আয়াত ও তরজমা :
اَلَمۡ نَشۡرَحۡ لَکَ صَدۡرَکَ
(১) (হে রাসূল!) আমি কি আপনার খাতিরে আপনার বক্ষ উন্মুক্ত করিনি?
وَ وَضَعۡنَا عَنۡکَ وِزۡرَکَ
(২) আর আমি অপসারণ করেছি আপনার বোঝা।
الَّذِیۡۤ اَنۡقَضَ ظَهۡرَکَ
(৩) যা ছিল আপনার জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক।
وَ رَفَعۡنَا لَکَ ذِکۡرَکَ
আর আপনার জন্য আমি আপনার স্মরণ চর্চাকে সমুন্নত করেছি।
فَاِنَّ مَعَ الۡعُسۡرِ یُسۡرًا
(৫) নিশ্চয় (বর্তমান) কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি।
اِنَّ مَعَ الۡعُسۡرِ یُسۡرًا
(৬) নিশ্চয় কষ্টের সাথেই রয়েছে সুখ।
فَاِذَا فَرَغۡتَ فَانۡصَبۡ
(৭) অতএব, যখন অবসর পান (নফল এবাদতের) তখন সাধনা করুন।
وَ اِلٰی رَبِّکَ فَارۡغَبۡ
(৮) এবং আপনার প্রতিপালকের প্রতিই মনোনিবেশ করুন।
সূরা ইনশিরাহ প্রসঙ্গে :
সূরা আল-ইনশিরাহ মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা ৮টি। এটি আল-কুরআনের ৯৪তম সূরা। নাশরাহ শব্দের ক্রিয়ামূল বিবেচনায় এর নাম রাখা হয়েছে আল-ইনশিরাহ।
শানে নুযূল :
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়ত লাভের পূর্বে মক্কা নগরীর অত্যন্ত সম্মানিত ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। কিন্তু নবুয়ত লাভের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকলে মক্কাবাসীরা এর বিরোধিতা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উপহাস করতে থাকে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নওমুসলিম সাহাবিগণের উপর নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তাআলা এ সূরা নাযিল করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনা প্রদান করেন।
পূর্ববর্তী সূরার সাথে সম্পর্ক :
আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেওয়া অসংখ্য নেয়ামতের তিনটির কথা পূর্ববর্তী সূরায় আলোচনা হয়েছে। আলোচ্য সূরায়ও মহান আল্লাহ আরো তিনটি অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করছেন।
সূরা দোহার পরই সূরা ইনশিরাহ নাযিল হয়। সূরাদ্বয়ের বক্তব্যে মিল অনেক বেশি। এ কারণেই তাউস রাহিমাহুল্লাহ এবং ওমর ইবনে আবদুল আযীয রাহিমাহুল্লাহ বলতেন, সূরা দোহা এবং সূরা ইনশিরাহ একই সূরা। (তাফসীরে কবীর, খণ্ড : ৩২, পৃষ্ঠা : ০২)
মূল বক্তব্য :
এ সূরায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কয়েকটি সুসংবাদ দেওয়া হয়। যথা-
(১) শরহে সদর অর্থাৎ বক্ষ উন্মুক্ত করা।
(২) আল্লাহ পাকের নূর দ্বারা অন্তরকে আলোকিত করা।
(৩) অসাধারণ জ্ঞান ও হেকমত দ্বারা অন্তরকে পরিপূর্ণ করা এবং আল্লাহ পাকের তরফ থেকে অবতীর্ণ ওহী বা মহান বাণী গ্রহণ ও ধারণের জন্য অন্তরকে যোগ্য করে তোলা।
এছাড়াও ঘোষণা হয়েছে যে, নবুওয়ত ও রেসালতের গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য যে অসাধারণ জ্ঞান, ধৈর্য এবং কষ্ট সহিষ্ণুতা একান্ত প্রয়োজন, তা প্রদান করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। (সহীহাইন, মি’রাজ পরিচ্ছেদ এবং নামায অধ্যায়)
দ্বীন ইসলামের প্রচারে বাধা দূর করার খোশখবরিও দেয়া হয়েছে এ সূরায়। ঘোষণা করা হয়েছে, কষ্টের পরই আসে স্বস্তি।
তফসীর :
الَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَة
“(হে রাসূল!) আমি কি আপনার খাতিরে আপনার বক্ষ উন্মুক্ত করিনি?”
বিশ্বমানবের হেদায়েতের কঠিন দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য বক্ষ উন্মুক্ত করে জ্ঞান, ইলম ও মারেফাত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেওয়া হয়েছে।
বক্ষ বিদারণের ঘটনা :
নবুওয়ত ও রেসালতের দায়িত্ব পালনার্থে নবীজির মোবারক অন্তরকে আল্লাহপাক পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। প্রকাশ্যে দু’বার রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্ষ বিদারণ করা হয়েছিল। হযরত আনাস রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস মুসলিম শরীফে সংকলিত হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৈশবকালে অন্য শিশুদের সঙ্গে ছিলেন। হঠাৎ জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম আগমন করলেন। তাঁকে যমীনের উপর শুইয়ে বক্ষ বিদীর্ণ করে কলবকে বের করলেন। তা থেকে একটা খণ্ড বের করে ফেলে দিলেন এবং একটি তশতরীতে রেখে জমযম পানি দ্বারা তাকে ধৌত করলেন। এরপর পুনরায় তা স্বস্থানে রেখে দিলেন।
দ্বিতীয় বার তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করা হয়েছিল শবে মেরাজে। আল্লাহ পাকের মহান দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম এবং মিকাঈল আলাইহিস সালাম এসেছিলেন। প্রথমে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্ষ বিদীর্ণ করে কলব বের করে একটি সোনালি বাটিতে রাখা হয়। এরপর জমযমের পানি দ্বারা তা ধৌত করা হয়। এরপর হেকমত এবং ঈমান তাঁর কলবে ঢেলে যথাস্থানে তা রাখা হলো। হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম শরীফে সংকলিত হয়েছে। (তাফসিরে মাযহারী, খণ্ড : ১২, পৃষ্ঠা : ৪৫১)
وَ وَضَعۡنَا عَنۡکَ وِزۡرَکَ الَّذِي انْقَضَ ظَهْرَكَ
“আর আমি অপসারণ করেছি আপনার বোঝা, যা ছিল আপনার জন্য অত্যন্ত
কষ্টদায়ক।”
প্রথমত : আয়াতে ‘বোঝা’ সম্পর্কে তাফসীরকারগণ বলেছেন, প্রথম প্রথম ওহী নাযিল হওয়ার সময় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অত্যন্ত কষ্ট হত। প্রচণ্ড শীতের সময় ঘর্মাক্ত হয়ে যেতেন। উটের পৃষ্ঠদেশে থাকাবস্থায় ওহীর বোঝার কারণে উট বসে যেত। পরবর্তীকালে আল্লাহপাক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য তা সহজ করে দেন।
দ্বিতীয়ত : নবুওয়ত লাভের পর মানব জাতিকে হেদায়েতের আহ্বান করার দায়িত্ব সহজ করে দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, মানুষের নিকট আমার বাণী পৌঁছে দেওয়াই আপনার কাজ, কাউকে হেদায়েত করার জন্য বাধ্য করা আপনার কাজ নয়।
তৃতীয়ত : কিছুদিন ওহীর অবতরণ বন্ধ ছিল, এ কারণে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন, তা ছিল মনের উপর বিরাট বোঝার ন্যায়।
এতদ্ব্যতীত শরীয়তের বিধান, দ্বীনের তাবলীগ, বিরোধীদের বিরুদ্ধাচরণের মোকাবেলা ও আত্মরক্ষা করা ছিল বিরাট বোঝা। আল্লাহপাক সূরা দ্বোহা এবং সূরা ইনশিরাহ নাজিল করে এ বোঝা দূর করে দিয়েছেন।
চতুর্থত : কোন কোন তফসীরকার বলেছেন, ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতো এবং দিবারাত্রি তিনি সত্য-সাধনায় থাকতেন। কিন্তু বিরোধীদের বিরোধিতার কারণে তাঁর আকাক্সক্ষা মোতাবেক কাজ হতো না, তিনি ব্যথিত হতেন। আল্লাহপাক অনেক দুঃসাধ্য কাজও সহজ করে দেওয়ায় তাঁর অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।
ورفعنا لك ذكرليك
“আর আপনার জন্য আমি আপনার চর্চাকে সমুন্নত করেছি।”
বুখারী শরীফের হাদীসে রয়েছে, হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ পাক বলেছেন, “যখন কোথাও আমাকে স্মরণ করা হবে, আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি যেন আপনারও স্মরণ করা হয়।”
লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ আছে,
لا اله الا الله وَرَسُوله
এই কালেমায় আল্লাহর পবিত্র নাম ও তাওহীদের পরই হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রেসালতের কথা বলা হয়েছে।
কোন সৃষ্টিকে তার মত প্রশংসনীয় করা হয়নি। এমনকি আযান, ইকামত, খুতবা, নামায এবং অন্যান্য জায়গায় মহান আল্লাহর নামের সাথেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম স্মরণ করা হয়। সারা বিশ্বে প্রতি মুহূর্তে লক্ষবার তাঁর নাম উচ্চারিত হয়ে থাকে। এছাড়াও তার উম্মত ও অনুসারীদের নিকট তার সমমর্যাদার আর কেউ নেই। (বিস্তারিত, তফসীরে নূরুল কোরআন, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১৫)
فَاِنَّ مَعَ الۡعُسۡرِ یُسۡرًا اِنَّ مَعَ الۡعُسۡرِ یُسۡرًا
“নিশ্চয় (বর্তমান) কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি, নিশ্চয় কষ্টের সাথেই রয়েছে সুখ।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম প্রচার-প্রসারে অনেক কষ্টভোগ করেছিলেন। আল্লাহপাক এ আয়াতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। তোমরা ইসলামের পথে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করছ। আল্লাহ তাআলা তোমাদের অবসর ও স্বস্তি এনে দেবেন। কষ্ট দূরীভূত হবে, সাধনার ফল দেখতে পারবে। আল্লাহপাকের এ ওয়াদা হিজরতের পরই পূর্ণ হয়েছিল। যে মক্কা থেকে হিজরত করেছিলেন, সেই মক্কাতে মাত্র আট বছর পর দশ হাজার সাথী নিয়ে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেছিলেন। এর ঠিক দু’বছর পর বিদায় হজের সময় উপস্থিত ছিলেন একলক্ষ চব্বিশ হাজার পুণ্যাত্মা সাহাবায়ে কেরাম।
فَإِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبُ وإلى رَبِّكَ فَارْغَبُ
“অতএব, যখন অবসর পান তখন সাধনা করুন। এবং আপনার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ করুন।”
অর্থাৎ মানুষের হেদায়েতের মহান দায়িত্ব পালনের পর আল্লাহর এবাদতে আত্মনিয়োগ করুন। যাতে যেই অসীম নেয়ামত আপনি লাভ করেছেন এবং ভবিষ্যতে করবেন, তার জন্য শোকর আদায় করতে পারেন।
অথবা এর অর্থ হলো, এক এবাদত শেষ হলে আরেক এবাদতে সাধনা করুন, যাতে এক মুহূর্তও এবাদত ব্যতীত অতিবাহিত না হয়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু আনহু এ আয়াতের অর্থ বলেছেন, ‘যখন ফরজ নামায শেষ হয় বা কোন নামায শেষ হয় তখন বিনীতভাবে আল্লাহপাকের দরবারে দুআ করুন।’
তফসীরকার আতা রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, এর অর্থ হলো- ‘দোজখের ভয় এবং জান্নাতের আকাক্সক্ষা নিয়ে আল্লাহপাকের নিকট ক্রন্দন করুন।
সূরা থেকে শিক্ষা :
১. যে ব্যক্তি সত্য ও ন্যায়ের জন্য চেষ্টা করে আল্লাহ তাআলা তার অন্তর খুলে দেন। সৎপথ প্রদর্শন করেন।
২. আল্লাহ তাআলাই মানুষের কষ্ট-যাতনা দূর করেন।
৩. মানুষের মান-সম্মান, খ্যাতি-মর্যাদা সব কিছুই আল্লাহ তাআলার হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মান মর্যাদা দান করেন।
৪. মানব জীবনে সুখ-দুঃখ থাকবেই। সুতরাং হতাশ হওয়া চলবে না। বরং ধৈর্যসহকারে এর মোকাবেলা করতে হবে।
৫. জীবনের প্রতি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান। অতএব, এ সময়কে কাজে লাগাতে হবে। দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে হবে।
৬. পার্থিব প্রয়োজনীয় কাজ সমাধানের পর আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও স্মরণে আত্মনিয়োগ করতে হবে। সকল কিছুতেই আল্লাহ তাআলার প্রতি মনোনিবেশ করা তাঁর প্রিয় বান্দার বৈশিষ্ট্য।