বৈচিত্র্যের মাঝেও ঐকতান রাখা পূর্বসূরিদের বৈশিষ্ট্য
একতাবদ্ধ থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। বৈচিত্র্য ও স্বাভাবিক এখতেলাফ থাকাটা দোষনীয় নয়, সবযুগেই ছিল, কিন্তু তা যেন উম্মতের মধ্যে বিভক্তি টেনে না আনে, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের পূর্বসূরি- সাহাবায়ে কেরাম থেকে নিয়ে একদম নিকট-অতীতের বুযুর্গ আকাবিরগণ, তাঁদের জীবনী তালাশ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল, কিন্তু এ মতানৈক্য তাঁদের মধ্যে প্রতিহিংসামূলক কোনো বিভক্তি তৈরি করেনি। বরং পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তাঁরা বজায় রাখতেন।
উম্মত যাতে ঐক্যবদ্ধ থাকে, ফিতনা ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে তারা যাতে আটকে না পড়ে, সে ব্যাপারে আমাদের আকাবিরদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। হযরত উসমান গনী রাযিয়াল্লাহু আনহু, ইসলামের তৃতীয় খলীফা, তিনি ফিতনা ও বিভ্রান্তি থেকে উম্মতকে রক্ষা করার জন্য কুরআনের সাত কেরাতের (পঠনপদ্ধতি) ছয়টিই বাদ দিয়েছিলেন এবং কেবল কুরাইশী কেরাতে সবাইকে তিলাওয়াত করার জন্য ফরমান জারি করেছিলেন।
সাহাবায়ে কেরামের যুগে আকীদার ব্যাপারে কোনো ধরনের মতবিরোধ ছিল না। আমলী কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে তা সুন্দরভাবে সমাধান করা হতো।
পরবর্তী যুগসমূহে- তাবিয়ীন, তবে তাবিয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনগণও মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে এ পন্থা অবলম্বন করেছেন। সমাধানে পৌঁছতে না পারলেও অনৈক্য ও প্রতিহিংসামূলক আচরণ এড়িয়ে গেছেন। নিজেদের মতের ওপর অটল থাকলেও কুরআন-হাদীস-সমর্থিত ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েছেন। ফলে তাঁদের ইখতেলাফ আক্ষরিক অর্থেই রহমত হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া তাঁদের এসব ইখতেলাফের পেছনে মুসলিম উম্মাহর নানাবিধ কল্যাণও নিহিত থাকত। ইখতেলাফের এ সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়েই আকাবির-আসলাফদের মধ্যে এ কথাটি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল যে- ‘উলামায়ে কেরামের মতানৈক্যে রহমত রয়েছে।’
কোনো কোনো তাবিয়ী বলেছেন- ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের এমন দেখিনি যে, তাঁরা ইখতেলাফ করেছেন আর তাতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত হয়নি।’
এটা ছিল আকাবির-আসলাফের ইখতেলাফের সৌন্দর্য।
ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম শাফিয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর মধ্যে অনেক মাসআলায় ইখতেলাফ আছে। যেমন কেরাতে ফাতিহা খালফাল ইমাম। ইমামের পেছনে মুক্তাদী সূরা ফাতিহা পড়বে কি না। আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর মাযহাব হলো, পড়তে পারবে না। আর শাফিয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর মাযহাব হলো, মুক্তাদীর জন্যও সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব। নইলে নামাযই হবে না।
এত কঠিন মতানৈক্য থাকার পরও তাঁদের মধ্যে আদব ও মুহাব্বাতের দৃশ্য কেমন ছিল দেখুন! ইমাম শাফিয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন ইমাম আযম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর মাকবারা যিয়ারতের জন্য ওই এলাকায় যেতেন, তখন ফজরের নামাযে দুআ কুনুতের আমল আনতেন না। অথচ শাফিয়ী মাযহাব অনুযায়ী ফজরে দুআ কুনুতের আমল করতে হয়।
আজ সমাজ ধ্বংসের দিকে পতিত হয়েছে ইখতেলাফের এই সৌন্দর্যের অনুপস্থিতি এবং উম্মাহর মধ্যে বিভক্তির ফলশ্রুতিতে। সুতরাং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর মহান সাহাবীদের প্রকৃত অনুসরণ যাঁরা করতে চান, অবশ্যই তাঁদেরকে ফিরকাবন্দী মানসিকতা ত্যাগ করে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা নিয়ে আলমে আজসাদ তথা দুনিয়ার এই যিন্দেগী যাপন করতে হবে।
আম্বিয়ায়ে কেরামের সকলেই সুসংহত ও সংঘবদ্ধ জীবনের দাওয়াত দিয়ে গেছেন। সূরা আলে ইমরানে ইরশাদ হয়েছে—“তোমরা আল্লাহ তাআলার রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো, আর দলাদলি করো না।”[1]
মুসলিম শরীফের এক হাদীসে এসেছে, নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান, আল্লাহ তাআলা তিনটি আমলে খুশি হন আর তিনটি আমলে অসন্তুষ্ট হন।
যে তিনটি আমলে খুশি হন, তা হলো, ১. এক আল্লাহর ইবাদাত করো, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। ২. আল্লাহ পাকের রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুন্দরভাবে আঁকড়ে ধরো, পরস্পর দলাদলি করো না। ৩. মুসলমান রাষ্ট্রনায়কের কল্যাণ কামনা করো।
যে তিনটি আমলে আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হন, তা হলো, ১. অহেতুক কথাবার্তা বলা। ২. অধিক হারে অনর্থক প্রশ্ন করা। ৩. অর্থসম্পদের অপচয় করা।
আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর পূর্বে আমার আব্বাজান হযরত বর্ণভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বড় আবেগমাখা সুরে মিনতি করে বলতেন যে, ‘ভাই সকল! আমরা সবাই দলাদলি ভুলে যাই, ছেড়ে দিই। ওহে আহলে তৌহিদ! আসো, এক হও এক হও!’
১৯৯৪ ইংরেজির ১৪ আগস্ট ইসলামী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সিলেট রেজিস্টারি মাঠে ঐতিহাসিক এক সমাবেশ হয়েছিল। তসলিমা নাসরিন ও এনজিওদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নিমিত্তে ছিল এই মজমা। এই মজমা এবং পরিষদ ছিল আমাদের ঐক্যের একটি নমুনা। পরিষদের উপদেষ্টা ছিলেন কায়িদে উলামা হযরত কৌড়িয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, সভাপতি ছিলেন ছাহেব কিবলা হযরত ফুলতলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, আর সেক্রেটারি ছিলেন প্রিন্সিপাল হযরত হাবীবুর রহমান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তাঁদের সকলেই আজ পরকালের বাসিন্দা, আল্লাহ তাআলা এই বুযুর্গদের মরতবা বুলন্দ করে দিন। আমীন।
ঐতিহাসিক সেই সমাবেশে অধমেরও হাজিরা দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেদিন আমি আমার বয়ানে হাজার হাজার জনতার সম্মুখে আব্বাজান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর কালজয়ী কবিতা প্রাণভরে আবৃত্তি করেছিলাম এবং মুসলমানদের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও স্বার্থকতার বৃত্তান্ত তুলে ধরে সবাইকে সেদিনকার মতো একতাবদ্ধ থাকার আরজ করেছিলাম।
আব্বাজানের সেই কবিতাটি হলো—
মতভেদ আর দলাদলি
পায়ের নিচে দিবো ফেলি
মধুর তানে তান ধরিব- ইল্লাল্লাহর আযান।
পাগল হয়ে নামব মোরা
করব পাগল বিশ্ব সারা
জানাই দিব জগৎটাকে- আমরা মুসলমান।।
হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না, বেশকম থাকে, কিন্তু খাবারের সময় সবগুলো একসাথে কাজ করে। সবগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই আমাদের মুখে খাবার ওঠে। অনুরূপ আমাদের মধ্যে টুকিটাকি মতানৈক্য থাকবে, সবাই যার যার মাযহাব-মানহাজ নিয়ে সুন্দরভাবে সহাবস্থান করব, আর ইসলামের বৃহৎ স্বার্থ যখন সামনে চলে আসবে, সমস্ত দলমত পেছনে ফেলে আমরা সবাই একতাবদ্ধ হয়ে দাঁড়াব। তখন আমরা হয়ে উঠব সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়। যত বড় বাধাই আসুক না কেন, আমাদের পরাজিত করা কারো পক্ষে সম্ভব হবে না, ইনশাআল্লাহ।
[1] সূরা আলে ইমরান : ১০৩