তাফসীরে সূরা আল-লাইল [আয়াত-ক্রম : ১২-২১]

আয়াত ও তরজমা :

إِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدَى

(১২) নিশ্চয় আমার দায়িত্ব হলো পথ প্রদর্শন করা।

وَإِنَّ لَنَا لَلْآخِرَةَ وَالْأُولَى

(১৩) আর নিশ্চয় আমারই হাতে রয়েছে আখেরাত ও দুনিয়া।

فَأَنْذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظَّى

(১৪) আমি তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করছি অগ্নির লেলিহান শিখার।

لَا يَصْلَاهَا إِلَّا الْأَشْقَى

(১৫) যে নিতান্ত হতভাগা সে-ই তাতে প্রবেশ করবে।

الَّذِي كَذَّبَ وَتَوَلَّى

(১৬) (আর হতভাগা সে-ই) যে সত্যকে অস্বীকার করে এবং বিমুখ হয়।

وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى

(১৭) আর যে সর্বাধিক পরহেজগার তাকে ঐ অগ্নি থেকে দূরে রাখা হবে।

الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّى

(১৮) (আর সর্বাধিক পরহেজগার সে-ই) যে তার অর্থ-সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে।

وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى

(১৯) তার উপর কারোও এমন দান নেই যে, তাকে প্রতিদান দিতে হবে।

إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى

(২০) যা কিছু করছে, সে তার প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই করছে, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ।

وَلَسَوْفَ يَرْضَى

(২১) আর সে অচিরেই সন্তুষ্টি লাভ করবে।

 

তাফসীর :

হিদায়াত দানের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা :

প্রত্যেক যামানায় এবং প্রতিটি দেশে মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সর্বদাই দুটি মত ও পথ বিরাজ করে। এই দুটি পথে বিচরণকারী প্রত্যেকের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন যে, ওই পরিণতিগুলো অবশ্যই আসবে এবং নির্দিষ্ট সময়েই আসবে। সুতরাং আল্লাহর নিয়ম অনুযায়ী, ওই পরিণতিসমূহ আসার পূর্বেই তিনি হেদায়াতের পথকে মানুষের সামনে স্পষ্ট করে বর্ণনা করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে স্ফুলিঙ্গবিশিষ্ট আগুনের ভয় দেখিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই, আমার ওপর রয়েছে হেদায়াতের দায়িত্ব, আর দুনিয়া ও আখেরাতের নিরঙ্কুশ মালিকানা আমারই জন্যে। সুতরাং, আমি তোমাদেরকে স্ফুলিঙ্গে ভরা ডগডগে আগুনের আযাবের ভয় দেখাচ্ছি।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি দাহ্যশক্তিসম্পন্ন।’ (সহীহ বুখারী, হাদীসক্রম : ৩২৬৫) ‘যার সর্বনিম্ম শাস্তি হল, পাপীকে আগুনের জুতো পরিধান করানো হবে; ফলে মাথার মগজ টগবগ করে ফুটতে থাকবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীসক্রম : ১৪১১)

হতভাগা ব্যক্তির ঠিকানা জাহান্নাম :

পরের আয়াতে বলা হয়েছে, “যে নিতান্ত হতভাগা সে-ই তাতে প্রবেশ করবে।” এখানে ‘হতভাগ্য ব্যক্তি’ এর তাফসীর পরের আয়াতে উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।” অর্থাৎ যে নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অস্বীকার করে এবং ঈমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। (তাফসীর মুসায়সসার)

হযরত আবূ হুরাইরাহ রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দুর্ভাগা ছাড়া কেউ জাহান্নামে যাবে না।’ বলা হলো, ‘দুর্ভাগা কে?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যে আনুগত্যপরায়ণ নয় এবং আল্লাহ তাআলার ভয়ে পাপ কাজ হতে বিরত থাকে না।’ (ইবনু মাযাহ, হাদীসক্রম : ৪২৯৮) অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তিই জান্নাতে যাবে তবে যারাابي  বা অবাধ্য তারা ব্যতীত।’ বলা হলো, ‘আবা বা অবাধ্য কারা?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যারা আমার আনুগত্য করে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যারা আমার অবাধ্য তারাই হলো আবা।’ (সহীহ বুখারী, হাদীসক্রম : ৭২৮০)

জাহান্নামে হতভাগা ও দুষ্ট প্রকৃতির লোক ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশ করবে না। অচিরেই জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে ওই সকল মুত্তাকীকে, যারা আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে ক্রীতদাস মুক্ত করে, দান করে অভাবগ্রস্তকে এবং ইত্যাকার জনহিতকর কার্যে।

হযরত আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহু এর মহানুভবতা :

বনী মুসেল গোত্রের এক ক্রীতদাসী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উপরে চালানো হতো চরম নিপীড়ন। হযরত আবু বকর তাঁকে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেন। সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব বর্ণনা করেছেন, হযরত আবু বকর যখন হযরত বেলালকে ক্রয় করতে চাইলেন, তখন উমাইয়া বললো, ‘বিনিময়রূপে দিতে হবে তোমার নাসতাশ নামের ক্রীতদাসটিকে।’ হযরত আবু বকর তখন ছিলেন ধনাঢ্য। তিনি নাসতাশকেও ইসলামের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু নাসতাশ তাতে রাজি হয়নি। শেষে নাসতাশের বিনিময়ে তিনি ক্রয় করলেন হযরত বেলালকে এবং যথারীতি তাঁকে মুক্তও করে দিলেন। তখন অবতীর্ণ হলো পরবর্তী আয়াত- “এবং তার প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদানে নয়।” একথার অর্থ : হযরত আবু বকর হযরত বেলাল ও তাঁর মতো অন্যান্য ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীদেরকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন কেবল আল্লাহর পরিতোষ কামনায়। তাঁদের এমন কোনো অনুগ্রহ তাঁর উপরে ছিল না যে, তিনি এরকম করেছিলেন তার প্রতিদান পরিশোধার্থে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের থেকে বায্যার বর্ণনা করেছেন, আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে হযরত আবু বকর সিদ্দীককে লক্ষ্য করেই। পুরো বাক্যটিই আগের আয়াতের ‘দান করে’ কথাটির অবস্থাপ্রকাশক। অথবা বাক্যটি প্রারম্ভিক, একটি ধারণাপ্রসূত প্রশ্নের জবাব। সেই ধারণাটি হচ্ছে- ক্রীতদাসগণ কি পূর্বে কখনো হযরত আবু বকরের কোনো উপকার করেছিলেন, যার প্রত্যুপকারস্বরূপ তিনি তাদেরকে ক্রয় করে মুক্ত করে দিয়েছিলেন? এমতো প্রশ্নের জবাবেই এখানে বলা হয়েছে, তাঁর প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদানে নয়। বরং তাঁর লক্ষ্য মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অন্বেষণ ব্যতীত কিছুই ছিল না।

মুস্তাদরাক হাকিমে হযরত যুবায়ের রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহু এর অভ্যাস ছিল যে, তিনি কোন মুসলমানকে কাফির মালিকের হাতে বন্দি দেখলে তাকে ক্রয় করে মুক্ত করে দিতেন। এ ধরনের মুসলমান সাধারণত দুর্বল ও শক্তিহীন হত। একদিন তাঁর পিতা হযরত আবু কোহাফা বললেন, ‘তুমি যখন গোলামদেরকে মুক্তই করে দাও, তখন শক্তিশালী ও সাহসী গোলাম দেখে মুক্ত করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে সে শত্রুর হাত থেকে তোমাকে হিফাজত করতে পারে।’ হযরত আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহু বললেন, ‘কোন মুক্ত করা মুসলমান দ্বারা উপকার লাভ করা আমার লক্ষ্য নয়। আমি তো কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই তাদেরকে মুক্ত করি।’ (মাযহারী)

সূরার শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, “আর সে অচিরেই সন্তুষ্টি লাভ করবে।” অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই তার ধন-সম্পদ ব্যয় করেছে এবং পার্থিব উপকার চায়নি, আল্লাহ তাআলাও পরকালে তাকে সন্তুষ্ট করবেন এবং জান্নাতের মহা নিয়ামত তাকে দান করবেন। এই শেষ বাক্যটি হযরত আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহু এর জন্য একটি বিরাট সুসংবাদ। ‘আল্লাহ তাঁকে সন্তুষ্ট করবেন’ এ সংবাদ দুনিয়াতেই তাঁকে শোনানো হয়েছে।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT