এটি সত্য যে, মন খুলে হাসতে অক্ষম মানুষই প্রকৃত দুঃখী মানুষ। হাসি এক আনন্দ, এক পরিত্রাণ, এক অমোঘ হাতিয়ার। যা দিয়ে নিজেকে যেমন ¯িœগ্ধ করা যায়, তেমনি অন্যকে। হাসি দিয়ে পরিবার, সমাজ এমনকি বিশ্বকে দেওয়া যায় চমৎকার বার্তা। হাসি তাই নিজেকে ও পৃথিবীকে সুখী করবার এক হাতিয়ার।
হাসি নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। বিজ্ঞানী রবার্ট প্রোভাইন এ বিষয়ক অন্যতম এক গবেষক। বাল্টিমোরের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে ১ হাজার ২০০ লোকের ওপর জরিপ চালান। তাঁরা উদ্ঘাটন করতে চাইছিলেন কেন হাসে মানুষ? লোকেরা ভাবত মজা পেলেই মানুষ হাসে। কিন্তু মাত্র ১০ থেকে ২০ ভাগ মানুষ হাসে মজাদার কিছু দেখে বা শুনে। কিন্তু সাধারণ কথাবার্তা বলার সময় হাসে ৫০ ভাগের অধিক মানুষ।
এই হাসি অধিকতর সহজাত, স্বাভাবিক এবং উপকারের বিচারে সহজাত এই হাসি অগ্রগণ্য। কথাবার্তায় যে হাসি সহজে আসে, সে হচ্ছে মুচকি হাসি। সুস্থ মন ও মানসের জন্য এর উপকারিতা সর্বোচ্চ। সামাজিক ও বৃহত্তর জীবনের জন্য এ উপকার অধিক ফলপ্রসূ! এ হাসি অন্য যে কোনো হাসির চেয়ে শুদ্ধতর।
আমরা যে হাসি, এর সাথে রয়েছে মস্তিষ্কের ডোপামিন রিওয়ার্ড সার্কিটের যোগাযোগ। হাসির মাধ্যমে এতে নিরাপত্তা ও ভালো লাগার অনুভব তৈরি হয়। স্নিগ্ধতা ও আন্তরিকতার আশ্বাস নিহিত থাকে হাসির ভেতর। কিন্তু কিছু হাসি ভয় ধরিয়ে দেয়, কিছু হাসি উপহাসের, কিছু হাসি তাচ্ছিল্য এবং বিদ্রƒপের, কিছু হাসি দম্ভের, কিছু হাসি কামুকের। হাসির মাধ্যমে নানাভাবে প্রকাশ করা যায় বিকৃত মানসিকতা। মনের অন্ধকার। নার্ভাস হাসিও রয়েছে। যা দুর্বলতা ও চাপের পরিস্থিতি বুঝিয়ে দেয়। রয়েছে নকল হাসিও। হৃদয়ের সাথে যার কোনো সংযোগ থাকে না। এই হাসি ধরা পড়ে যায় অচিরেই। বিজ্ঞান জানায়,এমন হাসির সময় চোখের কোনের পেশি কুঞ্চিত হয় না। ফলে একে সনাক্ত করা যায়।
কিন্তু সহজাত মুচকি হাসি কেবল সত্যিকার হাসির বৈশিষ্ট্যই লালন করে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হয় হাসির বহুমাত্রিক উপকারিতাও! বিজ্ঞানের ভাষায় আসল হাসিকে বলে ‘ডাচিনি স্মাইল’।
আসল হাসি রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দিতে কাজ করে। ইনফেকশনের বিরুদ্ধে হাসি নিজেই এক প্রতিষেধক। হাসির মাধ্যমে বৃদ্ধি হয় অ্যান্টি-বডি তৈরির পরিমাণ, যা শরীরে রোগপ্রতিরোধ-দক্ষতা বাড়ায়। বিভিন্ন ধরনের ফ্লু থেকে শরীরকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে হাসি; কফ এবং ঠান্ডা প্রতিরোধে করে সহায়তা। যেসব হরমোন মানসিক চাপ বাড়ায়, উদ্বেগ তৈরি করে, সেগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে চমৎকার একটি হাসি।
হাসি শিশুদের দেয় নিরাপত্তা ও মমতার বোধ। হৃদয়ের অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করে সবচেয়ে বেশি দক্ষতার সাথে। প্রেমকে, মমতাকে, বাৎসল্যকে, ক্ষমাকে, প্রশ্রয়কে, সান্ত¡নাকে হাসি যেভাবে প্রকাশ করে, আর কে পারে সেভাবে প্রকাশ করতে? হাসি কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেই শব্দের চেয়ে বেশি কথা বলে দেয়। এর মাধ্যমে প্রভাবিত হয় সমাজ, মানবমন। এমনকি অন্যদের আচরণ। শুধু মানুষ নয়, কোনো কোনো প্রাণীও প্রভাবিত হয় হাসির মাধ্যমে।
আটলান্টার জর্জিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী মাইকেল ওয়েন গবেষণা করেন হাসির প্রভাব নিয়ে। তিনি দেখান, হাসি কীভাবে অন্যজনের মন ও আচরণকে বদলে দিতে ভ‚মিকা রাখে। তাঁর মতে হাসি হলো সূ² ইঙ্গিত মাস্টার। এটা ব্যবহার করে চারপাশকে নিজেদের কাজে লাগানো যায়, ইচ্ছের অনুক‚লে নিয়ে আসা যায়। ব্যক্তিত্বকে এর দ্বারা প্রভাবশালী করা যায়।
এ ক্ষেত্রে যে হাসি অধিকতর প্রভাবশালী, সেই হাসি হলো মুচকি হাসি। ইসলামের ভাষায় যাকে বলে তাবাসসুম।
এই হাসিতে আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে। কিন্তু দাঁত দেখা যায় না। একে বলা যেতে পারে হাসির প্রথম স্তর। এরপরে হাসির যে স্তর, সেটা হলো দ্বিহক। এতে চেহারায় আনন্দের ছাপ প্রকাশের পাশাপাশি দাঁতও দেখা যেতে পারে। তবে কোনো আওয়াজ হয় না। এরপরের স্তর হলো কহকহা; তীব্র ও জোর আওয়াজে হাসা। ইসলামে এভাবে হাসা নিষিদ্ধ।
নবী-রাসূলরা সাধারণত মুচকি হাসতেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাঁর কথা শুনে সুলাইমান মুচকি হাসল এবং বলল, হে আমার পালনকর্তা, আপনি আমাকে সামর্থ্য দিন, যাতে আমি আপনার সেই নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, যা আপনি আমাকে ও আমার মাতা-পিতাকে দান করেছেন এবং যাতে আমি আপনার পছন্দনীয় সৎকর্ম করতে পারি এবং আমাকে নিজ অনুগ্রহে আপনার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। (সূরা : নামল, আয়াতক্রম : ১৯)
জারির রাদি. বলেন, আমি যখন ইসলাম গ্রহণ করেছি, তখন থেকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে তাঁর কাছে প্রবেশ করতে বাধা দেননি এবং যখনই তিনি আমার চেহারার দিকে তাকাতেন তখন তিনি মুচকি হাসতেন। (বুখারী শরীফ, হাদিসক্রম : ৩০৩৫)
এতে বোঝা যায়, মুচকি হাসা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। কখনো এই হাসিতে (আওয়াজ ছাড়া) দাঁত প্রকাশ পেলেও কোনো সমস্যা নেই।
মুচকি হাসিকে ইসলামে ভালো কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আবু যর গিফারী রাদি. বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেন, “কোনো ভালো কাজকে তুচ্ছ মনে করো না, যদিও তা তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করার কাজ হয়।”’ (মুসলিম শরীফ, হাদীসক্রম : ৬৫৮৪)
আর ইসলামের দৃষ্টিতে যেহেতু সব ভালো কাজ সাদাকাস্বরূপ, তাই মুচকি হাসিকে সদকা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মানুষ যখন কারো সাক্ষাতে মুচকি হাসি দেবে, তখন তার আমলনামায় সাদাকার সওয়াব লেখা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমার ভাইয়ের (সাক্ষাতে) মুচকি হাসাও একটি সাদাকা।’ (তিরমিযী শরীফ, হাদীসক্রম : ১৯৫৬)
বিজ্ঞান বলছে, বাস্তব প্রয়োজনে ও সুস্থতার দাবিতে হাসতে হবে আপনাকে। প্রতিদিন কম করে হলেও হাসা লাগবেই। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত লোমালিন্ডা ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল ইমিউনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. লোরেন্স বার্ক হাসি নিয়ে করেন ব্যাপক গবেষণা।
তিনি লিখেন, হাসি মানুষের উদ্বেগ বাড়ানো হরমোনের ‘করটিসোল’ নিঃসরণ কমায় যা মানুষকে উদ্বেগমুক্ত করে। রক্তে রোগপ্রতিরাধ-ক্ষমতা বাড়াতে নির্মল হাসির জুড়ি নাই।’ যারা মোটেও হাসতে অভ্যস্ত নয়, তারা একধরনের অসুস্থতার শিকার। তাদেরকে তিনি জানাচ্ছেন, ‘অন্তত প্রতি ঘণ্টায় ১৫ সেকেন্ড অর্থাৎ দিনে ৬ মিনিট করে হাসুন। এতে আপনার বুক, কাঁধের মাংসপেশী সঙ্কুচিত-প্রসারিত হবে এবং থাকবে নিরুদ্বিগ্ন ও প্রফুল্ল। আর এই হাসি সাহায্য করবে আপনার জীবনীশক্তি বৃদ্ধিতেও।’
যেসব ব্যক্তি বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশনে ভোগেন তাদের জন্য হাসি শ্রেষ্ঠতম ওষুধ। হাসি মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা দূর করে; উদ্বেগ ও বিরক্তি ভাব দূর করে।
যাঁরা নিয়মিত হাসেন, তাঁদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। হার্টের পেশি শক্তিশালী হয় এবং এর কার্যক্রম ভালোভাবে চলে। প্রতিদিন ১৫ মিনিটের হাসি ৩০ মিনিট ব্যায়ামের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। হার্টকে ভালো রাখতে যা কাজ করে বিশেষভাবে।
মাত্র ১৫ মিনিটের হাসি ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা ১০ গুণ বাড়িয়ে দেয়। এটি মস্তিষ্কের ভালো অনুভ‚তি তৈরিকারী হরমোনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এতে সাময়িকভাবে ব্যথা দূর হয়।
হাসি ফুসফুসে বেশি বাতাস প্রবেশ করতে সাহায্য করে। এটি গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মতোই কার্যকরী। যাঁদের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, বিশেষ করে অ্যাজমা রয়েছে তাঁদের জন্য হাসি একটি থেরাপি, যা খুবই উপকারী। হৃদস্পন্দনের কার্যক্রম ভালো রাখতে সাহায্য করে হাসি এবং বিপাক ক্রিয়াকে ভালো রাখে। তাই বিজ্ঞানীদের পরামর্শ, ওজন ঠিক রাখতে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অন্তত ২০ মিনিট হাসুন।
নবীজির সুন্নাহ হাসির মধ্যে কল্যাণের যে বিশাল আয়োজনের জানান দিয়েছে আমাদের, সর্বাধুনিক বিজ্ঞান তারই যেন ব্যাখ্যা করছে ইহজাগতিক ভাষায়। কারণ, পরজাগতিক কল্যাণ কীসে হবে এবং কীভাবে হবে, বিজ্ঞানের তা জানা নেই। ফলে মুচকি হাসির উপকারের ইহজাগতিক দিকটাই বয়ান করতে পারে সে। সামগ্রিক কল্যাণ কত বেশি, তার স্বরূপ প্রস্ফুটিত হয়েছে নবীজীর সুন্নাহ ও হাদীসে!
এতএব মুচকি হাসুন। এ হাসি একমাত্র তখনই থামবে, যখন সেটা অন্যকে দুঃখ দিতে পারে। কিন্তু সুন্নাহসম্মত হাসি সবসময় সুখের। কী নিজের জন্য, কী অন্যের জন্য।
লেখক : কবি, গবেষক, দর্শনবিশ্লেষক