আয়াত ও তরজমা
كَذَّبَتْ ثَمُودُ بِطَغْوَاهَا
(১১) সামুদ জাতি তাদের নাফরমানীর কারণে (সত্যকে) অস্বীকার করেছিল।
إِذِ انْبَعَثَ أَشْقَاهَا
(১২) তাদের মধ্যে সর্বাধিক হতভাগা ব্যক্তিটি যখন তৎপর হয়ে উঠেছিল।
فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ نَاقَةَ اللَّهِ وَسُقْيَاهَا
(১৩) তখন আল্লাহর রাসূল তাদেরকে বলেছিলেন, আল্লাহ পাকের উষ্ট্রী এবং তার পানি পান করানোর সম্পর্কে তোমরা সতর্ক থাক।
فَكَذَّبُوهُ فَعَقَرُوهَا فَدَمْدَمَ عَلَيْهِمْ رَبُّهُمْ بِذَنْبِهِمْ فَسَوَّاهَا
(১৪) কিন্তু তারা রাসূলকে মিথ্যাজ্ঞান করলো এবং উষ্ট্রীকে হত্যা করলো। তাই তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিলেন, তাদের পাপাচারের কারণে।
وَلَا يَخَافُ عُقْبَاهَا
(১৫) এবং এর পরিণামের জন্যে আল্লাহ পাকের আশঙ্কা করার কিছুই নেই।
সংক্ষিপ্ত তাফসীর
আলোচ্য আয়াতগুলোতে ওই সকল লোকের উদাহরণ পেশ করা হয়েছে, যারা নিজেদেরকে নানা প্রকার পাপ কাজের দ্বারা কলুষিত করেছে এবং হেদায়াতের আলো থেকে নিজেদেরকে আড়াল করে আপন সম্মানকে লাঞ্ছিত করেছে। উক্ত আয়াতগুলোতে সামুদ জাতির গযবপ্রাপ্ত হওয়া ও আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্যে আসা শাস্তি এবং অবশেষে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বলা হচ্ছে, ‘সামুদ জাতি (নবীকে) অস্বীকার করলো, মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলো ও উপেক্ষা করলো তাদের অহংকার ও সীমালংঘন করার মাধ্যমে (তারা বাড়াবাড়ি করলো)। স্মরণ করে দেখো সেই সময়ের কথা, যখন তারা তাদের সব থেকে দুষ্ট লোকটিকে (তাদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য) পাঠালো। তখন তাকে আল্লাহর রাসূল বললেন, ছেড়ে দাও আল্লাহর উটনীকে, তাকে তার নিজ হিসসার পানি খেতে দাও। কিন্তু তারা তাকে হত্যা করলো। এর ফলে তাদের রব, তাদের অপরাধের দরুন উপর্যুপরি আযাবের কশাঘাত হানলেন এবং তাদের শহর-নগরগুলোসহ তাদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেন। এভাবে নাফরমান জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে বিশ্বপালক আল্লাহ তাআলা কাউকে ভয় করেন না, ভয় করার তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই, যেহেতু তাঁর ওপর কথা বলার ক্ষমতা কারো নেই। সামুদ জাতি ও তাদের নবী সালেহ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে কুরআন পাকের বহু স্থানে অল্প-বিস্তর বর্ণনা এসেছে।
সামুদ জাতির পরিচয় ও তাদের ধ্বংসের বিবরণ
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর পূর্বে প্রাচীন আরবীয় যে গোত্রগুলো ছিল, সামুদও তাদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা ছিল আ’দ সম্প্রদায়ের পরবর্তী কওম। হিজায ও শামের মধ্যবর্তী ‘ওয়াদী কুরা’ ও এর চতুষ্পর্শ্বের এলাকা তাদের আবাসভূমি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
সামুদ সম্প্রদায়ের লোকেরা একবার এক স্থানে সমবেত হয়। ঐ সমাবেশে নবী সালেহ আলাইহিস সালাম আগমন করেন এবং তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানান, উপদেশ দান করেন, ভীতি প্রদর্শন করেন, নসীহাত করেন এবং তাদেরকে সৎ কাজের নির্দেশ দেন। উপস্থিত লোকজন তাঁকে বলল, ‘ঐ যে একটা পাথর দেখা যায়, ওর মধ্য থেকে যদি অমুক অমুক গুণসম্পন্ন একটি দীর্ঘকায় দশ মাসের গর্ভবতী উটনী বের করে দেখাতে পার, তবে দেখাও।’ সালেহ আলাইহিস সালাম বললেন, ‘তোমাদের বর্ণিত গুণসম্পন্ন উটনী যদি আমি বের করে দেই তাহলে কি তোমরা আমার আনীত দীন ও আমার নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে?’ তারা সবাই বলল, ‘হ্যাঁ, বিশ্বাস করব।’ তখন তিনি এ কথার উপর তাদের থেকে অঙ্গীকার ও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। এরপর সালেহ আলাইহিস সালাম দাঁড়িয়ে যান এবং আল্লাহর নিকট তাদের আবদার পূরণ করার প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেন এবং ঐ পাথরকে কেটে অনুরূপ গুণসম্পন্ন একটি উটনী বের করে দেয়ার নির্দেশ দেন। যখন তারা স্বচক্ষে এরূপ উটনী দেখতে পেল, তখন অনেকেই ঈমান আনল, কিন্তু অধিকাংশ লোকই তাদের কুফরী, গুমরাহী ও বৈরিতার উপর অটল হয়ে থাকল।
অতঃপর হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম তাদেরকে বললেন, ‘এটি আল্লাহর উটনী, তোমাদের জন্য নিদর্শন। একে আল্লাহর যমীনে চরে খেয়ে বেড়াতে দাও এবং এর অনিষ্ট সাধন করো না। অন্যথায় এক নিকটবর্তী আযাব তোমাদেরকে পাকড়াও করবে।’ তারপর অবস্থা এই দাঁড়াল যে, এ উটনীটি তাদের মধ্যে স্বাধীনভাবে যেখানে ইচ্ছা চরে বেড়াত, একদিন পর পর পানির ঘাটে অবতরণ করত। যেদিন সে পানি পান করত সেদিন কূপের সমস্ত পানি নিঃশেষ করে ফেলত। তাই সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের পালার দিনে পরের দিনের জন্যে প্রয়োজনীয় পানি উত্তোলন করে রাখত।
দীর্ঘদিন যাবত এ অবস্থা চলতে থাকায় সম্প্রদায়ের লোকেরা অধৈর্য হয়ে পড়ে। এর থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য তারা একদা সমবেত হয় ও পরামর্শ করে। তারা সম্মিলিতভাবে এই সিদ্ধান্ত করে যে, উটনীটিকে হত্যা করতে হবে। এর ফলে তারা উটনীটির কবল থেকে নিষ্কৃতি পাবে এবং সমস্ত পানির উপর তাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। শয়তান তাদেরকে এ কাজের যুক্তি ও সুফল প্রদর্শন করল। ফলে তারা উটনীটিকে হত্যা করে ফেললো।
এরপর তারা সংকল্পবদ্ধ হলো সালেহ আলাইহিস সালাম-কে হত্যার করার জন্য। যে কয় ব্যক্তি সালেহ আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করতে সংঘবদ্ধ হয়েছিল, আল্লাহ প্রথমে তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেন। পরে গোটা সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেন। যে তিনদিন তাদেরকে অবকাশ দেয়া হয়েছিল তার প্রথমদিন ছিল বৃহস্পতিবার। এই দিন আসার সাথে সাথে সম্প্রদায়ের সকলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন শুক্রবারে সকলের চেহারা লাল রঙ ধারণ করে। তৃতীয় দিন শনিবারে সকলের চেহারা কাল রঙ ধারণ করে। সন্ধ্যাবেলা তারা বলাবলি করে যে, জেনে নাও, নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেছে। রবিবার সকালে তারা খোশবু লাগিয়ে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষায় থাকল- কী শাস্তি ও আযাব-গযব নাযিল হয় তা দেখার জন্যে। তাদের কোনই ধারণা ছিল না যে, তাদেরকে কী করা হবে এবং কোন দিক থেকে আযাব আসবে। কিছু সময় পর সূর্য যখন উপরে এসে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তখন আসমানের দিক থেকে বিকট আওয়াজ এলো এবং নিচের দিক থেকে প্রবল ভূকম্পন শুরু হল। সাথে সাথে তাদের প্রাণবায়ু উড়ে গেল, সকল নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল এবং যা সত্য তাই বাস্তবে ঘটে গেল। ফলে সবাই লাশ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল।
উটনীকে হত্যাকরীর পরিচয়
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- “তাদের মধ্যে সর্বাধিক হতভাগা ব্যক্তিটি যখন তৎপর হয়ে উঠেছিল।”
একথার অর্থ- উটনীকে হত্যার ব্যাপারে সর্বাধিক আগ্রহী ছিল এক হতভাগ্য। সে নিজ হাতে উটনীকে হত্যা করবে বলে পণ করেছিল এবং গ্রহণ করেছিল কার্যকর উদ্যোগ।
হতভাগ্য লোকটির নাম ছিল- কাজার ইবনে সালিক। সে ছিল বেঁটে, গৌরবর্ণ ও নীল চক্ষুবিশিষ্ট। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জামআ থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সালেহ নবীর উষ্ট্রীসংহার পর্ব প্রসঙ্গে বললেন। একথাও বললেন যে, উষ্ট্রীটি বধ করতে উদ্যত হয়েছিল তাদের সম্প্রদায়ের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। যেমন আবু যামআ।
হযরত ইবনে ওমর বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সালেহ নবীর উষ্ট্রী বধকারী লোকটিই মানবজাতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক হতভাগা। আর হতভাগা হযরত আদম নবীর ওই সন্তান, যে হত্যা করেছিল তার আপন ভাইকে। হত্যাকাণ্ডের প্রথম প্রচলন ঘটায় সে। সেকারণে পরবর্তী সময়ের সকল হত্যাকাণ্ডের পাপের একটা অংশ বহন করতে হবে তাকে।’ (মাযহারী)