হাদীসে জিবরাঈল (৩য় পর্ব)

তাকদীর মূলত কী?

হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহিমাহুল্লাহ এত সহজ ভাষায় তাকদীরের বিষয়টি বুঝিয়েছেন যে, সম্ভবত এর চেয়ে আর কোনো সহজ ভাষা নেই। তিনি বলেন, ‘বস্তুত তাকদীর হলো আল্লাহ তাআলার জ্ঞানের নাম; তাঁর নির্দেশের নাম তাকদীর নয়।’ আমি মনে করি, আল্লাহর নির্দেশকে তাকদীর বলে, অথচ তাঁর নির্দেশকে তাকদীর বলে না; বরং তাকদীর হলো তাঁর জ্ঞানের নাম। অর্থাৎ আল্লাহ জানতেন যে, আমি এ বান্দাকে স্বাধীনতা দিলে সে এই এই কাজ করবে। তাই তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন যে, অমুক বান্দা এ-রূপ কাজ করবে। এর অর্থ এটা নয় যে, আল্লাহ তাকে এ কাজটি করতে বাধ্য করেছেন। বরং তাঁর জানা ছিল যে, সে এ-রূপ করবে। তাই তিনি লিখে দিয়েছেন। বান্দা সে কাজটি এ কারণে করে না যে, আল্লাহ তা লিখে দিয়েছেন। বরং তিনি এ কারণে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, তাঁর জানা ছিল, সে এ কাজটি করবে। আল্লাহর জানা এক কথা আর তাঁর নির্দেশ আরেক কথা। এর চেয়ে আর সহজ ব্যাখ্যা হতে পারে না। এরপরও যদি বোঝে না আসে তবুও মানতে হবে।

তাকদীরের ভালো-মন্দের তাৎপর্য

আরেকটি প্রশ্ন বোঝার চেষ্টা করুন। তাকদীর যদি আল্লাহর ফয়সালা হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর সকল ফয়সালা কি ভালো হয়, নাকি কখনো কখনো মন্দও হয়? অবশ্যই তাঁর সকল ফয়সালা ভালোই হয়। কিন্তু আমরা বলে থাকি, তাকদীর ভালো হলে সেটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে, আবার মন্দ হলেও তাঁর পক্ষ থেকে। প্রশ্ন হলো, তাকদীর মন্দ হয় কীভাবে?

আমি এ কথাটিই বোঝাতে চাচ্ছি। মনে করুন-এক ব্যক্তি খুন করল। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলো। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে আদালতের নিকট হস্তান্তর করল। আদালত তার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দিল। এবার বলুন, আদালতের এ রায় কি সঠিক না ভুল? নিশ্চিত আপনি উত্তর দেবেন, সঠিক। এখন আদালতের এই রায়টি যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে আপনি খুনির বাবার বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যান ও তাকে মুবারকবাদ দিন এবং বলুন যে, আদালত আপনার ছেলের বিরুদ্ধে সঠিক রায় দিয়েছে তাই আপনাকে মুবারকবাদ জানাতে অসলাম। কী আপনি এভাবে খুনির বাবাকে মুবারকবাদ দেবেন? নিশ্চিত না। বরং আপনি আফসোস করবেন। অথচ আদালতের রায় ছিল সঠিক।

তদ্রুপ আল্লাহ তাআলার ফয়সালা সর্বদাই সঠিক হয়ে থাকে। কখনো তা মানুষের মর্জি মুতাবিক হয়, আবার কখনো হয় মর্জির বিপরীত। আল্লাহর ফয়সালা বান্দার মর্জি মাফিক হলে সেটাকে বলে ভালো তাকদীর। পক্ষান্তরে বান্দার মর্জির খেলাফ হলে সেটাকে বলে মন্দ তাকদীর। ফয়সালা তো সঠিকই; কিন্তু কখনো আমাদের চাহিদা-মাফিক হয় আবার কখনো চাহিদার বিপরীত হয়। একেই বলে তাকদীরের ভালো-মন্দ।

ইহসান কী?

জিবরাঈল আ. প্রশ্ন করলেন- فَأَخْبِرْنِيْ عَنِ الْإِحْسَانِ

‘আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন।’

জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘ইহসান হলো-তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ, আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে বিশ্বাস রাখবে যে, তিনি তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।’

ইবাদাতের প্রকারভেদ

ইবাদাত দু প্রকার। (১) বান্দা সরাসরি আল্লাহকে দেখে ইবাদাত করবে। আল্লাহও তাকে দেখবেন। (২) বান্দা আল্লাহকে দেখবে না; কিন্তু আল্লাহ বান্দাকে দেখতে পাবেন। প্রথম প্রকার ইবাদাতকে ‘ইবাদাত বিল মুশাহাদা’ বলে। দ্বিতীয় প্রকারকে বলে ‘ইবাদাত বিল গাইবুবাহ’। মুশাহাদা অর্থ একে অপরকে দেখা। আর গাইবুবাহ অর্থ একে অপরকে না দেখা।

জামেয়া আশরাফিয়া লাহুরের শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা সূফী মুহাম্মাদ সারওয়ার হাফিযাহুল্লাহ লেখেন, ইবাদাত দু প্রকার। (১) নবীর ইবাদাত। (২) উম্মতের ইবাদাত। নবীর ইবাদাত হলো, নবী আল্লাহকে দেখবেন এবং আল্লাহও নবীকে দেখবেন। উম্মতের ইবাদাত হলো, আল্লাহ উম্মতকে দেখবেন; কিন্তু উম্মত আল্লাহকে দেখতে পাবে না।

কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন

আগন্তুক ফিরিশতা (জিবরাঈল) প্রশ্ন করলেন-

فَأَخْبِرْنِيْ عَنِ السَّاعَةِ

‘আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে বলুন, তা কখন সংঘটিত হবে?’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন-

مَا الْمَسْئُوْلُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ

‘কিয়ামত কখন হবে- এ সম্পর্কে আপনারও জ্ঞান নেই এবং আমারও জ্ঞান নেই।’

কিয়ামতের নিশ্চিত জ্ঞান

জিবরাঈল আ.-এর কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে রাসূল সা. لَسْتُ بِأَعْلَمَ بِهَا ‘আমি এ সম্বন্ধে জানি না’ না বলে مَا الْمَسْئُوْلُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ দীর্ঘ জবাব দেন। এরূপ দীর্ঘ জবাব কেন দিলেন? এর কারণ হলো, যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরাঈলের প্রশ্নের জবাবে ‘আমি জানি না’ বলতেন, তাহলে কারো মনে এ সন্দেহের সৃষ্টি হতো যে, কিয়ামত সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান হয়তো জিবরাঈলের আছে; রাসূলের নেই। তাই তিনি বলেছেন-

مَا الْمَسْئُوْلُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ

অর্থাৎ কিয়ামত সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান আপনারও নেই এবং আমারও নেই।

কিয়ামতের আলামতসমূহ

জিবরাঈল আ. প্রশ্ন করলেন-

فَأَخْبِرْنِيْ عَنْ أَمَارَتِهَا

‘আমাকে কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে বলুন।’

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কিয়ামতের আলামত হলো-

أَنْ تَلِدَ الْأَمَةُ رَبَّتَهَا

অর্থাৎ যখন সেই কাল আসবে, যে কালে দাসী তার মনিবাকে জন্ম দেবে তথা মেয়ে হয়ে যাবে মনিবার মতো আর মা দাসীর মতো, তখন বুঝে নেবে কিয়ামত বেশি দূরে নয়।

উলামায়ে কেরাম এখানে একটি সূক্ষ্ম কথা লিখেছেন যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন এ কথা বললেন যে, মেয়ে মনিবার স্তরে আর মা দাসীর স্তরে পৌঁছে যাবে? তিনি তো এ রকমও বলতে পারতেন যে, পিতা দাসের মতো আর পুত্র মনিবের মতো হয়ে যাবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে পিতা ও পুত্রের উদাহরণ দেননি। বরং মা ও মেয়ের উদাহরণ দিয়েছেন এ কথা বোঝানোর জন্য যে, ছেলে থাকে বাইরে, সে শক্তিশালী এবং জীবিকা উপার্জন করতে পারে। হতে পারে ছেলে তার শক্তি ও ধাপটে পিতাকে দাস বানিয়ে নেবে। পক্ষান্তরে মেয়ে থাকে ঘরের ভেতর, মেয়েজাত দুর্বল প্রকৃতি। যখন এমন যুগ আসবে যে, মেয়েরা দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও রানি হওয়ার চেষ্টা করবে, তখন বুঝে নেবে যে, কিয়ামত ঘনিয়ে এসেছে।

রাখালরা প্রাসাদ নির্মাণ করবে!

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের দ্বিতীয় আলামত সম্বন্ধে বলেন-

أَنْ تَرَى الْحُفَاةَ الْعُرَاةَ الْعَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُوْنَ فِي الْبُنْيَانِ

অর্থাৎ তুমি দেখতে পাবে যে, যাদের পায়ে জুতা ও পরনের কাপড় নেই, নিঃস্ব ও বকরির রাখাল, তারা বড় বড় প্রাসাদ তৈরিতে পরস্পর প্রতিযোগিতা করছে, তখন বুঝে নেবে, কিয়ামত ঘনিয়ে এসেছে।

রাসূলের যুগে এ কথাটি বোঝা খুবই জটিল ছিল যে, বকরির রাখাল যে নিঃস্ব, খাবারের মতো কিছুই নেই এবং শরীর ঢাকার মতো কোনো বস্ত্রও নেই এবং পায়ে পরার মতো জুতাও নেই এমন লোক অট্টালিকা বানাবে তা কি কল্পনা করা যায়? কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের ঈমান ছিল এরূপ যে, রাসূলের কোনো কথা তাঁদের বুঝে আসুক বা না আসুক তারা বিশ্বাস করতেন।

ভিক্ষুকের ব্যাংকব্যালেন্স!

মানুষের কাছে বাহ্যত পরিধেয় বস্ত্র নেই, পায়ে জুতাও নেই। লোকটি গরীব। পেটে হাত রেখে অপরের নিকট ভিক্ষা চায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। দেখে মনে হয় পেটে কিছুই নেই। কিন্তু তল্লাশি করলে দেখা যায়, তার ব্যাংক-ব্যালেন্সে আছে লক্ষ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ সে হলো একজন পেশাদার ভিক্ষুক। যখন এমন যুগ আসবে, বুঝে নেবে কিয়ামত বেশি দূরে নয়। বর্তমান যুগের ভিক্ষুকদের প্রতি লক্ষ করুন! দেখবেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিক্ষা করছে, মনে হয় লোকটি একেবারে নিঃস্ব। তাকে যদি দৈনিক ৩০ জন লোক একশো টাকা করে দান করে, তাহলে একদিনের ইনকাম দাঁড়ায় মোট তিন হাজার টাকা। দৈনিক তার আয় তিন হাজার টাকা হলে মাসিক আয় হবে নব্বই হাজার। এতে তার কোনো খরচ নেই। এখন এরূপ ব্যক্তির মাসিক আয় যদি হয় নব্বই হাজার, তাহলে বছরান্তে তার অ্যাকাউন্টে জমা হবে দশ বা সাড়ে দশ লক্ষ টাকা। এমন ভিক্ষুক অট্টালিকা বানাবে না তো কী বানাবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাটিই বুঝিয়েছেন।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT