ঐক্য হলো তাকওয়ার বলিষ্ঠ প্রতীক
আল্লাহ পাকের ভয় সকল আমলের মূল উৎস এবং মন্দ আচরণ থেকে আত্মরক্ষার মূল উপকরণ। পক্ষান্তরে আল্লাহ পাকের ভয় (তাকওয়া) না থাকলে আলমে আজসাদ বা দুনিয়ার জগতের জীবনসাধনা ব্যর্থ হয়।
ঐক্য হলো তাকওয়ার বলিষ্ঠ প্রতীক আর এই ঐক্য স্থায়িত্ব পায় তাআউন তথা পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে।
স্মরণ রাখা দরকার, কোনো জাতির ধ্বংসের সর্বপ্রধান কারণ হলো অনৈক্য। সুতরাং মতভেদ-মতানৈক্য পায়ে ফেলে একতাবদ্ধ হওয়া একান্ত জরুরি। নফস ও কুপ্রবৃত্তির ধোঁকায় পড়ে ইখতিলাফে জড়ানো উভয় পক্ষের জন্যই হারাম। এ রকম ইখতিলাফ ছেড়ে দেওয়া ওয়াজিব।
হ্যাঁ, মনুষ্য চিন্তার বৈচিত্র্যের জায়গা থেকে মতভেদ থাকাটা স্বাভাবিক, তবে এ ধরনের মতভেদে উভয় পক্ষের নিয়ত থাকতে হবে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন। নিয়তে যদি পরিশুদ্ধি ও আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য থাকে তবে তা রহমত বলে গণ্য হবে।
দুঃখের বিষয়, আজ ইখতিলাফ ও মতানৈক্য আমাদের ঘাড়ে এমনভাবে চেপে বসেছে যে, এ থেকে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে। সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা। এ ধরনের ইখতিলাফে আল্লাহ পাকের অসন্তুষ্টি এবং পরকালীন বরবাদী নিহিত। এই বিভক্তি ও অনৈক্য থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ইখতিলাফ সৃষ্টির পেছনে দুই কারণ—
১. হুব্বে জাহ বা নেতৃত্ব ও সম্মানের মোহ।
২. হুব্বে মাল বা ধনসম্পদের মোহ।
এ বড় দুই রোগই মানুষকে অনৈক্যের দিকে নিয়ে যায়। হাদীস শরীফে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যদি দুটি চিতা বাঘ বকরির পালের উপর আক্রমণ করে, তা এতটা ক্ষতি সাধন করে না, ধনসম্পদ ও নেতৃত্ব-মর্যাদার মোহ মুসলমানের দ্বীন-ঈমানের যতটা ক্ষতি সাধন করে।
হুব্বে জাহ তথা নেতৃত্ব-সম্মানের মোহ এবং হুব্বে মাল তথা ধনসম্পদের মোহ থেকে যদি নিজের হৃদয়কে বাঁচিয়ে না রাখতে পারি, তাহলে এই মোহই আমাকে অনৈক্যের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে। একত্ববাদ ও দ্বীনের মূলনীতিসমূহে ইখতিলাফ সৃষ্টির ইন্ধন জোগাবে। বিদ্বেষপূর্ণ অনৈক্য তৈরি করবে।
আল্লাহ তাআলা চাইলে এ ধরনের মতভেদ চিরদিনের জন্য নিঃশেষ করে দিতে পারেন, কিন্তু এটা তাঁর রীতি নয়। তিনি আমাদেরকে আলমে আজসাদে পাঠিয়েছেন, এটা পরীক্ষার হল। এখানে তিনি আমাদেরকে সুযোগ দিচ্ছেন, দেখছেন তাঁর বিধান আমরা কতটা সফলতার সঙ্গে পালন করি। সুতরাং ইখতিলাফে না জড়িয়ে আমাদের কর্তব্য হলে দ্বীনের ব্যাপারে একতাবদ্ধ হবার জন্য সবাইকে আহ্বান করা।
সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান—
“আর তোমরা সেই সকল লোকের (অর্থাৎ ইহুদী ও নাসারার) মতো হয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি আসার পরও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং আপসে মতভেদ সৃষ্টি করেছিল।”[1]
মুফাসসিরীনে কেরামের মতে এই আয়াতে ইহুদী ও নাসারাদের ইখতিলাফ ও মতবিরোধের কথা বলা হয়েছে। ইহুদীরা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম-এর ইন্তেকালের ৫০০ বছর পরে আর নাসারা বা খ্রিষ্টানরা হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর ইন্তেকালের ৩০ বছর পরে ধর্ম সম্বন্ধে মতবিরোধ ও ইখতিলাফে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের মধ্যে নানা দল উপদল সৃষ্টি হতে থাকে। এভাবে তারা ৭২টি দলে পরিণত হয়।
সূরা শূরায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান—
“তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে অনৈক্য সৃষ্টি করবে না।”[2]
একই সূরার পরবর্তী আয়াতে মুতাবাররাকায় আল্লাহ তাআলা ফরমান—
“তাদের কাছে জ্ঞান আসার পরই তারা পারস্পরিক বিভেদের কারণে মতভেদ করেছে।”[3]
এই আয়াতে মুতাবাররাকা থেকে আমরা এ নির্দেশনা ও উপলব্ধিটুকুই পেলাম যে, দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দ্বীনের ব্যাপারে কোনো বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে না। যারা ইতিপূর্বে দ্বীনের ব্যাপারে বিভেদ সৃষ্টি করেছে তাদের বিষয়ে নিন্দাবাদ করা হয়েছে।
তবে হ্যাঁ, শুরুতেই আমরা বলে এসেছি, প্রত্যেক মানুষেরই স্বতন্ত্র চিন্তাশক্তি রয়েছে, চিন্তার এই স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্যের জায়গা থেকে একজনের সঙ্গে আরেকজনের মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। এই মতপার্থক্যকে আপন জায়গায় অক্ষুণ্ণ রেখেও দ্বীন ও তাওহীদের ভিত্তিতে একতাবদ্ধ থাকা জরুরি। উলামায়ে উম্মত যেটাকে বলেন ইত্তেফাক মাআল ইখতিলাফ। বৈচিত্র্য সহকারে ঐক্য।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান— ‘যে ব্যক্তি (মুসলমানদের) জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল, সে ইসলামের রজ্জু তার গর্দান থেকে খুলে ফেলল।’[4]
অন্য হাদীসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘জামাতের উপর আল্লাহ তাআলার সাহায্য রয়েছে।’[5]
সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান—
“আর তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না (অর্থাৎ পরস্পর দলাদলি করো না)।”[6]
দ্বীনের ব্যাপারে মতভেদ আর শারীরিক বিচ্ছেদ— কোনোটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদায় নেই। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে— ‘জামাত তথা একতাবদ্ধতায় রহমত আর দলাদলিতে আযাব রয়েছে।’
সুতরাং ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। সবসময় সর্বাবস্থায় দ্বীনি কাজে আমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে। হ্যাঁ, দ্বীনের শাখাগত মাসআলায় পূর্বসূরি উলামায়ে কেরামের মতানৈক্য রয়েছে, তবে দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে তাঁরা সকলেই ছিলেন একমত।
[1] সূরা আলে ইমরান : ১০৫
[2] সূরা শূরা : ১৩
[3] সূরা শূরা : ১৪
[4] আবু দাউদ : ৪৭৫৮
[5] তিরমিযী : ২১৬৬
[6] সূরা আলে ইমরান : ১০৩