তাফসীরে সূরা ইনশিকাক [আয়াত-ক্রম : ৬-১৯]

 

یٰۤاَیُّهَا الۡاِنۡسَانُ اِنَّکَ کَادِحٌ اِلٰی رَبِّکَ کَدۡحًا فَمُلٰقِیۡهِ ـ فَاَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ کِتٰبَهٗ بِیَمِیۡنِهٖ ـ فَسَوۡفَ یُحَاسَبُ حِسَابًا یَّسِیۡرًا ـ وَّ یَنۡقَلِبُ اِلٰۤی اَهۡلِهٖ مَسۡرُوۡرًا ؕ ـ وَ اَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ کِتٰبَهٗ وَرَآءَ ظَهۡرِهٖ ـ فَسَوۡفَ یَدۡعُوۡا ثُبُوۡرًا ـ  وَّ یَصۡلٰی سَعِیۡرًا ـ اِنَّهٗ کَانَ فِیۡۤ اَهۡلِهٖ مَسۡرُوۡرًا ـ  اِنَّهٗ ظَنَّ اَنۡ لَّنۡ یَّحُوۡرَـبَلٰۤی ۚۛ اِنَّ رَبَّهٗ کَانَ بِهٖ بَصِیۡرًا ـ فَلَاۤ اُقۡسِمُ بِالشَّفَقِ ـ وَ الَّیۡلِ وَ مَا وَسَقَ ـ وَ الۡقَمَرِ اِذَا اتَّسَقَ ـ لَتَرۡکَبُنَّ طَبَقًا عَنۡ طَبَقٍ

তরজমা

(৬) হে মানুষ, তোমার রব পর্যন্ত (পৌঁছতে) অবশ্যই তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাৎ পাবে।

(৭) অতঃপর যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে,

(৮) তার কাছ থেকে সহজ হিসাব নেওয়া হবে।

(৯) এবং সে তার (জান্নাতী) পরিবারবর্গের নিকট আনন্দচিত্তে ফিরবে।

(১০) আর যাকে তার আমলনামা তার পিঠের পেছন দিক থেকে দেওয়া হবে,

(১১) সে ধ্বংসকে ডাকবে।

(১২) এবং সে লেলিহান আগুনে জ্বলবে।

(১৩) সে (পৃথিবীতে) তার পরিবাবর্গের নিকট আনন্দিত ছিল।

(১৪) সে ধারণা করেছে যে, সে কখনও ফিরবে না।

(১৫) অবশ্যই তার পালনকর্তা তাকে দেখতেন।

(১৬) সুতরাং আমি সন্ধ্যা-লালিমার কসম করছি।

(১৭) আর রাতের কসম এবং রাত যা কিছুর সমাবেশ ঘটায়, তার!

(১৮) আর চাঁদের কসম, যখন তা পরিপূর্ণ হয়।

(১৯) অবশ্যই তোমরা এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আরোহণ করবে।

ভূমিকা

সূরা ইনশিকাকের ৬ থেকে ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমাদের মধ্যে চেতনা থাকুক আর না থাকুক একদিন তোমাদেরকে আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। যেদিন সৎ-অসৎ কর্মের ফলাফল নির্ণয় করা হবে। নির্ণিত ফলাফলের ভিত্তিতে মানুষ দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। (১) ডানপন্থী (২) বামপন্থী। ডানপন্থীদের আমলনামা থাকবে ডান হাতে আর বামপন্থীদের আমলনামা থাকবে বামহাতে।

বিশেষ কিছু বান্দার হিসাব হবে সহজ। তথা তারা বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

সহজ হিসাব বলতে কী বুঝায়

ইমাম আহমাদ রহ. থেকে বর্ণিত, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোনো এক নামাযে দুআ করতে শুনেছি, ‘হে আল্লাহ! আমার হিসাব সহজ করো।’ নামায শেষে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! সহজ হিসাব কী?’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যাকে শুধু আমলনামাটি দেখেই মাফ করা হবে। আর হিসাব-নিকাশের ব্যাপারে যাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)

একদলকে ডান হাতে আমলনামা দেওয়া হবে

যারা দুনিয়ার জীবনকে ক্ষণস্থায়ী মনে করে আখিরাতের ফিকিরে বিভোর থাকে, হাশরের মাঠে তাদের আমলনামা থাকবে ডান হাতে। তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজ নিজ পরিবারবর্গের কাছে ফিরে যাবে। ভয়ভীতি ও চিন্তা-পেরেশানিমুক্ত হয়ে অনাবিল সুখ-শান্তির নিবাস জান্নাতে বসবাস করতে শুরু করবে। যেমন : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘যাকে ডান হাতে আমলনামা দেওয়া হবে সে আনন্দে বলবে, নাও আমার আমলনামা পড়ে দেখো। আমার পূর্ব হতেই বিশ্বাস ছিল যে, নিঃসন্দেহে আমাকে হিসাব-কিতাবের সম্মুখীন হতে হবে। অতএব সে বড় সুখী জীবনযাপন করবে। উচ্চ জান্নাতে তার ফলসমূহ থাকবে অবনমিত। বিচার দিনে তোমরা যা প্রেরণ করছিলে তার প্রতিদান হিসেবে তোমরা তৃপ্তি-সহকারে খাও এবং পান করো।’ (সূরা হাক্কাহ, আয়াত-ক্রম : ১৯-২৪)

একদলের আমলনামা দেওয়া হবে বাম হাতে

যারা দুনিয়াতে আয়েশী জীবন যাপন করেছে, পার্থিব জীবনকে প্রকৃত জীবন মনে করে আখিরাতকে অবিশ্বাস করেছে, তাদের আমলনামা থাকবে বামহাতে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের চেহারা কুৎসিত কালো বর্ণের রূপ ধারণ করবে। চিরস্থায়ী অসহনীয় শাস্তির নিবাস জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘যার আমলনামা তার বাম হাতে দেওয়া হবে, সে বলবে হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা না দেওয়া হতো! আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায়! মৃত্যুই যদি হতো আমার শেষ! আমার ধন-সম্পদ আমার কোনো উপকারে আসল না। আমার ক্ষমতাও বরবাদ হয়ে গেল।’ (সূরা হাক্কাহ, আয়াত-ক্রম : ২৫-২৯)

বাম হাতে পিঠের পেছন থেকে আমলনামা কেন দেওয়া হবে?

আল্লামা কালবী রহ. বলেন, ‘তাদের ডানহাত গর্দানে বাঁধা থাকবে আর বাম হাত থাকবে পিঠের পেছন দিকে।’

আল্লামা মুজাহিদ রহ. বলেন, ‘বাম হাত সম্পূর্ণরূপে তুলে পিঠের পেছনে স্থাপন করা হবে।’

কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, ‘তাদের চেহারা পিঠের পেছন দিকে ঘুরে দেওয়া হবে।’ (তাফসীরে কাবীর, ইমাম রাযী রহ.)

হিসাব গ্রহণ করার অর্থ

হিসাব অর্থ শুমার করা গণনা করা। অর্থাৎ বনী আদমের প্রতিটি কৃতকর্মের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইনসাফ যে তিনি আহকামুল হাকিমীন হয়েও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখবেন।

হিসাব-নিকাশের পন্থা-বিচারে মানুষ হাশরের মাঠে চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে-

প্রথম শ্রেণি : যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের কোন জেরা করা হবে না। এদের সংখ্যা হবে ৭০ হাজার। এদের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সমস্ত উম্মতকে আমার সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল। আমার উম্মতকে দেখলাম তাদের আধিক্যতাসহ। আমাকে তা আশ্চর্যান্বিত করল। পাহাড়-পর্বত ও সমতলভূমি তারা ভরে ফেলেছে। আমাকে বলা হলো, হে মুহাম্মদ! তুমি কি সন্তুষ্ট? আমি বললাম, সন্তুষ্ট হে আমার রব। বলা হলো, এদের সঙ্গে আরো ৭০ হাজার বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে যারা ঝাড়ফঁুক নেবে না এবং শেকও লাগাবে না।’ এ-কথা শুনে উকাশা বললেন, ‘আপনি আমার জন্য দুআ করুন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন।’ নবীজি বললেন, ‘হে আল্লাহ! তাকে আপনি তাদের অন্তভুর্ক্ত কেও নিন।’ (হাকীম, হাদীস-ক্রম : ৮২৭৬)

দ্বিতীয় শ্রেণি : যাদের হিসাব হবে খুব সংক্ষিপ্ত। প্রতিটি কৃতকর্মের ব্যাপারে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে না। বরং আমলনামা উপস্থাপন করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ক্ষমার ঘোষণা দেবেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ মুমিনকে কাছে ডাকবেন। ছাউনি দিয়ে তাকে ডাকবেন। এরপর বলবেন, তুমি কি অমুক পাপের কথা স্বীকার কর? অমুক পাপের কথা স্বীকার কর? বান্দা বলবে, হ্যাঁ, আমার রব, আমি স্বীকার করি। যখন সে সমস্ত গুনাহের কথা স্বীকার করবে তখন সে মনে মনে করবে যে, ধ্বংস হয়ে গেছে। (কিন্তু) আল্লাহ তাআলা বলবেন, তোমার এসব গুনাহ আমি দুনিয়াতে ঢেকে রেখেছি। আজ আমি এগুলো মাফ করে দিয়েছি। এরপর তাকে তার নেকীর তালিকা দেওয়া হবে।’ (বুখারী, হাদীস-ক্রম : ২৪৪১)

তৃতীয় শ্রেণি : এ শ্রেণির হিসাব হবে বড় কঠিন। চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। ধরপাকড় হবে। নামায-রোযা ও অন্যান্য বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘এটা হচ্ছে শুধু আমলনামা প্রদর্শন। কিয়ামাতের দিন যারই হিসাব নেওয়া হবে সে কঠিন আযাবের সম্মুখীন হবে।’ (বুখারী)

চতুর্থ শ্রেণি : যাদের হিসাব হবে দীর্ঘ ও সঙ্কটময়। পাপের প্রাচুর্য, দম্ভ আর অহংকার যাদের জীবনকে বরবাদ করে দিয়েছে। রাব্বুল আলামীন এদের সাথে কথা বলবেন না।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT