তাফসীরে সূরা আত-ত্বীন [আয়াত-ক্রম : ০১-০৮]

আয়াত ও তরজমা :

وَالتِّیۡنِ وَالزَّیۡتُوۡنِ

(১) শপথ আঞ্জির ও যয়তুনের।

وَطُوۡرِ سِیۡنِیۡنَ

(২) এবং সিনাই মরুভূমির (পাহাড়) তূরের।

وَہٰذَا الۡبَلَدِ الۡاَمِیۡنِ

(৩) এবং এই নিরাপদ শহরের।

لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡۤ اَحۡسَنِ تَقۡوِیۡمٍ

(৪) আমি মানুষকে উৎকৃষ্ট ছাঁচে ঢেলে সৃষ্টি করেছি।

ثُمَّ رَدَدۡنٰہُ اَسۡفَلَ سٰفِلِیۡنَ

(৫) অতঃপর আমি তাকে হীনতাগ্রস্তদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা হীনতম অবস্থায় পৌঁছিয়ে দেই।

اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَلَہُمۡ اَجۡرٌ غَیۡرُ مَمۡنُوۡنٍ

(৬) কিন্তু তারা ব্যতীত, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে। তাদের জন্য আছে অনিঃশেষ প্রতিদান।

فَمَا یُکَذِّبُکَ بَعۡدُ بِالدِّیۡنِ

(৭) সুতরাং (হে মানুষ!) এরপর আর কী জিনিস আছে, যা তোমাকে কর্মফল দিবস প্রত্যাখ্যানে উদ্বুদ্ধ করছে?

اَلَیۡسَ اللّٰہُ بِاَحۡکَمِ الۡحٰکِمِیۡنَ

(৮) আল্লাহ কি শাসকবৃন্দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শাসক নন?

মূল বক্তব্য :

আখেরাতের প্রতি ঈমান সুদৃঢ় করা এবং কর্মফল লাভের ব্যাপারে সাবধান থাকার শিক্ষা রয়েছে এ সূরায়। সূরা শুরু হয়েছে আঞ্জির, যয়তুনের বৃক্ষ, সিনাই পর্বত ও মক্কা নগরীর শপথের মাধ্যমে। সিনাই পর্বতে আল্লাহ পাক হযরত মুসা আলাইহিস সালাম-এর সঙ্গে কথা বলে তাঁকে সম্মানিত করেছিলেন, আর মক্কা নগরীতে রয়েছে পবিত্র কা’বা শরীফ। এটি হযরত নবী করীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মভূমি। নগরীর অদূরে হেরা গুহায় সর্বপ্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। মানব জাতির হেদায়াতের কেন্দ্র হিসেবে মক্কা নগরীর গুরুত্ব রয়েছে। এই বরকত ও গুরুত্বের কারণেই মক্কা নগরীর শপথ করে সমগ্র মানবজাতি সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছে আলোচ্য সূরায়।

তফসীর :

وَالتِّیۡنِ وَالزَّیۡتُوۡنِ.  وَطُوۡرِ سِیۡنِیۡنَ

“শপথ আঞ্জির এবং জয়তুনের এবং সিনাই মরুভূমির (পাহাড়) তূরের।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘ত্বীন দ্বারা আঞ্জির ফলকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আর যয়তুন দ্বারা যয়তুন ফলকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।’

ত্বীন বা আঞ্জিরের শপথ করার তাৎপর্য হলো, ত্বীন এর ভেতর কোন দানা থাকে না। আর তা জান্নাতের ফলের অনুরূপ।

আর যয়তুন এমন বরকতময় বৃক্ষ, যার ফল তৈলাক্ত হয়, ঐ তেল মানুষের অনেক উপকারে আসে।

কাতাদা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘ত্বীন সেই পাহাড়, যার উপর দামেশক নগরীটি আবাদ রয়েছে। আর যয়তুন হলো, বায়তুল মোকাদ্দাসের মসজিদ।’

সিনাই পর্বতে আল্লাহ পাক হযরত মুসা আলাইহিস সালাম-এর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, এটি মিশরে অবস্থিত।

আর একরামা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘এটি সেই স্থান, যেখানে তুর পর্বত অবস্থিত।’

কালবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘এর অর্থ বৃক্ষ বিশিষ্ট পর্বত।’

وَهَذَا الْبَلَدِ الْأَمِينِ

“এবং শপথ এই নিরাপদ নগরীর।”

নিরাপদ শহর বলতে মক্কা মুকাররমাকে বোঝানো হয়েছে। জাহেলি ও ইসলামী সর্বযুগেই এ স্থানটি নিরাপদ ও অত্যন্ত বরকতময় ছিল, আছে এবং থাকবে।

لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقُولُو

“নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে।”

অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহ সুন্দরতম আকৃতি-প্রকৃতি দান করেছেন। বাহ্যিক ও আন্তরিক শক্তি-সৌন্দর্য দান করেছেন। মানুষকে অসাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি এবং ধী-শক্তি দান করেছেন।

কোন কোন তফসীরকার বলেছেন, (احسن تقویم) বাক্য দ্বারা মানুষের আকৃতি ও গঠনের সৌন্দর্যকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

যারা ঈমান আনেনি, তারা দুনিয়ায় যত সুন্দর ও সুশ্রীই হোক, আখেরাতে তারা চরম কদর্য অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

অধিকাংশ তাফসীরবিদের মতে বার্ধক্যে প্রতিটি মানুষ হীন ও শ্রীহীন হয়ে পড়ে। রূপ-লাবণ্য, শক্তি-সামর্থ্যও খতম হয়ে যায়। আর কাফেরগণ পরবর্তীতে এসব ফিরে পাবার আশা থাকে না। কেননা তারা তো আখেরাতকে বিশ্বাসই করে না।

কিন্তু মুসলিমগণ বিশ্বাস করেন, বৃদ্ধকালের এই জীর্ণদশা সম্পূর্ণ সাময়িক। কেননা মৃত্যুর পর দ্বিতীয় জীবনে ইনশাআল্লাহ দুনিয়ার রূপ ও সৌন্দর্য অপেক্ষা আরও অনেক ভালো রূপ ও সৌন্দর্য ও অনেক উৎকৃষ্ট নি‘আমত লাভ করবে। এই অনুভূতির কারণে মুমিনদের বার্ধক্যের কষ্টও অনেক হালকা হয়ে যায়।

ثُمَّ رَدَدْنَهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ

“এরপর আমি তাকে ফেলে দিয়েছি নীচ থেকে নীচে।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘মানুষকে প্রথমত যৌবন, শক্তি-সামর্থ্য সবই দান করা হয়। কিন্তু শেষ বয়সে সে চরম দুর্বল হয়ে যায়। তার সকল শক্তি লোপ পায়। নিজ শক্তিতে চলাফেরা করাও সম্ভব হয় না।

মানুষ জন্মের পর যেমন দুর্বল হয়ে থাকে, মৃত্যুর পূর্বেও ক্ষেত্র বিশেষে দূর্বল হয়ে পড়ে।

তাফসীরকারক হযরত হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘এর অর্থ হল, মানুষ যখন অনন্ত-অসীম নেয়ামত লাভের পরও অকৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ পাকের প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের অপব্যবহার করে, যেমন খুশি তেমন জীবন-যাপন করে, কুফর-শিরক নাফরমানীসহ সর্বপ্রকার পাপাচারে লিপ্ত হয়, তখন আল্লাহ পাক মানুষকে সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরে তথা দোজখের নিম্নস্তরে পৌঁছিয়ে দেন। মানুষ যখন মানবতার অমর্যাদা করে, তখন সে অবনতি, অধঃপতনের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে যায়।’

إِلَّا الَّذِينَ امَنُوا وَ عَمِلُوا الصَّلِحَتِ فَلَهُمْ أَجْرُ غَيْرُ مَمْنُونٍ

“তবে যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে তাদের জন্যে রয়েছে অন্তহীন সওয়াব।”

অর্থাৎ যারা আল্লাহ পাকের প্রতি ঈমান এনে পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে এবং প্রিয়নবী হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনে এবং তাঁর পরিপূর্ণ অনুসরণ করে, তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত সওয়াব। যদি এমন মুমিন বৃদ্ধ বা অসুস্থ হয়ে নেক আমল করতে অপারগ হয়ে যায়, তবুও তার জন্য নেক আমলের সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়।

হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘যখন কোন মুসলমান শারীরিকভাবে কোন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তখন আল্লাহ পাক ফেরেশতাদেরকে আদেশ দেন, তার জন্য এখনও সেই নেক আমলের সওয়াব লিপিবদ্ধ কর, যা সে সুস্থ অবস্থায় করতো।

فَمَا يُكَذِّبُكَ بَعْدُ بِالدِّينِ

“এরপর কোন বস্তু তোমাকে কেয়ামত সম্পর্কে অবিশ্বাসী করে?”

মানুষ প্রতিনিয়ত আল্লাহ পাকের অনন্ত অসীম নেয়ামত ভোগ করছে। আল্লাহ পাকের অসীম কুদরত ও হেকমত প্রত্যক্ষ করছে। এমনকি নিজের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রত্যেকেই উপলব্ধি করতে পারে যে, আমি ইতিপূর্বে এ পৃথিবীতে ছিলাম না, আল্লাহ পাকই আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমি দুর্বল ছিলাম, আল্লাহ পাকই আমাকে শক্তি দান করেছেন, আমার কিছুই ছিল না, সবই আল্লাহ পাক আমাকে দান করেছেন, আর কিছুদিন পর আল্লাহর হুকুমেই আমাকে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। এমন অবস্থায় মানুষ কি আখেরাতকে অবিশ্বাস করতে পারে? সে কি পরকালীন জীবন সম্পর্কে গাফেল হতে পারে? কোন জিনিস তাকে এমন সত্যকে অস্বীকার করার জন্যে প্রস্তুত করবে?

أَلَيْسَ اللهُ بِأَحْكَمِ الْحَكِمِينَ

“আল্লাহ পাকই কি সকল বিচারকদের থেকে শ্রেষ্ঠ বিচারক নন।”

যিনি মানুষকে শূন্যের কোঠা থেকে এনে অস্তিত্ব দান করেছেন, স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য দান করেছেন, দুনিয়া আখেরাতের কর্তৃত্ব তাঁরই, তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাজাধিরাজ, আর তিনিই আখেরাতে মানুষকে ঈমান ও নেক আমলের জন্য পুরস্কার দান করবেন এবং অবিশ্বাস ও অকৃতজ্ঞতার জন্য শাস্তি দেবেন। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক-আল্লাহ পাক। অতএব, তাঁর প্রতি ঈমান আনা এবং পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করাই কল্যাণকামী মানুষের একান্ত কর্তব্য।

এর আরেক অর্থ হতে পারে ‘আল্লাহ কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক নন?’ অর্থাৎ জ্ঞান ও শক্তিতে পরিপূর্ণ হওয়ার কারণে অপরাধের শাস্তিবিধান ও পারস্পরিক বিরোধের মীমাংসায় আল্লাহ তাআলাই শ্রেষ্ঠতম ন্যায়বিচারক। দুনিয়ায়ও তিনি কারও প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করেন না এবং আখিরাতের মহাবিচার দিবসেও তার পক্ষ হতে কোনও রকম জুলুমের আশঙ্কা নেই।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT