আয়াত ও তরজমা
وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَى
(১) শপথ রাতের, যখন তা আচ্ছন্ন করে।
وَالنَّهَارِ إِذَا تَجَلَّى
(২) শপথ দিনের, যখন তা আলোকিত হয়।
وَمَا خَلَقَ الذَّكَرَ وَالْأُنْثَى
(৩) এবং শপথ তাঁর, যিনি নর-নারীকে সৃষ্টি করেছেন।
إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّى
(৪) নিশ্চয় তোমাদের কর্ম প্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকারের।
فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى
(৫) অতএব, যে কেউ দান করে এবং ভয় করে চলে।
وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى
(৬) এবং যে ভালো কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে।
فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى
(৭) আমি তার জন্যে সহজ পথকে সুগম করে দেব।
وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى
(৮) কিন্তু যে কেউ কার্পণ্য করে এবং বেপরোয়া হয়ে থাকে।
وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى
(৯) আর যা উত্তম, তাকে মিথ্যাজ্ঞান করে।
فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى
(১০) আমি তার জন্যে সুগম করে দেব কঠোর পরিণামের পথ।
সূরার নামকরণ :
সূরার প্রথম আয়াতেরاللَّيْلِ শব্দ থেকেই উক্ত সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সূরার ফযীলত :
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মাআয রাযিআল্লাহু আনহু-কে এ সূরা দ্বারা ইমামতি করতে উৎসাহিত করেছিলেন। এর দ্বারা বুঝা যায় সূরাটি অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ। যদি কোন ব্যক্তি স্বপ্নে দেখে যে, সে এ সূরাটি পাঠ করছে, তবে সে অভাবগ্রস্ত হবে না। তার কর্তব্য হলো, নিদ্রাভঙ্গ হলেই উঠে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করবে।
সংক্ষিপ্ত আলোচনা :
আলোচ্য সূরাটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে বিশ্ব-জগতের মধ্যে অবস্থিত রহস্যরাজি ও মানব-প্রকৃতির মধ্যে বিদ্যমান বৈশিষ্টগুলো বর্ণনা করা এবং তার সঠিক কাজ ও তার ফল কী হবে সে বিষয় নিশ্চিত জ্ঞানদান করা। সূরাটির শুরুতেই মহান আল্লাহ তাআলা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের শপথ করেছেন, যে সময়গুলোতে মানুষ বিভিন্ন আমল করে থাকে। আমল সম্পাদনের দিক দিয়ে পৃথিবীতে মানুষ দু’ধরণের হতে পারে। এক. যাদেরকে আল্লাহ তাআলা সঠিক পথে চলার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। এরাই সফলকাম এবং তাদের তিনটি গুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। দুই. যাদেরকে আল্লাহ তাআলা ভ্রান্তপথে চলার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। এরা ব্যর্থকাম এবং এদের তিনটি দোষ বর্ণনা করা হয়েছে।
আল্লাহর শপথ :
“কসম নিশীথ রাতের, যখন তা ঘনীভূত অন্ধকারে (সব কিছুকে) আচ্ছন্ন করে। আর শপথ উজ্জ্বল দিবালোকের, যা আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে গেলো।” এখানে রাতের ‘আচ্ছন্ন করা’ এবং দিনের ‘আলোকিত হওয়া’র শপথ করে আল্লাহ তাআলা এ দুয়ের কল্যাণকর বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রতি যেমন বান্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তেমনি দুনিয়ায় নেক আমলের মাধ্যমে আখিরাতে মুক্তির পথ বেছে নেয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন।
এই আয়াতে দুটি কালের ব্যবহার হয়েছে। ‘ইয়াগশা’ ভবিষ্যত বা নিত্য বর্তমান এবং ‘তাজাল্লা’ অতীত। আল্লাহ তাআলা এই উভয় সময়ের কসম খেয়ে এবং দুটি সময়ের জন্য দুই ধরনের কাল ব্যবহার করে অনাগত মানুষকে বলতে চেয়েছেন যে, প্রতিনিয়ত আগত অন্ধকারের ঘনঘটার মধ্য থেকে নিশ্চিতভাবে যখনই হেদায়াতের আলোর আভা বিচ্ছুরিত হবে তখন যতো কষ্টই হোক না কেন গাফলতির চাদরকে দূরে নিক্ষেপ করে তাকে আলোর পথে আসতে হবে।
পরের আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “এবং শপথ তাঁর, যিনি নর-নারীকে সৃষ্টি করেছেন।” এখানে আল্লাহ তাআলা নিজ সত্ত্বার শপথ করেছেন। কেননা তিনি হলেন নর নারী উভয়ের সৃষ্টিকর্তা। এ ক্ষেত্রে ما মাওসূলা الذي বা যিনি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর ما মাসদার বা ক্রিয়ামূল হলে অর্থ হবে শপথ নর নারী সৃষ্টির। (তাফসীরে সা’দী)
মোটকথা, আল্লাহ তাআলা নর নারী সৃষ্টি করেছেন। অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন- وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ “আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায়-জোড়ায়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” (সূরা যারিয়াত : আয়াতক্রম : ৪৯)
শপথসমূহের জবাব :
“অবশ্যই তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকৃতির।” বাক্যটি শপথের জবাব। এর অর্থ : হে মানুষ! কর্মপ্রচেষ্টা অনুসারে তোমাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে দুটি স্থান জান্নাত ও জাহান্নাম। তাই তো দেখা যায়, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ জাহান্নামের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে ব্যস্ত। আর কেউ কেউ তৎপর জান্নাতের উন্নততর স্তর সন্ধানে।
বাগবী লিখেছেন, হযরত আবু মালেক আশরারী বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষ সকালে বাড়ি থেকে বের হয়। তারপর বিক্রয় করতে থাকে নিজেকে। এভাবে কেউ নিজেকে মুক্ত করে জাহান্নাম থেকে, আবার কেউ নিজেকে নিক্ষেপ করে জাহান্নামে।’ (মাযহারী)
জান্নাত লাভের পথ :
“সুতরাং কেউ দান করলে, মুত্তাকী হলে এবং যা উত্তম তা সত্য বলে গ্রহণ করলে, আমি তার জন্য সুগম করে দিবো সহজ পথ।”
এখানে ‘দান করলে’ অর্থ আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করলে। আর ‘মুক্তাকী হলে’ অর্থ যে সকল অপকর্মের জন্য শাস্তি অবধারিত, সে সকল অপকর্ম থেকে বিরত থাকলে। হযরত বারা বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা একটি খেজুরের অর্ধেক দান করে হলেও নরকাগ্নি থেকে পরিত্রাণের প্রয়াস পেয়ো।’
‘আল হুসনা’ অর্থ যা সুন্দর। আবদুর রহমান আসলামা ও জুহাক বলেছেন, এখানে ‘আল হুসনা’ অর্থ কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। কেউ বলেছেন এর অর্থ জান্নাত। এভাবে বক্তব্যটির অর্থ দাঁড়ায়- যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনকারী, তিনি তাদেরকে দান করবেন জান্নাত।
মোটকথা, যে ব্যক্তি নেক রাস্তায় অর্থ ব্যয় করে, অন্তরে আল্লাহকে ভয় করে, ইসলামের ভালো কথাগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং এই সুসংবাদকে সত্য-সঠিক বলে বিশ্বাস করে, তার জন্য আল্লাহ তাআলা নেকীর পথকে সহজ করে দেবেন আর শেষ পরিণতিতে নিতান্ত সুখ-শান্তির স্থানে তাকে পৌঁছিয়ে দেবেন, যার নাম হচ্ছে জান্নাত।
জাহান্নামের পথযাত্রী হবে যারা :
“কিন্তু যে কেউ কার্পণ্য করে এবং বেপরোয়া হয়ে থাকে, আর যা উত্তম, তাকে মিথ্যাজ্ঞান করে, আমি তার জন্যে সুগম করে দেব কঠোর পরিণামের পথ।”
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় অর্থ ব্যয় করেনি এবং তাঁর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের সাওয়াবের পরোয়া করেনি, ইসলামের বাণী ও আল্লাহর ওয়াদাকে মিথ্যা মনে করেছে, তার অন্তর দিন দিন সংকীর্ণ ও কঠিন হয়ে যাবে। নেকীর তাওফীক রহিত হয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত ধীরে ধীরে খোদায়ী আযাবের কঠোরতায় পৌঁছে যাবে। এটাই আল্লাহর স্বভাব যে, ভাগ্যবানরা যখন নেক অবলম্বন করে আর হতভাগারা যখন চলে বদ আমলের দিকে, তখন উভয়ের জন্য সে পথই সহজ করে দেয়া হয়, খোদায়ী তাকদীর অনুযায়ী যা তারা নিজেরাই পছন্দ করে নিয়েছে নিজেদের ইচ্ছা-অভিপ্রায়ে। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, “তারা যেমন প্রথমবারে তাতে ঈমান আনেনি আমিও তাদের মনোভাবের ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দেব এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতে দেব।” (সূরা আনআম, আয়াতক্রম : ১১০)
হযরত আলী রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা কোন এক জানাযায় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে আমরা ছিলাম। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের স্থান জান্নাতে বা জাহান্নামে নির্ধারিত করা আছে।’ সাহাবী বললেন, ‘তার উপর নির্ভর করে থাকব না?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা আমল করে যাও কারণ প্রত্যেকের জন্য সেই আমলই সহজ করে দেয়া হয়েছে যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’ তারপর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতগুলো পাঠ করলেন।’ (বুখারী, হাদীসক্রম : ৪৯৪৫)