হাদীসে জিবরাঈল (শেষ পর্ব)

আগন্তুক ছিলেন জিবরাঈল আ. 

হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, প্রশ্নোত্তরপর্বের পর আগন্তুক চলে গেলেন। আমি বেশ কিছুসময় হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম এবং চিন্তা করলাম যে, আগন্তুক লোকটি কে? তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে উমর! তুমি কি জানো প্রশ্নকারী লোকটি কে?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-

فَإِنَّهُ جِبْرَائِيْلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِيْنَكُمْ

অর্থাৎ আগন্তুক লোকটি হলেন হযরত জিবরাঈল, তিনি তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমাদের নিকট আগমন করেছিলেন।

জিবরাঈল আ.এর আগমনের উদ্দেশ্য

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার মধ্যে একটু চিন্তা করুন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তো এসেছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট। কিন্তু রাসূল বলছেন-

أَتَاكُمْ

অর্থাৎ নিশ্চয় জিবরাঈল এসেছেন আমার কাছে; কিন্তু এসেছেন তোমাদের উদ্দেশ্যে।

কেন এসেছেন?

يُعَلِّمُكُمْ دِيْنَكُمْ

অর্থাৎ তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শেখানোর জন্য।

কেননা, জিবরাঈল আ. তো রাসূলের শিক্ষক নন। পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কেউই রাসূলের শিক্ষক হতে পারেন না। তাঁর শিক্ষক স্বয়ং মহান আল্লাহ। জিবরাঈল আছেন শুধু ওয়াসেতা বা মধ্যস্থতা হিসেবে। জিবরাঈল আ.-কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষক মেনে নিলে রাসূলের মর্যাদা কমে যাবে। কেননা, সাধারণত ছাত্রের তুলনায় শিক্ষকের মর্যাদা বেশিই হয়ে থাকে। তাই নবীজি বলেছেন-

يُعَلِّمُكُمْ

অর্থাৎ জিবরাঈল এসেছেন তোমাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য; আমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নয়।

অতএব জিবরাঈল আ. হলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মধ্যখানে ওয়াসেতা বা মাধ্যম মাত্র।

দ্বীনে মুহাম্মাদ শিখতে হবে সাহাবায়ে কেরাম থেকে

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

يُعَلِّمُكُمْ دِيْنَكُمْ

অর্থাৎ জিবরাঈল আ. এসেছেন তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শেখানোর জন্য।

এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- دِيْنِيْ অর্থাৎ আমার দ্বীন-বলেননি। এর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী বোঝাতে চেয়েছেন একটু ভেবে দেখুন। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে দুটি আশ্চর্যময় শব্দ ব্যবহার করেছেন। সূরা কাফিরূন-এ বলেছেন-

لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ

এখানে دِيْنِ শব্দটি মূলত دِيْنِيْ ছিল। ياء সর্বনামকে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, হে রাসূল! আপনি বলে দিন-‘হে মক্কার মুশরিকরা! তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য আর আমার ধর্ম আমার জন্য।’

রাসূলের মাক্কী জীবনে মহান আল্লাহ দ্বীনকে রাসূলের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন। কিন্তু মাদানী জীবনে বলেছেন-

اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ

অর্থাৎ, আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।

অতএব মাদানী জীবনে মহান আল্লাহ দ্বীনকে সাহাবায়ে কেরামের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন। প্রশ্ন হলো, মক্কায় দ্বীনকে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন রাসূলের সাথে আর মদীনায় সম্বন্ধযুক্ত করেছেন সাহাবায়ে কেরামের সাথে। এর কারণ কী? এর কারণ হলো এই যে, দ্বীন যখন শুরু হয়, তখন ছিল দ্বীনে মুহাম্মাদ, আর যখন পূর্ণতা লাভ করে, তখন হয় দ্বীনে সাহাবা। দ্বীনে মুহাম্মাদ পাওয়া যাবে সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে। তাঁদেরকে বাদ দিয়ে দ্বীনে মুহাম্মাদ লাভ করা অসম্ভব। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

يُعَلِّمُكُمْ دِيْنَكُمْ

অর্থাৎ, জিবরাঈল আ. এসেছেন তোমাদের জন্য, শিখিয়েছেন তোমাদেরকে এবং এ দ্বীনও তোমাদের। আমি তো এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। এখন এ দ্বীনের হেফাজত তোমাদেরকেই করতে হবে।

হাদীসে জিবরাঈলের ব্যাপকতা

এ হাদীসের নাম ‘হাদীসে জিবরাঈল।’ এটি গোটা দ্বীনের সারনির্যাস। একে ‘উম্মুস সুন্নাহ’ নামেও অভিহিত করা হয়। কয়েকটি বিষয়ের সমষ্টিকে দ্বীন বলা হয়। যেমন :  (১) ঈমান, (২) ইসলাম এবং (৩) ইহসান। আরো সহজ ভাষায় : (১) আকাইদ, (২) মাসাইল এবং (৩) তাসাওউফ। এ তিনটি বস্তুর সমষ্টি হলো দ্বীন। কেননা, মানুষের মধ্যে তিনটি বস্তু রয়েছে-দেহ, অন্তর এবং আত্মিক অবস্থা। দ্বীনের যে বিষয়টি মানুষের দেহের সাথে সম্পৃক্ত সেটা হলো ইসলাম। অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত হলে সেটা হবে ঈমান আর আত্মিক অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত হলে তা হবে ইহসান। জিবরাঈল আ.-এর প্রথম প্রশ্নটি ছিল ইসলাম সম্পর্কে (যা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সম্পর্কযুক্ত)। দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল ঈমান সম্পর্কে (যা অন্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত)। আর তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল তাসাওউফ সম্পর্কে (যা আত্মিক অবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত)।

দ্বীন কী?

দ্বীন তিনটি বস্তুর সামষ্টিক নাম।

১.     ‘আকাইদ।’ একে ঈমান বলা হয়।

২.     ‘মাসাইল।’ একে ইসলাম বলা হয়।

৩.     ‘আখলাক।’ একে ইহসান বলা হয়।

আকীদা শেখা যায় ‘মুতাকাল্লিম’ বা ধর্মতত্ত্ববিদের নিকট। মাসাইল শেখা যায় ফকীহ বা মুফতির নিকট। আর ইহসান তথা তাসাওউফ লাভ করা যায় ‘শাইখে তারীকত’-এর নিকট। যে শাস্ত্রে আকীদা সম্বন্ধে আলোচনা করা হয় তাকে ‘ইলমুল কালাম’ বলা হয়। যে শাস্ত্রে মাসাইল সম্বন্ধে আলোচনা করা হয় তাকে ‘ইলমুল ফিকহ’ বলা হয়। আর যে শাস্ত্রে আখলাক বা চরিত্র সংশোধন নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে ‘ইলমুত তাসাওউফ’ বলা হয়।

বোঝা গেল যে, দ্বীনের মধ্যে তিনটি বিষয় রয়েছে। যথা : (১) ইলমুল কালাম (আকীদা শাস্ত্র), (২) ইলমুল মাসাইল (ফিকহ শাস্ত্র) এবং (৩) ইলমুল আখলাক (তাসাওউফ শাস্ত্র)।

হাদীসটির শিক্ষা ও বাস্তব প্রয়োগ

হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কতৃর্ক বর্ণিত এ হাদীসটি দ্বারা আমরা জানতে পারি যে, একজন ছাত্রকে কীভাবে তার উস্তাদের নিকট বসতে হয় এবং কোন পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে হয়। এর দ্বারা আরো অবহিত হতে পারি যে, দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলোর সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কী। জানতে পারি এ কথা যে, মহাপ্রলয়ের নির্দিষ্ট সময় আল্লাহর নিকট রয়েছে, এ বিষয়ে অন্য কেউ বিন্দুমাত্রও অবহিত নয়। তবে এর কিছু পূর্বলক্ষণ রয়েছে যার আংশিক বিষয় হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং আমাদের বাস্তব জীবনেও এ হাদীসের গুরুত্ব অনেক বেশি। শিক্ষকের নিকট কীভাবে বসতে ও প্রশ্ন করতে হবে তা এখান থেকে শিখতে হবে। আর ঈমান, ইসলাম, ইহসান ইত্যাদি বিষয়াবলি অনুযায়ী মানবজীবন গড়তে হবে, কিয়ামাত সম্পর্কে পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, আর নিজেকে আল্লাহমুখী করতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালাতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT