وَیۡلٌ لِّلۡمُطَفِّفِیۡنَ ـ الَّذِیۡنَ اِذَا اکۡتَالُوۡا عَلَی النَّاسِ یَسۡتَوۡفُوۡنَ ـ وَ اِذَا کَالُوۡهُمۡ اَوۡ وَّزَنُوۡهُمۡ یُخۡسِرُوۡنَ ـ اَلَا یَظُنُّ اُولٰٓئِکَ اَنَّهُمۡ مَّبۡعُوۡثُوۡنَ ـ لِیَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ـ یَّوۡمَ یَقُوۡمُ النَّاسُ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
তরজমা : ধ্বংস তাদের জন্য যারা ওজনে কম দেয়। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে। আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। তারা কি দৃঢ় বিশ্বাস করে না যে, নিশ্চয় তারা পুনরুত্থিত হবে, এক মহা দিবসে? যেদিন মানুষ সৃষ্টিকুলের রবের জন্য দাঁড়াবে। (সূরা মুতাফফিফীন, আয়াত-ক্রম : ১-৬)
ভূমিকা
সূরা মুতাফফিফীনের উল্লিখিত ছয়টি আয়াতে ব্যবসায়ীদের প্রতি কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। যেসব ব্যবসায়ী স্বীয় ব্যবসায় ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, বরং যেকোনো দায়িত্বশীল স্বীয় দায়িত্বে অবহেলা করলে তা ধোঁকা ও প্রতারণার শামিল হবে।
অতঃপর ৭ থেকে ১৭ নম্বর আয়াতে পাপাচারীদের কথা বিবৃত হয়েছে। ১৮ থেকে ২৮ নম্বর আয়াতে নেককারদের কথা আলোচিত হয়েছে। আর সূরার শেষ অংশে আলোচিত হয়েছে পরিশুদ্ধকারীদের কথা, যেমনিভাবে সূরার প্রথম অংশে অসৎ লোকদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আমরা আজকে সম্মানিত এ সূরার প্রথম ছয়টি আয়াত নিয়েই আলোচনা করার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
তাফসীর
وَیۡلٌ মানে হলো ধ্বংস, কঠিন শাস্তি, দুঃখ-দুর্ভোগ ইত্যাদি। বিভিন্ন তাফসীর অনুযায়ী জাহান্নামের একটি উপত্যকাকেও وَیۡلٌ বলা হয়। এ ছাড়া, কর্মফল দিবসে ধ্বংসে নিপতিত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বলা হয়-وَیۡلَكَ আর مُطَفِّفِیۡنَ (মুতাফফিফীন) শব্দটি تَطْفِيْفٌ (তাতফীফ) শব্দমূল (মাসদার) থেকে এসেছে। যার অর্থ মাপে বা ওজনে সূক্ষ্ম কারচুপি করা। সুতরাং মুতাফফিফীন-এর অর্থ দাঁড়ায় ‘যারা মাপে বা ওজনে সূক্ষ্ম কারচুপি করে’।
পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে নবী হযরত শুআইব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় এ-জাতীয় ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা করত। এই অন্যায়ের ফলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেন। পবিত্র কুরআনের অনেকগুলো আয়াতে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যেমন সূরা বনী ইসরাঈলের ৩৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মাপে পরিপূর্ণ দাও যখন তোমরা পরিমাপ করো এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। এটা কল্যাণকর ও পরিণামে সুন্দরতম।’
সূরা আনআমের ১৫২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর পরিমাপ ও ওজন ইনসাফের সাথে পরিপূর্ণ দেবে। আমি কাউকে তার সাধ্য ছাড়া দায়িত্ব অর্পণ করি না।’
সূরা আর-রাহমানের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনি আকাশকে সমুন্নত করেছেন এবং দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করেছেন। যাতে তোমরা দাঁড়িপাল্লায় সীমালঙ্ঘন না করো। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে ওজন প্রতিষ্ঠা করো এবং ওজনকৃত বস্তু কম দিয়ো না।’
অনুরূপভাবে ঠক ধোঁকাবাজ ও প্রতারক ব্যবসায়ীদের ভয়াবহ পরিণামের কথা অনেকগুলো হাদীসে বিবৃত হয়েছে। যেমন আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে তাবারানী ও হাকীম বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা ওজনে কমবেশি করো না। কারণ, এর দ্বারা তোমাদের ফলফলাদির উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং দুর্ভিক্ষ তোমাদের গ্রাস করে নেবে।’
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘পাঁচ প্রকার গুনাহের কারণে পাঁচ ধরনের বিপদাপদ আপতিত হয়।’ এর মধ্য থেকে চতুর্থ নম্বরে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওজনে কমবেশির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ওজনে কমবেশি করো না। কেননা, এর দ্বারা তোমাদের ফলফলাদির উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং দুর্ভিক্ষ তোমাদের গ্রাস করে নেবে।’
অপর এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায় যখন ওজনে কমবেশি করে, তখন তাদের রিযিক সংকীর্ণ হয়ে পড়ে।’
তাতফীফ বা লেনদেনে কারচুপি এক জঘন্যতম অপরাধ
জঘন্যতম এ অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চূড়ান্ত পরিণামের কথা বলতে গিয়ে সূরা মুতাফফিফীনের শুরুর কয়েক আয়াতে আল্লাহ তাআলা যে বর্ণনারীতি ব্যবহার করেছেন, তা-ই প্রমাণ করে যে এসব পাপাচারীর পরিণাম কত ভয়াবহ হবে! শুরুতেই ‘ওয়াইল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে; যা কঠিন বিপদ ও দুঃখ-মুসীবত অর্থে ব্যবহৃত হয়। অতঃপর اَلَا یَظُنُّ اُولٰٓئِکَ অর্থাৎ ‘তারা কি দৃঢ় বিশ্বাস করে না…?’ এখানে প্রশ্নবোধক ও সতর্কতা বাচক অব্যয় اَلَا ব্যবহার করে আল্লাহ তাআলা এ সমস্ত পাপাচারীর কর্মকাণ্ডের নিন্দা ও তিরস্কার প্রকাশ করেছেন।
তাতফীফ বা লেনদেনে কারচুপির পরকালীন শাস্তি
ইমাম বাগাভী রহ. সূত্রে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এক বিক্রেতার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে সম্বোধন করে বলেন, ‘লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আল্লাহ তাআলাকে যথাযথভাবে ভয় করো। আর পাওনাদারকে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দাও। কারণ, ওই সমস্ত পাপী যারা পাওনাদারের পাওনা আদায় করতে গিয়ে ধেঁাকা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়, তারা কিয়ামাতের দিন নিজেদের এ জঘন্য অপরাধের দরুণ ঘর্মাক্ত হয়ে ঘামে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হবে।’
ইমাম ফুযাইল রহ. বলেন, ‘যারা মাপে বা ওজনে কম দেয়, কিয়ামাতের দিন তাদের চেহারা কুৎসিত কালো বর্ণে পরিণত হবে।’
হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক খর্ব করা তাতফীফের অন্তর্ভুক্ত
আল্লামা আবুল কাসিম আল-কুশাইরী রহ. বলেন, ‘তাতফীফ শব্দটি যেভাবে মাপে বা ওজনে কারচুপি করার অর্থে ব্যবহৃত হয়, ঠিক তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও যতধরনের ধোঁকাবাজি রয়েছে, সেসব অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন : প্রতারণার উদ্দেশ্যে ক্রেতার কাছে পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা।’
শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এ পাপের পরিধি বরং সামাজিক জীবনের প্রতিটি ধাপেই বিস্তৃত। বিনা কারণে অন্যের দোষ তালাশ করতে যাওয়াও একধরনের তাতফীফ। নিজের অধিকার আদায় করে নেওয়া দোষণীয় নয়, কিন্তু অন্যের অধিকার খর্ব করা জঘন্যতম তাতফীফ।
তাতফীফ কেন এত জঘন্য অপরাধ?
শরয়ী বিধিবিধানে শিথিলতা ও কাঠিন্য আরোপিত হয় মূল বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায়। আর মাপ বা ওজন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, এটা ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত। আর ব্যবসা-বাণিজ্য সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। কেউ হয়তো ক্রেতা, কেউ বিক্রেতা। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের সততা সমাজে শৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখে। অর্থনীতিতে জারি রাখে ভারসাম্যতা। কিন্তু একধরনের অসাধু ব্যবসায়ী, যারা ঠক প্রতারক ও ধোঁকাবাজ, তারা বিভিন্ন উপায়ে ভোক্তা বা ক্রেতাকে প্রতারিত করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে মাপে বা ওজনে কম দেওয়া বা কারচুপি করা কিছু ব্যবসায়ীর নিত্যকার অভ্যাস। নিকৃষ্টতম এ পাপের ছায়া আজ সমাজের পরতে পরতে বিদ্যমান। যার কুফল ভোগ করতে হচ্ছে সমাজের প্রতিটা বাসিন্দাকে। মোটকথা, এ ধরনের অপরাধের প্রভাব ও ক্ষতি অনেক ব্যাপক, তাই এর জঘন্যতাও অনেক বেশি এবং শরীয়ত এর শাস্তিও রেখেছে অত্যন্ত কঠিন ও মর্মন্তুদ উপায়ে।
কোনো কিছু মাপা বা ওজন করার জন্য পূর্বেকার সমাজে বিভিন্ন ধরনের পাত্র বা বাটখারা ছিল। বর্তমান সমাজে আধুনিক নানা পদ্ধতি বেরিয়েছে। মিটার, ফিতা বা ওয়েট মেশিন সেগুলোর অন্যতম। সুতরাং এগুলোর হিসাব কতটুকু সঠিকভাবে হয়, যন্ত্রে কোনো ত্রুটি আছে কি না, তা আমাদের সবসময় যাচাই করে রাখতে হবে।
মাপ বা ওজন যে পদ্ধতিতেই করা হোক না কেন, খেয়াল রাখতে হবে, ক্রেতা বা ভোক্তা যেন কোনোভাবেই প্রতারিত না হয়। যে ব্যবসায়ী এ ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নেবে, মনে রাখতে হবে, তার ঠিকানা জাহান্নাম। কিয়ামাত-দিবসে তার জন্য রয়েছে কঠোর আযাব। তাই, আসুন, সৎ ও সঠিক ব্যবসার মাধ্যমে আমরা একটি সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে সচেষ্ট হই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের প্রত্যেককে সে তাওফীক দান করুন। আমীন। ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ।