আয়াত ও তরজমা :
وَالضُّحَى
(১) শপথ দিনের আলোকের।
وَاللَّيْلِ إِذَا سَجَى
(২) শপথ রাতের, যখন তা নিঝুম হয়।
مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَى
(৩) (হে রাসূল!) আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং আপনার প্রতি অসন্তুষ্টও হননি।
وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى
(৪) আর আপনার জন্যে ইহকালের চেয়ে পরকালই উত্তম।
وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى
(৫) (হে রাসূল!) আপনার প্রতিপালক অচিরেই আপনাকে এমন কিছু দান করবেন, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হবেন।
সূরার নামকরণ :
ضُحٰي বলা হয় পূর্বাহ্ন বা চাশতের সময়কে। যখন সকালে সূর্য একটু উঁচুতে ওঠে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত الضُّحٰي শব্দ থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আল্লাহ তাআলার সম্পর্ক বহাল রাখার কথা ও রাসূলের ওপর পূর্বাপর কয়েকটি নেয়ামতের কথা স্মরণ করে দেয়া হয়েছে।
শানে নুযূল :
হযরত জুনদুব রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। দু’তিন রাত তাহাজ্জুদ পড়তে পারেননি। এক মহিলা তাঁর নিকট এসে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! মনে হয় তোমার শয়তান তোমাকে ত্যাগ করেছে।’ তখন এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীসক্রম : ৪৯৫০, সহীহ মুসলিম হাদীসক্রম : ১৭৯৭)। এ মহিলা হলো আবূ জাহলের স্ত্রী উম্মে জামিলা। (ফাতহুল বারী, খণ্ড : ৮, পৃষ্ঠা : ৯০৭)
সংক্ষিপ্ত আলোচনা :
এ সূরাটিতে এমন মধুমাখা শব্দ ও মমতা মাখা কথা ব্যবহার হয়েছে, শ্রবণ করা মাত্রই যে কারো মনে হবে- এ যেন প্রভাত বেলার সুরভিত মৃদু সমীরণ প্রেমের বার্তা নিয়ে পরম প্রেমাস্পদের কাছে বিরহী হৃদয়ে যোগসূত্র কায়েম করতে চায়। মন থেকে যাবতীয় দুঃখ বেদনা ও ক্লান্তির ছাপ মুছে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও তাঁর রহমতের নিশ্চিত সম্ভাবনার সুসংবাদ দিয়ে যায়।
পরম করুণাময়ের পক্ষ থেকে এসব কিছুই বলা হয়েছে নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা-কে সান্ত্বনা দিতে। কঠিন দিনগুলোর কষ্ট দূর করতে। তাঁর মনকে নিশ্চিন্ততায় ভরে দিতে এবং মুশরিকদের সমুচিত জবাব দিতে।
অনেক রেওয়াতে পাওয়া যায় যে, মাঝে মাঝে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ওহী আসা বন্ধ থেকেছে এবং জিবরাইল আলাইহিস সালাম তাঁর সাথে সাক্ষাতে বিলম্ব করেছেন। এ সময় মুশরিকরা বিদ্রুপাত্মকভাবে বলেছে, ‘মুহাম্মদকে তাঁর রব (প্রতিপালক) পরিত্যাগ করে গেছে।’ এতে তিনি যে দুঃখ পেয়েছেন তা প্রশমনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা এ সূরাটি নাযিল করেন।
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছ থেকে আসা ওহী, জিবরাইল আলাইহিস সালাম-এর সাক্ষাৎ এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভই ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য ওই সংকটপূর্ণ জীবনের একমাত্র পাথেয়। অসভ্য জাতির হৃদয়হীন ব্যবহার ও হঠকারিতামূলক অস্বীকৃতির মধ্যে এগুলোই ছিল তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা। প্রায় গোটা সমাজ যখন তাঁকে পরিত্যাগ করলো, নিষ্ঠুর ব্যবহারে তাঁকে ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের জীবনকে বিপন্ন করে তুললো। ঈমান গ্রহণের জন্য তাঁর উদাত্ত আহ্বানকে যুক্তিহীনভাবে ঠুকরে দিলো ও সত্যের এ বাতিকে নিভিয়ে দিতে নানা চক্রান্ত করতে থাকলো, ঠিক তখনই এই সূরা নাযিলের মধ্যদিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানিয়ে দেওয়া হলো- “তোমাকে তোমার রব পরিত্যাগ করেননি, অযত্ন-অবহেলা বা ঘৃণাভরে ছেড়ে দেননি তোমাকে। (জেনে রেখো), অবশ্যই অবশ্যই অতীতের থেকে ভবিষ্যৎ তোমার জন্য খুবই উজ্জ্বল। আর শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এমন কিছু দেবেন যাতে তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।…”
প্রিয়তম মালিকের অমিয় সুধায় ভরা প্রিয় বাণী, তাঁর নৈকট্য ও সান্নিধ্যের মধুমাখা আশ্বাস পেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মন আবারও সতেজ হয়ে ওঠলো।
এই গভীর ও মধুর স্নেহের বাণী শুধু যে আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে তা-ই নয়। এ কথাগুলোর প্রবল দোলা রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়কে প্রচণ্ডভাবে আন্দোলিত করেছে। গোটা বিশ্ব-চরাচরের যত স্থানে এ বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে সেখানেই এ সূরের মূর্ছনা সব কিছুকে যেন মাতিয়ে তুলেছে।
তাফসীর :
“শপথ দিনের আলোকের। শপথ রাতের, যখন তা নিঝুম হয়। (হে রাসূল!) আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং আপনার প্রতি অসন্তুষ্টও হননি।”
সূরার শুরুতে শপথ করা হয়েছে আলোকদীপ্ত দিবসের আর অন্ধকার রজনীর। এরপর বলা হয়, (দুশমনদের সমস্ত চিন্তা, সমস্ত কথাই ভুল) তোমার পালনকর্তা তোমার প্রতি অসন্তুষ্টও নন, আর তোমাকে পরিত্যাগও করেননি, বরং প্রকাশ্যে যেভাবে তিনি তাঁর কুদরত আর হিকমতের নানা নিদর্শন প্রকাশ করেন, দিবসের পেছনে রজনি আর রজনির পেছনে দিবসের আগমন ঘটান, ঠিক তেমনি মনে করবে বাতেনি বিষয়েও। সূর্যালোকের পর রজনির তমসা অমানিশার আগমন যদি আল্লাহর ক্রোধ আর অসন্তুষ্টির প্রমাণ না হয়ে থাকে এবং একথারও প্রমাণ যদি না হয়ে থাকে যে, ‘অতঃপর আর কখনো দিবসের আলো উদ্ভাসিত হবে না’, তাহলে কয়েকটা দিন ওহীর আলো রুদ্ধ থাকায় এটা কেমন করে বুঝা যাবে যে, অধুনা আল্লাহ তাঁর বাছাই করা পয়গাম্বরের প্রতি রুষ্ট এবং অসন্তুষ্ট হয়েছেন এবং ওহীর দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন চির দিনের জন্য? মুশরিকরা এমন কথা বলার মানে হলো, আল্লাহর সর্বাত্মক জ্ঞান আর চূড়ান্ত প্রজ্ঞার বিরুদ্ধেই আপত্তি করা। যেন তিনি জানতেন না যে, আমি যাকে নবী করছি, ভবিষ্যতে সে এর যোগ্য প্রমাণিত হবে না!
পরের আয়াতে বলা হয়েছে- “আর আপনার জন্যে ইহকালের চেয়ে পরকালই উত্তম।” এ আয়াতের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে। (ক) আখেরাতের নিয়ামতসমূহ দুনিয়া অপেক্ষা শ্রেয়। (খ) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পূর্বের মুহূর্ত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কেননা প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর শান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং শত্রুদের পক্ষ থেকে তিনি যে দুঃখ-কষ্ট পাচ্ছেন তা ক্রমান্বয়ে দূর হতে থাকবে এবং এক পর্যায়ে গিয়ে তাঁর পরিপূর্ণ বিজয় লাভ হবে।
হযরত ইবনু মাসউদ রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাটাইয়ের ওপর শুয়েছিলেন। ফলে তাঁর পার্শ্বদেশে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর আমি তাঁর দেহে হাত বুলিয়ে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! চাটাইয়ের ওপর আমাকে কিছু বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দিন।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমি কোথায় ও দুনিয়া কোথায়? আমার ও দুনিয়ার উদাহরণ হলো সেই পথচারী পথিকের মত যে, একটি গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করে, তারপর গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে চলে যায়।’ (তিরমিযী, হাদীসক্রম : ২৩৭৭, ইবনু মাযাহ, হাদীসক্রম : ৪১০৯)
রাসূলের প্রতি আল্লাহ তাআলার সুসংবাদ :
“(হে রাসূল!) আপনার প্রতিপালক অচিরেই আপনাকে এমন কিছু দান করবেন, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হবেন।” একথার অর্থ- হে আমার প্রিয়তম রাসূল! ভাবছেন কেনো, অচিরেই আমি আপনাকে দান করবো অনেক অনেক কল্যাণ। দান করবো বিজয়, নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, প্রতাপ। অধিকসংখ্যক সহচর। ইসলামের ব্যাপকতর প্রসার। আর আখেরাতে শাফায়াতের অধিকার এবং নৈকট্যভাজনতা- প্রিয়ভাজনতার এমন মহিমা, যা কারো অনুমানসাধ্য নয়। প্রদর্শন করবো আমার আনুরূপ্যবিহীন সৌন্দর্য। ফলে উৎফুল্ল না হয়ে আপনি পারবেনই না।
বায়হাকী তাঁর ‘দালায়েল’ গ্রন্থে, তিবরানী তাঁর ‘আওসাতে’ এবং হাকেম তাঁর নিজস্ব সূত্রে বর্ণনা করেছেন, হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে কী কী সাফল্যের অধিকারী করা হবে, তা একবার তাঁকে আত্মিক দর্শনের মাধ্যমে দেখানো হলো। তিনি বিস্মিত ও হর্ষোৎফুল্ল হলেন। তখনই অবতীর্ণ হলো আলোচ্য আয়াত।
আতার বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, ‘অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে অনুগ্রহ দান করবেন’ কথাটির অর্থ- অচিরেই আল্লাহ্ আপনাকে দিবেন শাফায়াতের অধিকার। আপনার সুপারিশে মার্জনা করা হবে অসংখ্য পাপীকে। আর আপনি তখন হবেন পূর্ণরূপে পরিতুষ্ট।
এরকম ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে হযরত আলী এবং ইমাম হাসান রাযিআল্লাহু আনহু থেকেও। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস বর্ণনা করেছেন, রাসূল একবার প্রার্থনা করলেন, ‘হে আমার পরম প্রভুপালক! আমার উম্মতকে মার্জনা করো, আমার উম্মতকে মার্জনা করো।’ আল্লাহ তাআলা তখন জিবরাইলকে বললেন, ‘যাও, আমার প্রিয়তম রাসূলকে সান্ত্বনা দাও। বলো, তার উম্মতের ব্যাপারে আমি তাকে প্রসন্ন করবো। দুঃখ দিবো না।’ (মাযহারী)