আয়াত ও তরজমা :
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ
(১) পড়ো (হে নবী), তোমার রবের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন।
خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ
(২) জমাট বাঁধা রক্তের দলা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।
اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ
(৩) পড়ো, এবং তোমার রব বড় মেহেরবান।
الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ
(৪) যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন।
عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ
(৫) মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জানতো না।
সূরার নামকরণ :
علق শব্দের অর্থ- ঝুলন্ত, রক্ত ও রক্তপিণ্ড ইত্যাদি। এই সূরার দ্বিতীয় আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সূরার আমল :
যে ব্যক্তি সূরা আলাক লিপিবদ্ধ করে ভ্রমণকালে সঙ্গে রাখবে, গৃহে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত সে সকল বিপদাপদ থেকে সংরক্ষিত থাকবে।
মূল বক্তব্য :
এ সূরায় পবিত্র কুরআন পাঠ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত সর্বপ্রথম নাযিল হয়। মূর্খতার অন্ধকার দূরীভূত করে জ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আলোচ্য সূরায়। পবিত্র কুরআনের প্রথম কথাই হলো ইকরা বা পড়ো। বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ পাক বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে বিশ্বমানবকে জ্ঞানার্জনের আহ্বান জানিয়েছেন।
তাফসীর :
“পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।”
বিশ্বমানবের জন্য আল্লাহ পাকের তরফ থেকে এটা প্রথম পয়গাম।
পাঠ করুন, জ্ঞানার্জন করুন, জানার চেষ্টা করুন। পাঠ করার নির্দেশের মাধ্যমেই পাঠ করা শুরু হলো, সম্বোধন করা হয়েছে হে নবী! যদিও কোন মানুষের নিকট আপনি পাঠ গ্রহণ করেননি, শেখেননি, তাই আপনি পাঠ করতে অক্ষম, একথা মনে করারও কোন ন্যায্য কারণ নেই। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আপনার যে অসাধারণ প্রতিভা দিয়ে রেখেছেন, তার মাধ্যমেই আপনি পাঠ করতে পারবেন। আল্লাহ পাকই আপনাকে অনেক নেয়ামত সমৃদ্ধ করেছেন, আপনি পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আপনার জীবনকে সার্থক-সুন্দর করবেন। তাঁর নামের বরকতেই আপনার পাঠ করা সহজ হবে। তিনিই আপনাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। আর অসাধারণ গুণে-জ্ঞানে, মহিমায় তিনিই আপনাকে মহিমান্বিত করেছেন। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তিনিই বিশ্ব জগৎকে সৃষ্টি করেছেন।
“যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত দ্বারা।”
যিনি আপনার স্রষ্টা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা, তাঁর কুদরত হেকমত অনন্ত অসীম, তাঁর সৃষ্টি-নৈপুণ্য অতীব বিস্ময়কর, তিনিই শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করেন। আর সেই জমাট রক্তকেই মানুষে পরিণত করেন। মানুষ মাত্রই আল্লাহ পাকের বিস্ময়কর কুদরতের জীবন্ত নিদর্শন। তাই এরশাদ হয়েছে- পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালক অত্যন্ত দয়াবান। তাঁর দয়ামায়ার কোন সীমা নেই। তাঁর করুণার অন্ত নেই। অতএব, আপনার সেই প্রতিপালকের নামেই আপনি পাঠ করুন। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। যিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।
পবিত্র কুরআনের সূরা আলাকের এই পাঁচটি আয়াতই সর্বপ্রথম নাযিল হয়। রমযান মাসের সাতাশ তারিখ মোতাবেক ৬১০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের কোন এক তারিখে হঠাৎ ফেরেশতা-শ্রেষ্ঠ হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত রাসূলে করীম আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আল্লাহ পাকের তরফ থেকে আগমন করে এ আয়াত পৌঁছে দিলেন। এ আয়াতসমূহের মধ্যেই আল্লাহ পাক মানব জাতির অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা বলেছেন। মানব সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনা করেছেন, মানব জাতিকে জ্ঞান অর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে কী লাভ হয় তাও জানিয়ে দিয়েছেন। মহান স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টির সম্পর্কও বিশ্লেষণ করেছেন।
লক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় :
আলোচ্য আয়াতে মানুষকে সৃষ্টির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কেননা মানুষই আশরাফুল মাখলুকাত বা আল্লাহ পাকের অভিজাত সৃষ্টি।
দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে আল্লাহ পাকের মারেফাত লাভের যোগ্যতা নিহিত রয়েছে এবং আল্লাহ পাকের বন্দেগী করার সামর্থ্য রয়েছে, বিশ্ব সৃষ্টির সবকিছু মানুষের কল্যাণার্থেই সৃষ্টি করা হয়েছে।
‘ইকরা’ শব্দটি বারবার ব্যবহার করার তাৎপর্য হলো, বিষয়টির প্রতি অধিকতর গুরুত্বারোপ করা।
অথবা প্রথমবার ‘ইকরা’ বলা হয়েছে হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলার জন্য, আর দ্বিতীয় বার বলা হয়েছে তাওহীদের বাণী প্রচার করার জন্য, অথবা নামাযে এই মহান বাণী পাঠ করার জন্য।
যখন প্রথম ইকরা বলা হয়, তখন হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জবাবে বলেছিলেন-
ما أنا بقار
অর্থাৎ আমি পাঠ করতে জানি না, কীভাবে আমি পাঠ করবো? তখন আল্লাহ পাক দ্বিতীয় বার ইকরা বলে এরশাদ করেছেন, আপনি আল্লাহর নামে পাঠ করুন, অর্থাৎ আপনি বিসমিল্লাহ বলে কুরআনে করীম পাঠ করুন।
“যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।”
আল্লাহ পাকই কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ করার পন্থা শিক্ষা দিয়েছেন, কেননা লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমেই ইলম সংরক্ষিত থাকে। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কলম দ্বারা লিখেছেন, হযরত ইদ্রীস আলাইহিস সালাম। হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক প্রথম কলমকে সৃষ্টি করেছেন। আর ইলম শিক্ষা দেওয়া, মানব জাতিকে শিক্ষিত করে তোলা আল্লাহ পাকের বিশেষ দান। বিশ্ব সভ্যতার প্রথম কথাই হলো শিক্ষা, জ্ঞান-অর্জন। পবিত্র কুরআন বিশ্বগ্রন্থ, বিশ্ব মানবের কল্যাণের প্রতীক। বিশ্ব-সভ্যতায় পবিত্র কুরআনের অবদান সর্বাধিক।
“তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানতো না।” সূরা বাকারায় এরশাদ হয়েছে-
وعَلَّمَ آدَمَ الأَسْمَاءَ
“আল্লাহ আদমকে শিক্ষা দিয়েছেন সব কিছুর নাম, গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য।”
অথবা আয়াতের অর্থ হলো, দয়াবান আল্লাহ পাকের দয়ায় পাঠ করুন, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, আদম আলাইহিস সালাম-সহ সকল নবীকে এমন শিক্ষা দিয়েছেন, যা তারা জানতো না। তিনিই হে রাসূল! আপনাকে পাঠ করা শিক্ষা দেবেন, যদিও আপনি ইতিপূর্বে পাঠ করা জানতেন না। আর ইকরা কথার তাৎপর্য হলো, ইতিপূর্বে যে ইলম সমস্ত নবী রাসূলগণকে দান করা হয়েছিল এবং যে ইলম পরবর্তীতে আসবে, সবই তিনি দান করেছেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে।