তাফসীরে সূরা আ’লা [আয়াত-ক্রম : ৬-১০]

 

سَنُقۡرِئُکَ فَلَا تَنۡسٰۤی

(৬) (হে রাসূল!) আমি আপনাকে অবশ্যই কুরআন পাঠ করাব, এরপর আপনি আর কখনো ভুলবেন না।

اِلَّا مَا شَآءَ اللّٰهُ ؕ اِنَّهٗ یَعۡلَمُ الۡجَهۡرَ وَ مَا یَخۡفٰی

(৭) কিন্তু যা আল্লাহ পাকের ইচ্ছা হয় তা ব্যতীত, নিশ্চয় তিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত।

وَ نُیَسِّرُکَ لِلۡیُسۡرٰی

(৮) আমি আপনার জন্য সহজ বিষয় সহজতর করে দেব।

فَذَکِّرۡ اِنۡ نَّفَعَتِ الذِّکۡرٰی

(৯) (হে রাসূল!) যদি উপদেশ ফলপ্রসূ হয়, তবে আপনি উপদেশ দান করুন।

سَیَذَّکَّرُ مَنۡ یَّخۡشٰی

(১০) যার অন্তরে ভয় আছে সে উপদেশ গ্রহণ করবে।

তাফসীর

সৃষ্টি জগতের এই বিশাল ও বিরাট প্রান্তরকে উন্মোচনকারী এই বিস্তৃত পটভূমির বর্ণনার পর আলোচ্য অংশে কুরআন হেফাজতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।

প্রথমত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর উম্মতের জন্য সেই মহান সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে যে, ‘আমি আপনাকে অবশ্যই কুরআন পাঠ করাব, এরপর আপনি আর কখনো ভুলবেন না।’

সুসংবাদটির সূচনা হচ্ছে এই বলে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই কুরআন স্মরণ রাখার কষ্ট থেকে অব্যাহতি দেবেন। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ হলো আল্লাহর দেয়া ক্ষমতাবলে তিনি পড়বেন, আর প্রতিপালক স্বয়ং যা তাঁকে পড়াবেন তা তিনি ভুলবেন না। এটি এমন একটি সুসংবাদ, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর একান্ত প্রিয় এই সুন্দর মহিমান্বিত কুরআনের ব্যাপারে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করে। কুরআনের প্রতি ভক্তি, আসক্তি ও আগ্রহের আতিশয্যে এবং তার সর্বাত্মক অনুকরণ ও অনুসরণের তাগিদে ও প্রেরণায় তিনি এত ব্যাকুল হয়ে পড়তেন যে, যখনই জিবরাঈল তাঁর কাছে ওহী নিয়ে আসতেন, তখন তিনি বিড়বিড় করে এক একটি আয়াত বারবার উচ্চারণ করতেন এবং জিহ্বা নাড়াতে থাকতেন। কারণ, তা না হলে ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা বোধ করতেন। এরপর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে এই আশ্বাস দেয়া হয় যে, আল্লাহ তাআলা নিজেই তাঁর পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, যাতে তিনি এর একটি অক্ষরও ভুলে না যান। বলা বাহুল্য, এর পর থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর কোনো আয়াত ভুলে যেতেন না।

হযরত আবু মুসা আশআরী রাদি. বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেছেন, ‘কুরআন সংরক্ষণ করো। যিনি আমার জীবনের মালিক, সেই পবিত্রতম সত্তার শপথ করে বলছি, এমন সময় আসবে, যখন ঔদাসীন্যের কারণে কুরআন অতি দ্রুত বেরিয়ে যাবে তোমাদের নাগালের বাইরে, যেমন হাঁটুর বেড়িমুক্ত উট ছুটে পালিয়ে যায় দূরে।’ হযরত ইবনু মাসঊদ রাদি. থেকে বুখারী ও মুসলিম শরীফেও এরকম বর্ণনা এসেছে। হযরত ইবনু উমর রাদি.-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কুরআন সংরক্ষক যেন পায়ে বেড়ি পরানো উট। তার বেড়ি আলগা হলেই সে ছুটে পালায়। হযরত সাদ ইবনু মাসআদ বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করার পর তা ভুলে যায়, সে পুনরুত্থিত হবে কুষ্ঠ রোগী হয়ে। (আবু দাউদ, দারিমী)

প্রসঙ্গত এ কথাও উল্লেখ্য যে, যেখানেই আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো সুদৃঢ় ও অকাট্য প্রতিশ্রম্নতি দেয়া হয় কিংবা কোনো শাশ্বত নীতি ঘোষণা করা হয়, সেখানে সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছু বক্তব্যও দেয়া হয়, যা দ্বারা বুঝানো হয় যে, আল্লাহ তাআলা স্বাধীন ইচ্ছা ও ক্ষমতার মালিক, তিনি কোনো বাধ্যবাধকতার অধীন নন। পরের আয়াতে এ কথারই পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়েছে-‘কিন্তু যা আল্লাহ পাকের ইচ্ছা হয় তা ব্যতীত।’ এ কথার অর্থ হলো, ‘কিন্তু আল্লাহ যদি না চান, তবে তা আপনি স্মৃতিবদ্ধ রাখতে পারবেন না।’ ব্যাখ্যাটি অধিকাংশ মুফাসসিরের ব্যাখ্যার অনুরূপ। কাতাদা রাদি. বলেন, আল্লাহ যা চাইতেন, তা ব্যতীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছুই ভুলতেন না। মোটকথা, আয়াতের মর্ম হলো এই যে, আপনি কুরআনের কোনো অংশই ভুলবেন না। তবে আমি কোনো আয়াত রহিত করে নিলে তা স্মরণ রাখা আপনার দায়িত্ব নয়। এরপর বলা হয়েছে-‘তিনি জানেন, যা প্রকাশ্য এবং যা গোপনীয়।’ অর্থাৎ, ‘হে আমার প্রিয়তম নবী! আমি তো আপনার এবং অন্য সকলের গোপন-প্রকাশ্য ভাবনা, বক্তব্য, কর্ম- সকল কিছু সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আপনি জিবরাঈলের পাঠ শুনে প্রকাশ্যে তা স্মৃতিস্থ করার জন্য যে ব্যগ্রতা প্রকাশ করেন, তা যেমন আমি জানি, তেমনি জানি বিস্মৃতির যে আশঙ্কা আপনি অন্তরে লালন করেন, তা-ও।’

পরের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘আমি আপনাকে সহজ করে দেব সহজ পদ্ধতির জন্য।’ সহজ পদ্ধতি বলে এখানে ইসলামী শরীয়ত বোঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাহ্যত এরূপ বলা সঙ্গত ছিল যে, আমি এ পদ্ধতি ও শরীয়তকে আপনার জন্য সহজ করে দেব। কিন্তু এর পরিবর্তে কুরআন বলেছে, আপনাকে এই শরীয়তের জন্য সহজ করে দেব। এর তাৎপর্য এ কথা ব্যক্ত করা যে, আল্লাহ তাআলা আপনাকে এরূপ করে দেবেন যে, শরীয়ত আপনার মজ্জা ও স্বভাবে পরিণত হবে এবং আপনি তার ছাঁচে গঠিত হয়ে যাবেন।

এরপরের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘যদি উপদেশ ফলপ্রসূ হয়, তবে আপনি উপদেশ দান করুন।’ অর্থাৎ আমি যখন কুরআন ও শরীয়তের দায়িত্ববহন আপনার জন্য সহজ করে দিয়েছি, তখন আপনি এর অনুকূলে মানুষকে সৎপথ প্রদর্শন করুন। দান করুন সদুপদেশ, যদি তা ফলপ্রসূ হয়।

এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ওয়াজ-নসীহত এবং শিক্ষাদানের একটি নীতি ও আদর্শ বর্ণনা করেছেন। ইবনু কাসীর ও ইমাম শাওকানী রহ.-এর নিকট এর অর্থ হলো এই যে, ‘তুমি উপদেশ দাও; যদি উপদেশ ফলপ্রসূ হয় অথবা না হয়।’ কেননা, সতর্কীকরণ ও তবলীগ উভয় অবস্থাতেই তাঁর জন্য জরুরী ছিল।

বলা বাহুল্য, এখানে উদ্দেশ্য শর্ত নয় বরং আদেশকে জোরদার করাই উদ্দেশ্য। আমাদের পরিভাষায় এর দৃষ্টান্ত কাউকে এরূপ বলা যে, যদি তুমি মানুষ হও তবে তোমাকে কাজ করতে হবে। অথবা তুমি যদি অমুকের ছেলে হও তবে এ কাজ করা উচিত।

বারবার উপদেশ দেওয়া সত্ত্বেও কিছুসংখ্যক লোকের সত্যবিমুখতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যাতে নিরাশ না করে, তাই এখানে তাঁকে সান্ত্বনা প্রদানার্থে বলা হয়েছে- উপদেশ দিন, দিতে থাকুন। হয়তো তা এক সময় ফলপ্রসূ হবে। নিরাশ হবেন না।

আবার কতিপয় বিদ্বান বলেছেন, বাহ্যত বাক্যটি শর্তযুক্ত হলেও তিরস্কারার্থক। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তিরস্কার করা হয়েছে সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদেরকেই। একটু পরোক্ষভাবে এ কথাই বলে দেওয়া হয়েছে যে, তারা চিরদুর্ভাগা। তাই শুভউপদেশ তাদের উপরে ফলপ্রসূ হয় না। এ রকমও বলা হয়েছে যে, উপদেশ দিতে হবে তখন, যখন তা ফলপ্রসূ হবে। যেমন : আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তুমি যদি এমন কওমের কাছে কোনো কথা বলো যা তাদের বিবেকে ঢুকবে না, তাহলে সেটা তাদের কারও কারও জন্য বিপদের কারণ হবে। তারপর তিনি বললেন, মানুষ যা চিনে তা-ই শুধু তাদেরকে জানাও, তুমি কি চাও যে লোকেরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর মিথ্যারোপ করুক?

এরপরের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘যে ভয় করে, সে উপদেশ গ্রহণ করবে।’ এ কথার অর্থ হলো- যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, উপদেশ ফলপ্রসূ হবে তার উপরেই। কেননা তারাই উপাদেশাবলির মর্ম বোঝে, এই নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং কর্মসম্পাদন করে তদনুসারে।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT