হাদীসে জিবরাঈল (২য় পর্ব)

ঈমান কাকে বলে?

জিবরাঈল আ. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করেন-‘আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন।’ নবীজি উত্তর দেন-‘ঈমান হলো-আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তাকদীরের ভালো-মন্দের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা।

এখানে প্রশ্ন হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘ঈমান কাকে বলে’ প্রশ্নের উত্তরে ছয়টি বিষয় উল্লেখ করে বলেছেন, তা হলো- (১) আল্লাহকে বিশ্বাস করা, (২) ফেরেশতাগণকে বিশ্বাস করা, (৩) রাসূলগণকে বিশ্বাস করা, (৪) কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, (৫) কিয়ামাতের দিনের প্রতি বিশ্বাস করা এবং (৬) তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। প্রথম পাঁচটি বিষয়ের ক্ষেত্রে تُؤْمِنَ শব্দ একবার উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তাকদীরের আলোচনায় تُؤْمِنَ শব্দ পুনরায় উল্লেখ করেছেন। এর প্রয়োজন কী? নবীজি ছয়টি বিষয়কে একত্রে উল্লেখ করলেন না কেন? এর কারণ এই যে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা সহজ, বোঝাও সহজ। ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস করা বা বোঝাও সহজ। নবীগণের প্রতি বিশ্বাস করা বা বোঝা সহজ। আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস করা বা বোঝা সহজ। কিয়ামাতের দিনের প্রতি বিশ্বাস করা ও বোঝা সহজ। কিন্তু তাকদীর হলো এমন একটি বিষয়, যা সহজে বুঝে আসে না। তাই তাকদীরের ক্ষেত্রে تُؤْمِنَ শব্দ পুনরায় উল্লেখ করে বলেছেন যে, বুঝে আসুক বা না-আসুক তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। কেননা, ঈমান তো হলো-তোমার বুঝে আসুক বা না-আসুক-মেনে নেওয়া। তাই تُؤْمِنَ শব্দের পুনরুল্লেখ করে বলেছেন যে, বুঝে না আসলেও তাকদীর বিশ্বাস করতে হবে।

তাকদীরের ব্যাখ্যা

আমি একটি কথা উপস্থাপন করছি, যাতে আপনি বুঝতে পারেন যে, তাকদীর বিষয়টি কী পরিমাণ জটিল। এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহ তাআলা যখন জান্নাত-জাহান্নাম মানুষের ভাগ্যে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন, তখন নামাযের প্রয়োজন কী? বান্দার ভাগ্যে জান্নাত লিপিবদ্ধ থাকলে সে নামায পড়লেও জান্নাতে যাবে, আবার না পড়লেও যাবে। তদ্রুপ কারো ভাগ্যে জাহান্নাম লিপিবদ্ধ থাকলে সে যতই নামায পড়ুক- তাকে জাহান্নামে যেতেই হবে। তাহলে এখন নামায পড়ার প্রয়োজন কী? অনরূপ একজন বলল, ভাগ্যে লেখা ছিল যে, অমুক ব্যক্তি অমুকের হাতে নিহত হবে। এখন হত্যাকারী তো বাধ্য ছিল যে, অমুক তার হাতে নিহত হবে। তাহলে হত্যাকারীর দোষ কী? তাকে কেন শাস্তি দেওয়া হবে?

আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, যখন আপনি এ-রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন, তখন কি আপনি হতভম্ব হবেন না? নিশ্চিত হবেন। আমি দারসের মধ্যখানে কথাটি এ-কারণে তুললাম, যাতে আপনি বুঝতে পারেন যে, আমাদের দায়িত্ব কী? আমরা তো যে-কাজটি সবচেয়ে কঠিন সেটাকে আমাদের দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি। ‘তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো’ কথাটি বলা যতটা সহজ; তাকদীরে বিশ্বাস স্থাপন কীভাবে করতে হয় তা বোঝা তত সহজ নয়।

উদাহরণের সাহায্যে তাকদীরের বিশ্লেষণ

একদিন আমাকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হুজুর! যখন খুন হওয়া ও খুন করা ভাগ্যে লিপিবদ্ধ ছিল, তখন খুনিকে শাস্তি দেওয়া হবে কেন? আমি বললাম, বিষয়টি একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝুন। এক ব্যক্তির একটি বাগান ছিল। চোর প্রতিদিন ওই বাগান থেকে ফল চুরি করে নিয়ে যায়। একদিন বাগানের মালিক পাহারাদারকে বলল, চোরকে ধরতে হবে। পাহারাদার বেচারা ওঁৎ পেতে বসে আছে চোরের অপেক্ষায়। চোর প্রতিদিনির মতো এ-দিনও এল চুরি করতে। বাগানের প্রহরী চোরকে ধরে ফেলল। চোর বেচারা বলল, দেখো ভাই! আমি হলাম একজন পাক্কা মুসলিম এবং তুমিও মুসলিম। আল্লাহ আমার ভাগ্যে এ-কথা লিখে দিয়েছেন যে, আমি এ-বাগান থেকে ফল চুরি করে খাব! তাই আমি চুরি করে খাচ্ছি। কারণ, আমি তো চুরি করতে বাধ্য, যেহেতু আমার ভাগ্যে তা লিখে রাখা হয়েছে। আমি আল্লাহর লেখার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারব না।

বাগানের প্রহরী ছিল সাদাসিধে লোক। চোরের কথা শুনে চোরকে ছেড়ে দিলো। মালিক জিজ্ঞেস করল, এতদিন হয়ে গেল; কিন্তু তুমি চোরকে ধরতে পারলে না? প্রহরী বলল, মালিক জাহাপনা! গত রাতে তাকে ধরেছিলাম; কিন্তু ছেড়ে দিয়েছি। মালিক বলল, কেন? প্রহরী বলল, চোর বেচারা এত চমৎকার যুক্তি উপস্থাপন করেছিল যে, তাকে গ্রেফতার করার কোনো উপায় নেই। মালিক বলল, আজ রাত যদি আসে, তাকে গ্রেফতার করতে হবে। বাগানের মালিক ছিল বুদ্ধিমান। সে ভোরে একজন মাওলানা সাহেবের নিকট গেল এবং বলল, হুজুর! প্রতিরাত আমার বাগানে একজন শিক্ষিত চোর এসে বাগানের ফল চুরি করে নিয়ে যায়। বাগানের প্রহরী তাকে গ্রেফতার করলে সে এমনভাবে যুক্তি উপস্থাপন করে যে, প্রহরী তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মাওলানা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, সে কী যুক্তি পেশ করে? মালিক বলল, এ-রকম এ-রকম যুক্তি পেশ করে থাকে। মাওলানা সাহেব বললেন, যে-কোনোভাবেই হোক তাকে গ্রেফতার করে আমাকে জানাবেন।

এবার প্রহরী সতর্কতার সাথে পাহারা দিচ্ছে। প্রতিরাতের ন্যায় আজও আসলো চোর। চোর বাগানে ঢুকতেই প্রহরী তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলল। এবারও সে তার ওই পুরনো যুক্তি উপস্থাপন করল। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। চোরকে গ্রেফতার করে মাওলানা সাহেবকে খবর দেওয়া হলো। তিনি আসলেন এবং বললেন, তাকে একটি গাছের সাথে বাঁধো। আর প্রাহরীকে বললেন, এবার তাকে ডান্ডা লাগাও। সে দু-একটি ডান্ডা খেয়ে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল, আমাকে ছেড়ে দাও আমাকে ছেড়ে দাও। মাওলানা সাহেব বললেন, না ভাই, তোমার ভাগ্যে লেখা ছিল, তুমি এ বাগানের ফল চুরি করবে এবং ডান্ডাও খাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার ভাগ্যে এটি লিপিবদ্ধ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রহরী তোমাকে পেটাতে থাকবে। আল্লাহ যখন বলবেন, একে ছেড়ে দাও, তখন ছেড়ে দেওয়া হবে। এবার চোর বেচারা বলল, হুজুর! বিষয়টি আমার বোধগম্য হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আমি এখানে আর কখনো আসব না।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT