উটটিকে নিয়ে ইয়াসরিববাসী মহাচিন্তিত। এক পাও এগোতে চাইছে না সে, যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। হাঁটু ভেঙে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে আর সুযোগ পেলেই জাবর কাটছে। সারা দুনিয়ার বাদশা যার পিঠে সওয়ার তার মধ্যে রাজকীয় ব্যাপার তো থাকবেই। এই উট যেই-সেই উট না। দয়ার নবী, বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উট। নবীজি মক্কা থেকে হিজরত (স্বদেশ ত্যাগ) করে এসেছেন। আজকের দিনটা মেহমান হবেন কারও বাড়িতে। রাস্তায় মানুষের ঢল। ছেলে-বুড়ো সব দল বেঁধে নেমে পড়েছে। থেকে থেকে বেজে উঠছে দফের ঝংকার, সুরেলা কন্ঠের গান। আজ যেন খুশির অন্ত নেই, মনের ভেতর এমন আনন্দের ঢেউ ওঠেনি আর কখনো। ছোট ছোট মেয়ে-ছেলের দল নেচে উঠছে দফের তালে। অন্দরের মহিলারা খেজুর ছালের তৈরি পর্দার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখছে রাস্তায়। সকলেই চায় নবীজি তার বাড়িত মেহমান হোন।
সবার আশার জলে পানি ঢেলে দিচ্ছে নবীজির উট। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই থামবার জো নেই। নবীজির নির্দেশনা,
‘ওকে ছেড়ে দাও, ও আদেশপ্রাপ্ত। যেখানে গিয়ে থামবে সেখানেই নামব আমি।’
বনু সালেম, বনু হারেসা,বনু সায়েদার গোত্রপতিরা অনুরোধ করেই যাচ্ছে, আর নবীজি একই উত্তর দিচ্ছেন। পরিস্থিতি শান্ত হলো। ছেড়ে দেয়া হলো উটকে আপন ইচ্ছায়। প্রচÐ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে সবার সবার মধ্যে। দেখা যাক. উট এবার কার বাড়িতে পা রাখে। সৌভাগ্যের দোর খুলে যায় কার। দুলকি চালে এগিয়ে চলছে নবীজির উট। অবাক চোখে সবাই দেখলো ইয়াসরিবের উপকণ্ঠে বনু নাজ্জার গোত্রকেই পছন্দ করেছে নবীজির প্রিয় উট। উঠোনে পৌঁছেই হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছে। উটের পিঠ থেকে আস্তে আস্তে নামলেন নবীজি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন বনু নাজ্জারের গোত্রপতিরা। পরম মমতায় সেই অভ্যর্থনা, আতিথ্য গ্রহণ করলেন নবীজি। এদিকে ইয়াসরিববাসীর মনে মনে ঘুরপাক খাচ্ছে একটা প্রশ্ন। পথে-ঘাটে-বাজারে সবাই একই কথা কইছে। ইয়াসরিবের এতগুলো সম্ভ্রান্ত গোত্রগুলোকে উপেক্ষা করে বনু নাজ্জার গোত্রই কেন। এটাকে নিছক একটা উটের খামখেয়ালি বলে ধরে নেয়া যাচ্ছে না। শত হোক নবীজির উট বলে কথা।
রহস্যটা কী?
গনগনে দুপুর। মক্কার বাজার-ঘাট এখনো সরব। মোটা কাপড় টাঙ্গানো শামিয়ানার নিচে বসেছে দোকান। হরেক রকম জিনিসের পসরা সাজিয়েছে দোকানিরা। ইয়ামানি চাদর, কারুকার্য করা তরবারির খাপ, বর্শা, কী নেই এখানে। পনির, খেজুরের হালুয়া, ছারিদের গন্ধে ম ম করছে খাবারের দোকানগুলো। ঠিক এই সময়ে ঘোড়ায় চড়ে, ধুলো উড়িয়ে মক্কায় ঢুকলো নেতাগোছের এক লোক। পেছনে বসা সুশ্রী এক বালক। মলিন পোশাকে তাকে যেন ঠিক মানানসই লাগছে না। ঘোড়ার খুরের শব্দে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসলো সবাই।
-কে লোকটা?
-কে আবার, আবদে মানাফের ছেলে মুত্তালিব।
-শাম (সিরিয়া) থেকে ফিরে এসেছে না কি। আহা বেচারার ভাইটা বেঘোরে মরল কদিন আগে।
-আমি ভাবছি অন্য কথা। পেছনে বসা সুন্দর বালকটি কে?
-দাস-টাস হবে হয়তো। তবে যাই বলো, এরকম কমবয়সী সুঠাম দাস বাগে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। চেহারার আদলটাও কুরাইশদের মতো।
সন্ধ্যা হতেই আগেভাগে খাবারে বসে গেলেন মুত্তালিব। দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত শরীর। পাশেই বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে ছেলেটি। সেজের কাঁপা কাঁপা উজ্জ্বল আলো ছিটকে পড়ছে ছেলেটির মায়াবী মুখে। সেদিকে তাকিয়ে মুত্তালিব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রুটির টুকরো মুখে দিতে যাবেন অমনি শুরু হলো বউয়ের ঘ্যানঘ্যানানি।
-আচ্ছা তোমার হয়েছেটা কী বলো তো? সারাদিন মুখ ফুটে কিছু বলোনি। ছেলেটি কে, কোত্থেকে এনেছো। ঘরের কাজ-কর্মের জন্য এক জোড়া দাস-দাসী তো আছেই। এই ছেলেটির কী দরকার ছিল?
ক্লান্ত চোখজোড়া তুলে বউয়ের দিকে তাকালেন মুত্তালিব। বিষণœ কণ্ঠে বললেন, ‘ছেলেটি আমার ভাই হাশেমের সন্তান। মৃত্যুর আগে সে আমাকে বলে গিয়েছিল, যেন আমি ওর ছেলেটিকে এখানে নিয়ে আসি।’
-দেখো কাÐ! ও তোমার ভাতিজা আর মক্কার অলিতে-গলিতে মানুষ ওকে ডাকছে আব্দুল মুত্তালিব (মুত্তালিবের দাস) নামে।
-যা খুশি ডাকুক। ক্ষোভ ঝরে পড়ল মুত্তালিবের কণ্ঠে।
-আচ্ছা তোমার ভাই হাশিম মক্কার বাইরে বিয়ে করেছে এটা তো জানতাম না। জনাব, আপনার ভাইয়ের গোপন বিয়ের গল্পটি বলবেন কি?
অবজ্ঞা গায়ে মাখলেন না মুত্তালিব। তবে বউয়ের কথাকে পাত্তা না দিয়েও পারা গেল না। ঘটনাটি বলতেই হলো তাঁকে। নয়তো সকাল হতেই দেখা যাবে মক্কায় কি না কি রটে গেছে।
উটের পিঠে সামানা-পত্তর বাঁধছিল হাশেম। রাশটা টেনেটুনে পরখ করছিল। ওলের চাদরদুটি বেশ খানিকটা জায়গা দখল করেছে। পেছন থেকে মুত্তালিবের গলা শোনা গেলÑ
-কী ভাইজান, যাচ্ছ তাহলে?
-যাচ্ছি বৈ কি। উপায় কী বলো! গাধা যখন কিনেছি ঘাস-পানির ব্যবস্থা তো আমাকে করতে হয়।
এ বছরের শীতকালীন ব্যবসায়ী কাফেলার প্রস্তুতি চলছে। বছরে দুটি ব্যবসায়ীদল বের হয় মক্কা থেকে। একটি গ্রীষ্মকালে ইয়ামান অভিমুখে অন্যটি শীতকালে সিরিয়ার দিকে। হাশেমই এর প্রবর্তক। সুতরাং দুই কাফেলার নেতৃত্বই তাঁকে দিতে হয়। ভুজুং ভাজুং দিয়ে মক্কায় থাকবে সেই উপায় নেই। ইয়াসরিবে পৌঁছে কয়েকদিন যাত্রাবিরতি দিল কাফেলা। এই অঞ্চলের শীতল, সবুজ খেজুরবাগানগুলি চোখের জন্য বড় আরামদায়ক। আনমনে বাজারে হাঁটছিল হাশেম। হঠাৎ পেছন থেকে জাপ্টে ধরল ওকে কে যেন।
-বন্ধু, আমাকে দেখা না দিয়ে এভাবে পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছ। ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও উচিত হয়নি বলে দিলাম।
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন তাকালো হাশেম। আরে আমর যে! হাল হাকিকত কী বল।
-সব কথা পরে হবে। আগে বাড়ি চলো। হাশেমের হাত ধরে টানতে লাগলো আমর। অনিচ্ছা সত্তে¡ও পিছু নিতে হলো হাশেমকে।
আমর বিন ইয়াজিদ। ইয়াসরিবের সম্ভ্রান্ত এক গোত্রের সরদার। ব্যবসায়িক সূত্রে হাশেমের সাথে তার পরিচয়। সেই পরিচয় ধীরে ধীরে পরিণত হয় গভীর বন্ধুত্বে। ছারিদ সামনে নিয়ে মুখোমুখি বসে আছে দুজন। রুটি-ভেজানো গোশতের এই সুস্বাদু খাবার আতিথ্যের সর্বোচ্চ মর্যাদার পরিচায়ক।
-খাবারের জল দিস তো মা!
আমর ডাকল নিজের মেয়েকে।
হাশেমের চোখ চট করে ঘুরে গেল বৈঠকখানার পর্দার ওপারে। একমুহূর্ত মাত্র, হাসেমের চক্ষু স্থির, তাকে দেখেই সরে পড়ল সালমা। একি দেখল হাশেম! কোনো মানবকন্যার এমন রূপ হতে পারে। যেন বিদ্যুতের ঝলকানি। আমর যেন আকাশের চাঁদখানা পেড়ে এনে নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেছে।
আপ্যায়ন শেষ হলো। এখনো ঘোরের মধ্যে আছে হাশেম। আচমকা প্রস্তাবটি দিয়ে বসল সে।
-বন্ধু, আমি তোমার মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাই।
চুপ হয়ে গেল আমর। খানিকক্ষণ নীরবে কি যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা, সিরিয়া যাচ্ছ তো। ওখানকার কাজ-কারবার শেষ করে একবারটি এসো এখানে। ভেবে দেখছি।
সিরিয়ায় ব্যবসাপাতি শেষ হতে হতে কয়েক সপ্তাহ লেগে গেল। কোনো কাজেই মন নেই হাশেমের। শুধু গতরটা এখানে খাটে এই যা, মন তো বাঁধা পড়ে আছে সালমার আঁচলে। সিরিয়ায় ব্যবসার পাট চুকিয়ে ফিরতি পথ ধরল কাফেলা। ইয়াসরিবে যাত্রাবিরতি করল। দুরুদুরু বুকে আমরের বাড়িতে পা রাখল হাশেম। অবশেষে প্রস্তাবে রাজি হলো আমর। কিন্তু একটা শর্তে, হাশেমের সাথে সালমার বিয়ে হবে ঠিক, কিন্তু সালমা কখনো হাশেমের সাথে মক্কায় যাবে না। ঘর-সংসার যা করার হাশেমকে এখান থেকেই করতে হবে। হাশেম শর্তে রাজি হলো। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল দুজনের। এদিকে মক্কার লোকেরা, হাশেমের পরিবারের সদস্যরা কেউ এই বিয়ের খবর জানতে পারলো না। হাশেম ব্যবসায়িক সফরে বের হয়, দীর্ঘদিন সালমার সাথে ইয়াসরিবে কাটায়। কিছুদিন পর সালমার কোলজুড়ে ফুটফুটে একটি ছেলেসন্তান জন্ম নেয়। জন্মের পর দেখা গেল ছেলেটির মাথার একটি চুল সাদা। ছেলেটির নাম রাখা হলো শায়বা (বুড়ো বাবু)।
একবার সিরিয়ায় পৌঁছে হাশেম ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। এবার তার পাশে ছিল ছোটভাই মুত্তালিব। মৃত্যুর সময় হাশেম বলে গেল, মুত্তালিব যেন শায়বাকে মক্কায় নিয়ে আসে।
শায়বা মক্কায় এসে হয়ে গেল আবদুল মুত্তালিব।
হ্যাঁ, ইনি সেই আবদুল মুত্তালিব, আমাদের নবীজির দাদা। যিনি নবীজির নাম রেখেছিলেন মুহাম্মদ। নবীজির অল্প বয়সে যখন মা আমেনা মারা যান তখন আবদুল মুত্তালিব একাই তাঁকে বাবা-মায়ের আদর সোহাগ দিয়ে বড় করেন। নবীজির স্নেহ-মমতায় তিনি এতটুকু ফাঁক রাখেননি। আবদুল মুত্তালিব তাই নবীজির কাছে বিরাট আবেগের স্থান, ভালোবাসার স্থান।
আর আজ, এই হিজরতের সময় নবীজি যে গোত্রে অবতরণ করলেন। এটা তো আবদুল মুত্তালিবের নানাবাড়ি, এরা তো আমর-সালমারই বংশধর। নবীজি যখন উটের পিঠে চড়ে যাচ্ছিলেন, একের পর এক গোত্রের পক্ষ থেকে আতিথেয়তা গ্রহণ করার প্রস্তাব আসছিল। নবীজি খুব করে চাইছিলেন, তিনি তাঁর নানাবাড়িতে উঠবেন। কিন্তু তিনি যে দয়ার নবী, মায়ার নবী, নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে এতগুলো প্রস্তাব তিনি কিভাবে ফিরিয়ে দেন। আপন ইচ্ছাকে মানুষের তরে বিলিয়ে দিতেই তো তাঁর ধরায় আগমন। তাই বারবার বলছিলেন, ‘উটকে ছেড়ে দাও, সে আদেশপ্রাপ্ত।’
কিন্তু আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূলের ইচ্ছাকে পূরণ করবেন না, তা কি হয়?
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
লেখক : তালিবুল ইলম, লালবাগ, ঢাকা