তাফসীরে সূরা তারিক [আয়াত-ক্রম : ১-১০]

وَالسَّمَاءِ وَالطَّارِقِ ـ

(১) শপথ আকাশের এবং রাতে আত্মপ্রকাশকারীর।

 وَمَا أَدْرَاكَ مَا الطَّارِقُ ـ

(২) আপনি কি জানেন, রাতের অন্ধকারে আত্মপ্রকাশকারী (বস্তুটি) কী?

 النَّجْمُ الثَّاقِبُ ـ

(৩) সেটা এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

 إِنْ كُلُّ نَفْسٍ لَمَّا عَلَيْهَا حَافِظٌ ـ

(৪) প্রত্যেকের উপর একজন তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত রয়েছে।

 فَلْيَنْظُرِ الإنْسَانُ مِمَّ خُلِقَ ـ

(৫) অতএব, প্রত্যেক মানুষের চিন্তা করা উচিত যে, কী বস্তু থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

 خُلِقَ مِنْ مَاءٍ دَافِقٍ ـ

(৬) তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে।

 يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ ـ

(৭) এটা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও বক্ষপাজরের মধ্য থেকে।

 إِنَّهُ عَلَى رَجْعِهِ لَقَادِرٌ ـ

(৮) নিশ্চয় তিনি তাকে প্রত্যাবর্তন করাতে সক্ষম।

 يَوْمَ تُبْلَى السَّرَائِرُ ـ

(৯) সেদিন গোপন বিষয়াদি প্রকাশ করা হবে,

 فَمَا لَهُ مِنْ قُوَّةٍ وَلا نَاصِرٍ

(১০) তখন (তা প্রতিহত করতে) তার কোনো শক্তি এবং সাহায্যকারীও থাকবে না।

তাফসীর

১৭টি আয়াতবিশিষ্ট এই সূরার মূল আলোচ্য বিষয় দুটি। ১. পুনরুত্থান এবং ২. কুরআন কারীমের সত্যতা প্রমাণ করা।

শুরুতেই আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা আকাশ এবং উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজির শপথ করে মানবজাতিকে সতর্কবার্তা দিয়েছেন যে, প্রত্যেক মানুষের উপর রয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক ফিরিশতা, যিনি তার কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছেন। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের জন্য তার সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পর এক প্রহরী ফিরিশতা থাকে; তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে।’ [সূরা রাদ, আয়াত-ক্রম : ১১]

হাদীসেও এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ফিরিশতাদের দুটি দল তোমাদের কাছে রাতে ও দিনে পালাক্রমে আগমন করে। উভয় দল ফজর ও আসরের সময় একত্রিত হয় এবং একে-অপরের দায়িত্ব বদল করে।’ [বুখারী]

এরপর মানুষের দুর্বলতার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেন, মানুষের এটা চিন্তা করা উচিত যে, তাকে কী জিনিস থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাদের সৃষ্টির মূল কী?

এখানে অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সাথে কিয়ামাতের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি কেন পুনরুত্থানে সক্ষম হবেন না? যেমন : আল্লাহ তাআলা কুরআনের অন্য জায়গায় বলেন, ‘তিনিই প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি এটাকে সৃষ্টি করবেন পুনর্বার; এটা তাঁর জন্য অতি সহজ। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই, এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা রূম, আয়াত-ক্রম : ২৭]

মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে مَّا۬ءٍ دَافِقٍ বা ওই পানি থেকে, যা মিলনক্রিয়ার চরম উত্তেজনার মুহূর্তে সবেগে নির্গত হয়। এ পানি নারীর গর্ভে পৌঁছানোর পর আল্লাহ তাআলার আদেশ হলে গর্ভে সন্তান আসে।

(الصُّلْبِ وَالتَّرَآئِبِ) এখানে صلب অর্থাৎ মেরুদণ্ড বলতে পুরুষের মেরুদণ্ড আর ترائب বলতে নারীর দুই স্তনের মধ্যখানকে বোঝানো হয়েছে। যে আল্লাহ এরূপ কঠিন জায়গা থেকে পানি নির্গত করে মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন তিনি অবশ্যই পুনরুত্থানের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করতে সক্ষম।

আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় তিনি তার প্রত্যানয়নে ক্ষমতাবান। এতে দুটি অভিমত রয়েছে। একটি অভিমত হলো, বের হওয়া পানি বা বীর্যকে তিনি ওর জায়গায় ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। এটা ইমাম মুজাহিদ রহ., ইকরামা রহ. প্রমুখ আলিমের অভিমত। দ্বিতীয় অভিমত হলো, তাকে পুনরায় সৃষ্টি করে আখিরাতের দিকে প্রত্যাবৃত্ত করতেও তিনি ক্ষমতাবান। এটা হযরত যহহাক রহ.-এর অভিমত। ইমাম ইবনু জারীর এ মতকেই পছন্দ করেছেন। কেননা, দলীল হিসেবে এটা কুরআন কারীমের মধ্যে কয়েক জায়গায় বিবৃত হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা বলেন, কিয়ামাতের দিন গোপন বিষয়সমূহ খুলে যাবে, রহস্য প্রকাশিত হয়ে পড়বে এবং লুক্কায়িত সবকিছুই বের হয়ে যাবে। বুখারী ও মুসলিমে হযরত ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক গাদ্দার-বিশ্বাসঘাতকের নিতম্বে^র নিকট তার বিশ্বাসঘাতকতার পতাকা প্রোথিত করা হবে এবং ঘোষণা করা হবে, “এই ব্যক্তি হলো অমুকের পুত্র অমুক গাদ্দার, বিশ্বাসঘাতক ও আত্মসাৎকারী।” সেই দিন মানুষ নিজেও কোনো শক্তি লাভ করবে না এবং তার সাহায্যের জন্যে অন্য কেউও এগিয়ে আসবে না। অর্থাৎ নিজেকে নিজেও আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না এবং অন্য কেউও তাকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে না।

শানে নুযুল : সূরাটির ১ থেকে ৩ নম্বর আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আবু তালিব একদিন কিছু রুটি ও দুধ রাসূলের জন্য হাদিয়া হিসেবে নিয়ে আসলেন। রাসূল বসে আহার করছেন, আকস্মিক একটি তারকা খসে পড়ে। মুহূর্তেই চারদিক আলোকোজ্জ্বল হয়ে যায়। আবু তালিব আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা আবার কী?’ নবীজি বললেন, ‘এটা তারকা। বিতাড়িত শয়তানকে লক্ষ করে ছুড়ে মারছেন। আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন।’ এই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতগুলো নাযিল হয়। [আসবাবুন নুযুল, ইমাম আবুল হাসান আলী ইবনে আহমদ ওয়াহিদী]

মাসাইলুস সূলুক বা আত্মশুদ্ধির পাথেয় : থানভী রহ. তাঁর বয়ানুল কুরআনে উল্লেখ করেছেন যে, সূরা তারিকের ৪ ও ৫ নম্বর আয়াত মুরাকাবা বা ধ্যান এবং আত্মশুদ্ধির জন্য খুবই উপকারী।

মুরাকাবা বা ধ্যান করার পদ্ধতি : পবিত্র অবস্থায় নিরিবিলি স্থানে চারজানু হয়ে বসে নিজের সৃষ্টির সূচনা এবং প্রত্যাবর্তনস্থল নিয়ে গভীর চিন্তা-ফিকির করা। এতে ধীরে ধীরে অহংকার বা বড়ত্বের নোংরা স্বভাব দূরীভূত হয়ে বিনয় ও নম্রতার গুণ অর্জন হবে।

আমলে কুরআনী : ঘুমানোর পূর্বে এ সূরাটি তিলাওয়াত করলে স্বপ্নদোষ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT