ঘটনা মে মাসের ১৮ তারিখের। আপনাদের মনে থাকার কথা। নরসিংদী রেলস্টেশনে স্বল্পবসনা এক তরুণীকে হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছিল। তরুণীটি তার কয়েক ছেলেবন্ধুকে নিয়ে শেষ রাতের ট্রেনে ঘুরতে এসেছিল ঢাকা থেকে। তার পরনে কাপড়ের পরিমাণ এতই স্বল্প ছিল যে, ন্যূনতম সভ্যতা জ্ঞান যাদের আছে তারাও ইতস্ততা বোধ করবে। সকালে রেলস্টেশনে এমন পোষাক পরে হাঁটাচলা করায় স্থানীয় এক নারী তাকে বোঝান যে, জনপরিসরে এ ধরনের পোষাক মাননসই নয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, তরুণীটি তখন ওই নারীকে অপমান করার চেষ্টা করে। তাকে সঙ্গ দেয় সাথে থাকা তার ছেলেবন্ধুগুলোও। ফলে, নারীর পক্ষ নিয়ে স্থানীয় কিছু লোক তাদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়ায়। সেই বাদানুবাদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলো ‘নারী স্বাধীনতা’র বোল আওড়িয়ে মেয়েটিকে হেনস্তা করা হয়েছে বলে শোর তোলে। একে ইস্যু বানিয়ে গরম করা হয় টকশোর টেবিল। টানা কয়েক দিন চলে নারীবাদীদের প্রতিবাদ। তাঁরা একই ধরনের স্বল্পবসনা হয়ে দলবদ্ধভাবে নরসিংদী রেলস্টেশনে গিয়ে ছবি তোলেন। এর জেরে স্থানীয় সেই নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিন মাস পর আগস্টের ১৭ তারিখে সেই নারীর জামিন মঞ্জুর করেন উচ্চ আদালত। পাশাপাশি ওই ঘটনায় তরুণীর পোষাক নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আদালত। তরুণী যে ধরনের পোশাক পরেছিল তা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই কি নাÑ এ প্রশ্ন তুলে আদালত বলেন, ‘আমাদের দেশের কৃষ্টি-কালচার অনুযায়ী গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার কোনো অনুষ্ঠানেও এ ধরনের পোশাক দৃষ্টিকটূ।’
তরুণীকে হেনস্তার প্রতিবাদ করতে ঢাকা থেকে নরসিংদী যাওয়া ব্যক্তিদের পোশাক নিয়েও প্রশ্ন তোলেন হাইকোর্ট।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘জামিন আবেদনকারী আইনজীবীর শুনানি অনুযায়ী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী নরসিংদী রেলস্টেশনে স্বল্প পোশাক পরিহিত এক তরুণীকে সতর্ক করেছিলেন। কারণ, ওই তরুণীর পোশাক দেশের কৃষ্টি-কালচার, সামাজিক রীতিনীতি ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়নি তাঁর।’
সভ্য দেশের আদালত হিসেবে হাইকোর্টের এ পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত যৌক্তিক এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু যে মিডিয়া এত হৈচৈ করেছিল এ ঘটনায়, আদালতের পর্যবেক্ষণের পর এখন তারা নীরব!
মিডিয়া হচ্ছে সমাজ ও সভ্যতার মুখপত্র। বাংলাদেশের সভ্যতা ও কালচার এখনো যথেষ্ট উন্নত এবং শালীন। তরুণীটি ছেলেবন্ধুদের নিয়ে শেষ রাতের ট্রেনে অপরিচিত এলাকায় ঘুরতে যাওয়ার কী কারণ, এত স্বল্পবসনে পাবলিক পরিসরে সে কেন ঘুরে বেড়ায়, ঘটনার পর মিডিয়ার কর্তব্য ছিল সেই প্রশ্ন তোলা। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো। মিডিয়া তরুণীটির পক্ষ নিয়ে অসভ্যতা ও বেহায়ামির বৈধতা তৈরির চেষ্টা চালায় ।
স্থানীয়দের ভাষ্য—নরসিংদী রেলস্টেশনের আশপাশে আগে অনেক বস্তি ছিল। পুরো নরসিংদীর মাদক এবং বেশ্যাবৃত্তির প্রাণকেন্দ্র ছিল সেগুলো। এমনকি রেলস্টেশনে মালবাহী কিংবা যাত্রীবাহী রেলের যেসব পরিত্যাক্ত বগি থাকত, সেগুলোও অঘোষিতভাবে পতিতালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
নরসিংদীর সাবেক মেয়র লোকমান হোসেনের সময়কালে তিনি রেলস্টেশন বস্তিসহ নরসিংদীর আরও যতগুলো বস্তিতে অঘোষিত পতিতালয় ছিল সেগুলো উচ্ছেদ করে দেন।
তারপর থেকে রেলস্টেশনের অঘোষিত পতিতালয়গুলো শিফট করেছে আশপাশের আবাসিক হোটেলে। স্থানীয়রা জানান, এখানকার হোটেলগুলো সাধারণভাবে ‘থাকার’ উপযুক্ত নয়। কারণ, এগুলো ডিজাইনই করা হয়েছে অবৈধ কাজে ব্যবহারের জন্য। নরসিংদীর স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। আর স্থানীয় বাসিন্দারা বিষয়টি জানেন বলেই ওই মেয়ের অসভ্যতায় সেদিন তাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন। বিপরীতে দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলো এই নোংরামিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সম্মিলিতভাবে উঠে-পড়ে লেগেছিল। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অ্যাক্টিভিটি শক্তিশালী থাকায়, মিডিয়ার এই বয়ান জনপরিসরে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ, বাস্তবতা ছিল সবার কাছে পরিষ্কার। ১৭ আগস্ট এ ঘটনায় উচ্চ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য সেই বাস্তবতাকে আরও পরিষ্কার করে দিল। আর এর মধ্য দিয়ে আরও একবার স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, মূলধারার অধিকাংশ মিডিয়া ও সেগুলোর কর্ণধাররা এ দেশের গণমানুষের রুচিবোধ ও জীবনাচারের প্রতিনিধিত্ব করে না, তারা এমন এক সভ্যতা এখানে আমদানি করতে চায় যা এ মাটির হাজার বছরের সভ্যতা সংস্কৃতি ও জীবনাচারের সম্পূর্ণ বিপরীত। সভ্য সমাজ যা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।
—হামমাদ রাগিব