাবে পতিতালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
নরসিংদীর সাবেক মেয়র লোকমান হোসেনের সময়কালে তিনি রেলস্টেশন বস্তিসহ নরসিংদীর আরও যতগুলো বস্তিতে অঘোষিত পতিতালয় ছিল সেগুলো উচ্ছেদ করে দেন।
তারপর থেকে রেলস্টেশনের অঘোষিত পতিতালয়গুলো শিফট করেছে আশপাশের আবাসিক হোটেলে। স্থানীয়রা জানান, এখানকার হোটেলগুলো সাধারণভাবে ‘থাকার’ উপযুক্ত নয়। কারণ, এগুলো ডিজাইনই করা হয়েছে অবৈধ কাজে ব্যবহারের জন্য। নরসিংদীর স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। আর স্থানীয় বাসিন্দারা বিষয়টি জানেন বলেই ওই মেয়ের অসভ্যতায় সেদিন তাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন। বিপরীতে দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলো এই নোংরামিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সম্মিলিতভাবে উঠে-পড়ে লেগেছিল। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অ্যাক্টিভিটি শক্তিশালী থাকায়, মিডিয়ার এই বয়ান জনপরিসরে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ, বাস্তবতা ছিল সবার কাছে পরিষ্কার। ১৭ আগস্ট এ ঘটনায় উচ্চ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য সেই বাস্তবতাকে আরও পরিষ্কার করে দিল। আর এর মধ্য দিয়ে আরও একবার স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, মূলধারার অধিকাংশ মিডিয়া ও সেগুলোর কর্ণধাররা এ দেশের গণমানুষের রুচিবোধ ও জীবনাচারের প্রতিনিধিত্ব করে না, তারা এমন এক সভ্যতা এখানে আমদানি করতে চায় যা এ মাটির হাজার বছরের সভ্যতা সংস্কৃতি ও জীবনাচারের সম্পূর্ণ বিপরীত। সভ্য সমাজ যা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।
—হামমাদ রাগিব
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে কুরবানীর পশুর চামড়া নিয়ে চলছে তেলেসমাতি কাণ্ড। কাঁচা চামড়া বিপণন ও সংরক্ষণে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিশৃঙ্খলা ও অনিয়মের মাধ্যমে দেশীয় বাজারে পরিকল্পিতভাবে দরপতন ঘটানো হয়েছে সম্ভাবনাময় এ পণ্যটির। কুরবানীর ঈদ পণ্যটি সংগ্রহের উৎকৃষ্ট সিজন। কুরবানীর পশুর চামড়া থেকে যে অর্থমূল্য পান কুরবানীদাতারা, তা বণ্টিত হয় সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে। বিশেষত, দেশের কওমী ধারার মাদরাসাগুলো চামড়া সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়। এই সিজনে কাঁচা চামড়া বিক্রি করে মাদরাসার গরিব ও এতিম ছাত্রদের বড় একটি ব্যয় সংকুলান করা হয়। কিন্তু বিগত পাঁচ-সাত বছর ধরে চামড়ার দাম পড়তি থাকায় যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাদরাসাগুলোর গরিব ফান্ডের এই আয়ের খাতটি, তেমনি বঞ্চিত হচ্ছেন দরিদ্র শ্রেণির নাগরিকেরা। এমন না যে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কম, কিংবা দেশীয় চামড়ার গুণগত মানে ঘাটতি আছে। বরং গুণগত মানের বিচারে ফরাসিদের ‘ফ্রেঞ্চ কাফের’ পর আমাদের দেশের চামড়াই দুনিয়া-সেরা। এ রকম স্মোথ গ্রেইনের চামড়া বিশ্বের আর কোথাও মেলে না।
গত এক দশকে সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে চামড়াজাত পণ্য রফতানির পরিমাণ ও বাজার। আমাদের দেশের চামড়া দিয়ে বিশ্বমানের হুগো বসের মতো প্রতিষ্ঠান জুতা তৈরি করে বিশ্ববাজারে বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানটির তৈরি এক জোড়া জুতা বাংলাদেশের অর্থমানে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। ইউরোপের সবচেয়ে বড় জুতা বিক্রেতা ডাচম্যানের প্রায় চার হাজার শোরুমে বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত চামড়াজাত জুতা বিক্রি হয়। এ ছাড়া আমেরিকা, ইউরোপ জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালি, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম রাশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াতেও বাংলাদেশের চামড়ার জুতার বাজার রয়েছে। এশিয়ার জাপানেও খুব পছন্দ বাংলাদেশি জুতা।
ধারণা করা হয়, গার্মেন্টস শিল্পের পর চামড়া শিল্পই এখন দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের অতি সম্ভাবনাময় খাত। দেশে ১১০টিরও অধিক রফতানিমুখী কারখানায় চামড়ার জুতা তৈরি হয়। এর মধ্যে এপেক্স, এফবি, পিকার্ড বাংলাদেশ, জেনিস, আকিজ, আরএমএম, বেঙ্গল এবং বে’র রয়েছে নিজস্ব ট্যানারি ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এর বাইরে শুধু চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে এমন কারখানার সংখ্যা ২০৭টি। এরপরও কাঁচা চামড়া অবহেলিত। কুরবানির সিজন এলে দাম না পেয়ে নদীতে ভাসাতে হয় চামড়া, অথবা মাটিতে পুঁতে ফেলেন অনেকে।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি পশু কুরবানী হয়। কুরবানীকৃত এ পশুগুলোর কাঁচা চামড়ার ন্যায্য মূল্য না থাকার কারণে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অন্তত ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। বিপরীতে কম দামে চামড়া কিনতে পারায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত লাভ হাতিয়ে নিচ্ছেন আড়তদার, ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকেরা।
চামড়া বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত মুনাফাখোররা জানে, ন্যায্য মূল্য না পেয়ে বা প্রতিবাদী হয়ে কুরবানীর পশুর চামড়া নদীতে ভাসানো কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলার হার খুব কম, যে চামড়ার স্বাভাবিক মূল্য অন্তত হাজার টাকা, গরিবদের কথা চিন্তা করে কুরবানিদাতারা দাম না পেলে তা ১০০ টাকায়ও বিক্রি করতে রাজি থাকবেন। এই সুযোগটি তারা কাজে লাগাচ্ছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কোটি কোটি টাকা তারা অসদুপায়ে নিজেদের পকেটে ভরছে। টাইম লাইন বিবেচনা করলে দেখা যাবে, গত প্রায় ১ দশক ধরে চামড়ার বাজারে এই দুর্বৃত্তায়ন চলছে। কিন্তু কেন যেন বাস্তবিক অর্থে কার্যকর ও প্রভাবশীল কোনো উদ্যোগ সরকারের তরফে পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও বিক্রয়ের সঙ্গে যেহেতু কওমী মাদরাসাগুলো সম্পৃক্ত, তাই মাদরাসাগুলোকে সম্মিলিতভাবে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। সিন্ডিকেটের কাছে এভাবে জিম্মি হয়ে না থেকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। কুরবানীর পশুর চামড়ার সঙ্গে গরিব মানুষের অধিকার সম্পৃক্ত। পাশাপাশি মাদরাসার গরিব ফান্ডের বড় একটি ব্যয়ও নির্বাহ হয় এর মাধ্যমে। সুতরাং বছর বছর এভাবে বঞ্চনার শিকার না হয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে চামড়া কীভাবে ব্যবহার করা যায়, কাঁচা চামড়াকে খাওয়ার উপযোগী করা যায় কি না, কিংবা ট্যানারি-মালিকদের এড়িয়ে সংগৃহীত চামড়া অন্য কোনোভাবে প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবসায়িক কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় কি না, উলামায়ে কেরাম ও কওমী মাদরাসা অথরিটিকে এসব বিষয়ে সিরিয়াস চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।
—হামমাদ রাগিব
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র নুপুর শর্মার কুরুচিপূর্ণ এক মন্তব্যের জেরে বিগত মাসটিতে পুরো মুসলিম বিশ^ উত্তাল ছিল। নবীজিকে কট‚ক্তির বিরুদ্ধে এবারের প্রতিবাদ নিকট-অতীতের সকল প্রতিবাদকে ছাড়িয়ে গেছে। এবারের প্রতিবাদে ঘুমন্ত আরব বিশ^ সবার আগে জেগে উঠেছে। কুয়েত, কাতার ও ইরান তাদের দেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে এবং অফিশিয়ালি রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদী স্মারকলিপি প্রদান করেছে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ও তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েঠে। ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান শক্ত প্রতিবাদ জানিয়ে দাবি করেছে যেন এ ধরনের অপরাধীকে ক্ষমা না করা হয়। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ ও সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন। ওআইসিও প্রতিবাদ জানায়। এভাবে ১৫টিরও বেশি মুসলিম দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় এবং পৃথিবীর সকল প্রান্তের মুসলমানরা দলমত নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে টানা কয়েক সপ্তাহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। আরব বিশে^র বাজার ও সুপারশপগুলো থেকে ভারতীয় পণ্য সরিয়ে ফেলা হয়। ইত্যকার প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ায় ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকার তুমুল চাপের মুখে পড়ে। বিশেষ করে আরব বিশে^র বিরূপ প্রতিক্রিয়া ভারতীয় অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি। নিরূপায় ভারত ক‚টনৈতিক নমনীয়তার মাধ্যমে বিষয়টি নিরসনে বাধ্য হয়। তাদের জানবাজ ও উৎসর্গপ্রাণ উঠতি নেত্রী নুপুর শর্মাকে দল থেকে বের করে দেয়। এবং এ বক্তব্য বিজেপি বা সরকারের তরফে নয়, তা বিবৃতি দিয়ে বারবার প্রচার করে।
বর্তমান প্রেক্ষিতে এই ঘটনা অনেক তাৎপর্য। পৃথিবীর দিকে দিকে মুসলমানরা যখন নির্যাতিত ও কোণঠাসা, বিশেষ করে ভারতে, এমতাবস্থায় নবীজির অপমানের ঘটনায় আরব বিশে^র জেগে ওঠা, সঙ্গে পুরো মুসলিম বিশে^র প্রতিবাদমুখরতা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের নমনীয়তা অবলম্বন এটাই প্রমাণ করে যে, মুসলিম বিশ^ যদি এখনো শুধু মৌখিক ও ক‚টনৈতিকভাবেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, তাহলে মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অমুসলিম কোনো দেশ বা গোষ্ঠী টু-শব্দটি করারও সাহস পাবে না, ইনশাআল্লাহ।
২.
সিলেট ও সুনামগঞ্জে মে মাসের বন্যার ধকল কাটতে না কাটতে জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে আরও ভয়াবহ আকারে প্লাবিত করে ফেলল পুরো অঞ্চলটি। দ্বিতীয় বারের এ বন্যায় বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। এবার কেবল সুনামগঞ্জ ও সিলেট নয়, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বিরাট এলাকাও প্লাবিত করেছে। প্লাবিত করেছে সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোণাও। কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের বন্যাপরিস্থিতিও ভয়াবহ। বানভাসি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত নেই। বন্যার তোড়ে ভেসে গেছে অসংখ্য মানুষের বাড়িঘর, ভেসে গেছে তাদের গবাদি পশু ও মজুদ খাদ্যদ্রব্য। অসংখ্য মানুষ শুধু প্রাণটুকু নিয়ে আশ্রিত হয়েছেন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে। সম্পাদকীয়টি যখন লিখছি, এখনও অসংখ্য মানুষ পানিবন্দী। অসংখ্য এলাকা এখনও পানির নিচে।
বানভাসি এসব ক্ষতিগ্রস্ত ও অসহায় মানুষের পাশে বরাবরের মতো এবারও আলেম সমাজ দাঁড়িয়েছেন। এবারের ক্ষতির পরিমাণ বেশি হওয়ায় সাহায্যের পরিমাণও বেশি। তবে তা মানুষের ক্ষতির পরিমাণের তুলনায় কিছুই না। কিন্তু তারপরও তাঁদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে এবং বন্যার তোড় থেকে তাঁদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসতে এ দেশের আপামর জনসাধারণ, বিশেষত উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও নিজস্ব উদ্যোগে ভালোবাসা ও মানবতার যে নজির স্থাপন করেছেন তা তুমুল প্রশংসনীয় এবং আশাজাগানিয়া। বন্যার্ত মানুষের উদ্ধার ও সহযোগিতায় সেকুলার ও সাধারণ নাগরিকদের একটি অংশ কাজ করছেন ঠিক, কিন্তু উলামায়ে কেরামের অংশগ্রহণটা সবচেয়ে বেশি, কার্যকরী এবং তৎপরতাপূর্ণ। কোটি কোটি টাকার ত্রাণ সামগ্রী তাঁরা বিতরণ করেছেন, এখনও করছেন। বন্যার্ত মানুষের পুনর্বাসনের কাজও ইতিমধ্যে তাঁরা শুরু করে দিয়েছেন। পুনর্বাসনের কাজে ত্রাণের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি আর্থিক অনুদানের প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই তাঁরা নিয়ে ফেলেছেন। আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশও আছে এই মহৎ কাজে। কেন্দ্রীয় ও শাখাপর্যায়ে বিভিন্নভাবে বন্যাদুর্গতদের সহায়তা করা হয়েছে। সেই ধারা এখনও অব্যাহত আছে, আলহামদুলিল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা বানভাসি মানুষের দুঃখদুর্দশাগুলো দূর করে দিন। বন্যায় তাঁদের যে ক্ষতি হয়েছে তার উত্তম বদলা দান করুন। বন্যার্ত মানুষের সেবায় যাঁরা যেভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন প্রত্যেককে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।
—হামমাদ রাগিব
সিলেটে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যাটি হয়ে গেল গত মাসে। দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের ঐতিহ্যমÐিত এই অঞ্চলকে অনেকটা সুতোর মতো পেঁচিয়ে রেখেছে ভারতের করিমগঞ্জ ও মেঘালয়। ভারতের বরাক নদ আসামের করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশিদ এলাকায় সুরমা ও কুশিয়ারা নামে ভাগ হয়েছে। সুরমা সিলেটের কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ ও সিলেট সদর হয়ে সুনামগঞ্জে গিয়ে মিশেছে। আর কুশিয়ারা সিলেটের গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ উপজেলা হয়ে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে চলে গেছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে বৃষ্টির সিজনে নিয়ম করে বন্যা হয় সিলেটে। এ বছরের বন্যা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করল। পাউবোর তথ্যমতে অঞ্চলটির ১৫ লক্ষাধিক বাসিন্দা এ বছর বন্যার কবলে পড়ে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
সিলেটবাসীর এই কষ্ট ও দুর্ভোগের পেছনে ভারতের নদীশাসন-নৈরাজ্যের দায় তো আছেই, একই সঙ্গে দেশের পানিসম্পদ কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন এবং জনগণের অবহেলা ও অসতর্কতাও সমানভাবে দায়ী।
প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুরমা নদীর ১১০ কিলোমিটারই পড়েছে সিলেটে। গত দুই দশকে এই ১১০ কিলোমিটারের ৪০-৪৫ শতাংশ অংশে চর পড়েছে। যেখানে চর পড়েনি, সেখানে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। সুরমা এখন অনেকটাই মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ২১০ কিলোমিটার দীর্ঘ কুশিয়ারার ১২০ কিলোমিটার পড়েছে সিলেটে। এ নদীতে খুব বেশি চর না পড়লেও গভীরতা অনেকটাই কমে এসেছে। ফলে বড় এই নদী-দুটোতে দেখা দিয়েছে তীব্র নাব্যতা-সংকট। গভীরতা কমে যাওয়ায় টানা বৃষ্টিতে দুই নদীর পানি উপচে উঠে সহজেই বিপৎসীমা অতিক্রম করে ফেলে।
এ দিকে সিলেট নগরীর জলাশয় ও পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক খালগুলোর অধিকাংশ বেদখল কিংবা ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রতি বছরই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। টানা বৃষ্টিতে সুরমার পানি উপচে উঠলে শহরের নানা এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। সিলেটকে বলা হতো দিঘির শহর। ধোপাদিঘির পাড়, সাগরদিঘির পাড়, লালদিঘির পাড়সহ নগরীর অন্তত ২০/২৫টি এলাকার নাম এমন। দিঘির নামে এলাকার নাম ঠিকই আছে, কিন্তু নেই দিঘিগুলো। ভরাট হয়ে গেছে অনেক আগেই। এ ছাড়া নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছিল ছোট-বড় প্রায় ২৫টি প্রাকৃতিক খাল। যা ‘ছড়া’ নামে পরিচিত। সেগুলোও ভরাট কিংবা বেদখল হয়ে গেছে। অনেক স্থানে এসব ছড়ার অস্তিত্বই এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
অবশ্যি সিটি কর্পোরেশন ছড়াগুলো উদ্ধারে গত কয়েক বছর ধরে তৎপর ভ‚মিকা পালন করছে। তাদের দাবি ও তথ্যমতে এ অবধি ১৩টির মতো খাল তারা উদ্ধার করতে পেরেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে নগরীর জলাবদ্ধতার সমস্যা খানিকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু বন্যা-সমস্যার সমাধানের জন্য সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে পরিকল্পিত ও বড়ধরনের খননের বিকল্প নেই। দুই নদীর গতিপথ অনুযায়ী নদীশাসন নিশ্চিত করে বাস্তবসম্মত খনন-প্রকল্প অতি দ্রæত বাস্তবায়ন না করলে সিলেটবাসীকে প্রতিবছরই এ ধরনের ভয়াবহ বন্যা-বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে। আর এ বিপর্যয় প্রতি বছর বাড়বে বৈ কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এবারের বন্যায় সিলেটের বানভাসি মানুষ খুবই বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। নি¤œবিত্তরা তো বটেই, অবস্থাসম্পন্ন অনেক পরিবারও তুমুল বন্যার সময় খাদ্য ও বাসস্থানের সংকটে পড়েছিলেন। কৃষকদের চোখে এখন সর্ষেফুলের দৃশ্য! বন্যায় ডুবে গেছে তাদের ক্ষেতের ফসল। এই সংকটাপন্ন সময়ে বন্যাগ্রস্ত প্রায় সকলেরই জরুরি ত্রাণ-সহায়তার প্রয়োজন দেখা দেয়। আলহামদুলিল্লাহ, এ ক্ষেত্রে সবার আগে এবং সর্বাধিক কার্যকরী পন্থায় এগিয়ে আসেন এ দেশের উলামায়ে কেরাম। বন্যার শুরু থেকেই ব্যক্তিউদ্যোগ ও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে আলেমদের শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী টিম জরুরি ত্রাণসহায়তায় সর্বাত্মকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশ ও প্রবাসের বিত্তবান মানুষের সহায়তার ভিত্তিতে প্রতিটি টিম ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ টাকার ত্রাণ বিতরণ করেছেন। আমরা তাঁদেরকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।
বন্যা-পরবর্তী সময়ে মানুষের প্রয়োজন আরও ব্যাপক আকারে দেখা দেবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নি¤œবিত্তদের ঘর-মেরামত থেকে শুরু করে নানাবিধ সহায়তার দরকার পড়বে। আলেমদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই টিমগুলো সেই সময়ও যেন বানভাসি এসব মানুষের পাশে থাকেন, এ দাবি ও আরজিটুকু রইল তাঁদের প্রতি। আল্লাহ তাআলা তাঁদের এ মেহনতকে কবুল করুন। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট সবধরনের বিপর্যয় থেকে সিলেটসহ সারা দেশবাসীকে হেফাজত করুন। আমীন।
—হামমাদ রাগিব
প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫
প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫
কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT