বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। ভেতর-বাড়ির বারান্দায় পিড়ি পেতে বসে আছেন সালমা। দীর্ঘ অসুস্থতা অনিদ্রা আর মানসিক পেরেশানির ক্লান্তি তাঁর চোখে-মুখে লেপ্টে আছে। বয়স এখনো পঁয়তিরিশের কোটা পেরোয়নি, কিন্তু তাঁকে দেখলে মনে হবে ৫০ পেরোনো কোনো বৃদ্ধা। বিগত ছয় মাসের টানা অসুস্থতা আর অপেক্ষার অস্থিরতায় যেন একদম বুড়িয়ে গেছেন সালমা। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন বাহির-বাড়ির পথপানে। বাড়ির সদর দরজা ঠেলে এই বুঝি ফিরবেন আবুল হাসান, তাঁর স্বামী। অথবা নিদেনপক্ষে তাঁর নিরাপদ যাত্রার খবর নিয়ে আসবে কোনো কাসেদ। কয়েক মাস ধরে এ তাঁর রোজকার রুটিন। বিকালের সময়টুকু তিনি এভাবে দাওয়ায় বসেই পার করেন। এবং মাগরিবের আজানের সময় নিরাশ হয়ে প্রতিদিনই তাঁকে ফিরে যেতে হয় ঘরে।
বাড়ি-লাগোয়া মসজিদ থেকে দারাজ কণ্ঠে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। মাগরিবের আজান। খালিদ, সালমারই আত্মজ, হৃদয়-নিংড়ানো আবেগ নিয়ে আজানের ধ্বনিগুলো উচ্চারণ করছে। কিন্তু সালমা আজ উঠছেন না পিড়ি থেকে, আজানের মোহন-সুর তাঁকে আজ কোনো তাড়া দিতে পারছে না, বরং তিনি যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন হৃদয়-আকুল করা সেই সুরে। স্বীয় আত্মজের এই সুরে সালমা খুঁজে পাচ্ছেন স্বামীর ছোঁয়া। আজ থেকে বছর বিশেক আগে তাঁর স্বামীর কণ্ঠে তিনি প্রথম শুনেছিলেন আজানের এই সুমধুর সুর, এবং সরন্দীপের মাটিতে সেটাই ছিল ইতিহাসের প্রথম আজান। খালিদ যেন পিতার সেই সুরকে হুবহু নকল করছে, সদ্য কৈশোর-উতরানো তারুণ্যদীপ্ত কণ্ঠে যেন প্রতিস্থাপিত হয়েছে আবুল হাসানের ব্যক্তিত্বপূর্ণ পুরুষালি সুর। যে সুরের সূত্র ধরে সালমা হারিয়ে যাচ্ছেন ২০ বছরের সংসার-জীবনের সুখস্মৃতিতে।
‘আম্মা, আজান সেই কখন শেষ হয়েছে! এখনো বসে আছেন, নামাজ পড়বেন না? ওয়াক্ত তো ফুরিয়ে এল!’ ঘরের ভেতর থেকে নাহিদের ব্যস্ত ও তাড়িত কণ্ঠ সালমার ভাবনায় ছেদ কাটল। নাহিদ নামাজ পড়ে নিয়েছে, জায়নামাজ থেকেই সোজা উঠে এসেছে সম্ভবত, মাথায় পরিপাটি করে ওড়না প্যাঁচানো। বারান্দায় এসে মায়ের পাশে বসল সে। আলতো করে মায়ের মাথায় হাত রাখল। সালমা উঠতে যাচ্ছিলেন তখন, কপোল বেয়ে নামা অশ্রæর ধারাটি মুছতে চাচ্ছিলেন নাহিদকে বুঝতে না দিয়ে, কিন্তু লুকোতে পারলেন না। কন্যা ঠিকই ধরে ফেলল। আহত কণ্ঠে সে বলল, ‘আম্মা, আপনি যদি এভাবে উদাস থাকেন, এভাবে কাঁদতে থাকেন, তাহলে শরীরের অবস্থা তো আরও খারাপ হবে! আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে আমরা যাব কোথায়, আম্মা! আব্বা না যাবার সময় আপনাকে ভেঙে পড়তে মানা করেছেন?’
‘ভেঙে পড়িনি, বেটি! কিন্তু তোর বাবা তো অন্তত কোনো খবর জানাতে পারতেন, সহিসালামতে পৌঁছলেন কি না, নাকি (খোদা না করুন) কোনো মুসিবতে পড়লেন, আমরা তো কিছুই জানতে পারছি না…’
‘কিচ্ছু হয়নি আম্মা! হয়তো খবর দেওয়ার মতো কাউকে পাচ্ছেন না, অথবা অন্যকোনো জরুরি ব্যস্ততায় মশগুল হয়ে গেছেন, আপনি একদমই ভাববেন না, আব্বার খবর খুব শিগগিরই পাব আমরা ইনশাআল্লাহ। এখন আর কোনো কথা নয়, চলুন, ঘরে চলুন, মাগরিবের ওয়াক্ত ফুরিয়ে এল, নামাজ সারবেন।’
মা-মেয়ে ঘরে চলে গেলেন। আবুল হাসানের বাড়ির উঠোন জুড়ে তখন সন্ধ্যার আলো-আঁধারি গাঢ় অন্ধকারে রূপান্তরিত হচ্ছে। আবুল হাসানের ছেলেও মসজিদে জামাত সেরে বাড়িতে ঢুকছে।
***
সরন্দীপ হিন্দুস্তানের পূর্বসীমান্তের অতিগুরুত্বপূর্ণ এক বন্দর নগরী। হিন্দুস্তানের সঙ্গে বহিঃবিশে^র যোগাযোগ ও বাণিজ্যের অন্যতম যোগসূত্রও এ সমুদ্রবন্দর। হাজার হাজার বছর ধরে বিদেশি বণিকদল এ বন্দরে নোঙর করে আসছে তাদের সওদাবোঝাই জাহাজ। আবার এখান থেকে নানাবিধ পণ্য নিয়ে ফেরত যাচ্ছে নিজ দেশে কিংবা নতুন কোনো গন্তব্যে। কেউ কেউ ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসে সাগরপাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমÐিত এ নগরীতেই করে নিচ্ছে স্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্ত।
পৃথিবীজুড়ে দুই পরাশক্তির জয়জয়কার ছিল দীর্ঘদিন। পারস্য ও রোম। দুই সা¤্রাজ্যের বাইরের অঞ্চলগুলোর শাসক-প্রজাÑসকলেই তোয়াজ করে চলত তাদেরকে। সরন্দীপও এর ব্যতিক্রম ছিল না। দুই পরাশক্তির শাসকশ্রেণির ব্যাপারে সরন্দীপবাসী যেমন তটস্থ ছিল, তেমনি সেখান থেকে আগত ব্যবসায়ীদেরকেও ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, তারা বিশেষ সমীহ করে চলত। এরই সূত্র ধরে ইরানী ও সিরিয়ান ব্যবসায়ীদের বিশেষ কদর ছিল তাদের কাছে। এর বাইরে আরব অঞ্চল থেকেও সরন্দীপে অনেক ব্যবসায়ীর আগমন ঘটত, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী না হওয়ায় আরব বণিকদের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী ছিল না তারা। তারপরও আরবরা জাত-ব্যবসায়ী হওয়ায় এমনতর উপেক্ষা সত্তে¡ও সরন্দীপে ছিল তাদের নিরবচ্ছিন্ন আনাগোনা। অনেক আরব বণিক ব্যবসার উদ্দেশে সরন্দীপে এসে এখানেই স্থায়ীভাবে তিথু হয়েছেন। বংশানুক্রমিকভাবে এখানে বেড়ে উঠেছে তাঁদের অনেকের পরবর্তী প্রজন্ম।
কিন্তু আরবদের অবহেলা করার দিন এখন শেষ হয়েছে। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে ইসলাম আবির্ভাবের সূত্র ধরে আরব অঞ্চলে রাজনৈতিক বিজয়ের যে ধারা সূচিত হয়েছে, তার প্রভাব দূর হিন্দুস্তানের এই উপক‚লীয় অঞ্চলেও এসে পড়েছে। মুসলমানেরা একে একে রোম ও পারস্যের দম্ভ খর্ব করে চলেছে। প্রতি বছরই শহরের পর শহর দখলে আসছে তাদের, পদানত করছে অজেয় সব দুর্গ। ফলে দূর-দূরান্তের দেশগুলোতে বেড়েছে আরব অভিবাসীদের কদরও। যদিও সেই আরবদের অনেকে তখনও ইসলামের দেখা পায়নি। দেখা পায়নি স্বগোত্রীয় সেইসব বীর সেনানীরও। কিন্তু কেবলই আরব হবার কারণে স্থানীয় শাসকশ্রেণি ও আমজনতাÑসকলের কাছে বেড়ে গেছে তাদের মর্যাদা।
সরন্দীপে বসবাসকারী এমনই এক আরব অভিবাসী পরিবারের মেয়ে সালমা। তাঁর বাবার নাম ছিল প্রথমে আবদুশ শামস। স্থানীয় আরব ব্যবসায়ী কমিউনিটির সরদার ছিলেন তিনি। কয়েক পুরুষ ধরে তাঁরা এখানে বসবাস করে আসছেন। আরবে তাঁদের গোত্রের কে কোথায় আছে, কালের পরিক্রমায় এখন সেসবের কিছুই আর জানেন না তাঁরা। তারপরও রক্ত ও জীবনধারায় আরবদের সংস্কৃতি লালন করায় মুসলমানরা যখন দেশের পর দেশ জয় করছিলেন, ইয়ারমুক ও কাদেসিয়ার মতো শানদার বিজয়ের সংবাদ যখন সরন্দীপের স্থানীয় জীবনযাত্রায়ও প্রভাব বিস্তার করছিল, তখন আরব হিসেবে তাঁরাও গর্ববোধ করতেন। একই সঙ্গে আমজনতা তো বটেই, স্থানীয় শাসকের কাছেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিলেন।
ইয়ারমুক ও কাদেসিয়ার বিস্ময়কর বিজয়ের খবর যখন সরন্দীপে আসে, সরন্দীপের রাজা তখন স্থানীয় আরব ব্যবসায়ী কমিউনিটিকে বিশেষ নিমন্ত্রণ জানান তাঁর প্রাসাদে। ভবিষ্যৎ-রাজনীতির নিরাপত্তা বিবেচনায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন আবদুশ শামসের সঙ্গে।
৪৫ হিজরীর দিকে এ রাজার মৃত্যু হয়। তাঁর পরবর্তী রাজাও আবদুশ শামস ও আরব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একই নীতি অবলম্বন করেন। বরং তিনি সম্পর্কটাকে আরও মজবুত করতে উদ্যোগী হন। আবদুশ শামসকে দরবারে ডেকে একদিন প্রস্তাব করেন আরব ভ‚খÐ সফরের। তিনি মূলত মুসলমানদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন। আবদুশ শামসকে বললেন, ‘বহুদিন হয়, আরব দেশ থেকে কোনো বণিকের আগমন ঘটছে না সরন্দীপে। ওখানকার হালহাকিকত জানতে আমার বিশেষ আগ্রহ হচ্ছে। মুসলমানদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ তৈরি করাও দরকার। আমি চাচ্ছি, আপনি একবার ঘুরে আসুন। পিতৃভ‚মিও দেখলেন, সেখানকার হালহাকিতও জেনে আসলেন। সফরের যাবতীয় ইন্তেজাম আমার তরফ থেকে করে দেব।’
আবদুশ শামস এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। কয়েক দিনের ভেতর একটি কাফেলা তৈরি করে নিলেন নিজ নেতৃত্বে। এক বিকেলে রাজকীয় জাহাজে করে সরন্দীপ বন্দর থেকে তাঁরা যাত্রা শুরু করেন।
কিন্তু দিন বিশেক পর মাত্র দুজন সঙ্গীসহ বিধ্বস্ত অবস্থায় আবদুশ শামস ফিরে এলেন সরন্দীপে। তাঁর কাফেলা সমুদ্রঝড়ের কবলে পড়েছিল, সিন্ধুর ব্যবসায়ীদের একটি জাহাজ তাঁদের তিনজনকে কেবল উদ্ধার করতে পেরেছে, বাকি সকলের ভাগ্যে জুটেছে সলিল সমাধি।
এ ঘটনার বছর তিনেক পর দুজন মুসলিম ব্যবসায়ীর আগমন ঘটে সরন্দীপে। আবুল হাসান ছিলেন তাঁদেরই একজন। আর অপরজন তাঁর বন্ধু হাফেজ তালহা। সরন্দীপের রাজার জন্য তাঁদের আগমন যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি স্থানীয় আরব কমিউনিটি ও আবদুশ শামসের জন্যও তাঁরা ছিলেন পরম কাক্সিক্ষত মেহমান।
আবদুশ শামস নিজেই তাঁদের মেহমানদারির ইন্তেজাম করেন। তাঁদেরকে নিজ বাড়িতে আপ্যায়িত করেন। তাঁদের ব্যবসায়িক পণ্য বিক্রির উপযুক্ত বন্দোবস্ত করে দেন। পণ্যের মধ্যে ছিল আরবের তাজাদম ৫০টি ঘোড়া। সরন্দীপের অভিজাত ব্যক্তিবর্গ ঘোড়াগুলো কিনতে ভিড় জমিয়েছিলেন আবদুশ শামসের দহলিজে, ইত্যবসরে রাজার তরফে দূত আসে, জানায়, আগন্তুক আরব ব্যবসায়ীদের সবগুলো ঘোড়া দ্বিগুণ দামে খরিদ করতে চান রাজা। এবং মেহমান-দুজনকে আবদুশ শামসসহ তাঁর দরবারে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
আবুল হাসান ও হাফেজ তালহাকে নিয়ে রাজদরবারে হাজির হন আবদুশ শামস। দুই মেহমানের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয় রাজার। আরবদের নতুন ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত জানেন তাঁদের কাছ থেকে। জেনে নেন সেখানকার বর্তমান রাজনীতির হালচাল। এবং ইসলামের সৌন্দর্য ও অভাবিত বিজয়ধারার ব্যাপারে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। ফেরার সময় প্রচুর উপঢৌকনও প্রদান করেন আবুল হাসান ও হাফেজ তালহাকে।
আবুল হাসান ও হাফেজ তালহার প্রচেষ্টায় কয়েকদিনের ভেতর আরব কমিউনিটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আবদুশ শামসও। হাফেজ তালহা কুরআন থেকে তেলাওয়াত করে শোনান সবাইকে। তাঁর তেলাওয়াতে ছিল বিশেষ মুগ্ধতা। যেন বহুকাল তাঁরা এই সুর ও আহŸানের ইন্তেজারে ছিলেন। আবদুশ শামসের নাম পাল্টে রাখা হয় আবদুল্লাহ।
সালমা তখন বিয়ের উপযুক্ত। বাবার সঙ্গে তিনিও ইসলাম কবুল করেছেন।
আবুল হাসানের প্রতি আবদুল্লাহর বিশেষ মুগ্ধতা শুরু থেকেই। তিনি নিজের মেয়ের জন্য তাঁর কাছে প্রস্তাব পেশ করলেন। আবুল হাসানেরও ঘর বাঁধার এরাদা। আবদুল্লাহর প্রস্তাব তাঁর জন্য ছিল ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’র মতো। আরব ভ‚খÐ থেকে বহু দূরে থাকা এ আরব সরদারের কন্যার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হওয়াকে তিনি নিজের জন্য গৌরবময় মনে করলেন।
সালমাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বরণ করে নিলেন আবুল হাসান। শুরু হলো নতুন সংসার।
আবদুল্লাহর খ্যাতি, পরিচিতি ও প্রচেষ্টার বদৌলতে আবুল হাসান সরন্দীপে তাঁর ব্যবসায়িক কর্মকাÐ বেশ চাঙ্গা করে নিলেন। অনেক মুনাফা অর্জন করেন তিনি ব্যবসা থেকে। কয়েক বছরের মধ্যে সুন্দর একটি বাড়িও নির্মাণ করে ফেলেন। ব্যবসার পাশাপাশি ইসলাম প্রচারের কাজেও তিনি সময় ব্যয় করেন। তাঁর ও হাফেজ তালহার প্রচেষ্টায় স্থানীয় কয়েকটি পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছে। নিজের আবাসস্থল নির্মাণের পাশাপাশি মুসলিম ছেলেমেয়েদের দ্বীন শিক্ষার জন্য একটি মাদরাসাও স্থাপন করেন আবুল হাসান। হাফেজ তালহাকে নিযুক্ত করেন শিক্ষক হিসাবে।
বিয়ের দু বছরের মাথায় সালমা-আবুল হাসানের কোল আলোকিত করে পুত্র খালিদের আগমন ঘটে। তারও দু বছর পর জন্ম নেয় কন্যা নাহিদ।
কয়েক বছরের ব্যবধানে সালমার বাবা আবদুল্লাহর ইন্তেকাল হয়ে যায়। ইসলাম গ্রহণের ফলে এক অভাবিত সৌভাগ্য আর অনিঃশেষ তৃপ্তি নিয়ে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।
ব্যবসা ও অন্যান্য ব্যস্ততার মধ্যে পুত্রকন্যাকে বিশেষভাবে সময় দেন আবুল হাসান। নিজ তত্ত¡াবধানেই তাদেরকে ইসলামের মৌলিক আহকাম ও উত্তম তরবিয়ত শিক্ষা দিতে থাকেন। সেই সঙ্গে শোনাতে থাকেন মুসলমানদের শৌর্য ও দিগি¦জয়ের গল্প। কচি কোমল দুই হৃদয়ে গেঁথে দিতে থাকেন ইসলামের শাশ^ত চেতনা। তাদেরকে তিনি শৈশব থেকেই চাচ্ছিলেন বীরত্বপূর্ণ মানসিকতায় গড়ে তুলতে। বিশেষত খালিদ যখন একটু বড় হলো, তাঁকে তীর ও তরবারি চালনা, ঘোড়সওয়ার ইত্যাদি যুদ্ধবিদ্যা শেখাতে থাকেন। ফলে দেখা গেলÑখালিদ যত বড় হচ্ছিল তাঁর বীর-বাহাদুরির সুনাম ততই ছড়িয়ে পড়ছিল চতুর্দিকে।
ব্যবসার বদৌলতে দুনিয়াবি ঐশ^র্যের কোনো কমতি ছিল না আবুল হাসানের। আল্লাহ তাঁকে অঢেল দৌলতের মালিক বানিয়েছিলেন কয়েক বছরের মধ্যেই। সেই সঙ্গে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল তাঁর সুখের সংসার। কিন্তু ধন-দৌলত ও স্ত্রীসন্তানাদি তাঁকে আল্লাহর পথের সফর থেকে গাফেল করতে পারেনি। সরন্দীপে আসার পর প্রায় প্রতি বছর তিনি দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য সামুদ্রিক পথ অতিক্রম করে হজব্রত পালন করেছেন। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য এশিয়া মাইনর এমনকি দূর আফ্রিকার রণাঙ্গনেও শামিল হয়েছেন একাধিকবার। জিহাদ ও হজের সফর যেন তাঁর প্রতি বছরের রুটিনে পরিণত হয়েছিল।
সফরের সময়টুুকুতে পুত্রকন্যার শিক্ষাদীক্ষা ও তরবিয়তের ভার অর্পিত থাকত হাফেজ তালহার ওপর। সফর থেকে ফিরেই আবুল হাসান দুই সন্তানের শিক্ষাদীক্ষা ও যুদ্ধবিদ্যার পরীক্ষা নিতেন। সময়ের সাথে সাথে খালিদ যেমন তীরন্দাজি, ঘোড়দৌড়, তলোয়ার চালনা ও নৌযান ড্রাইভে পারদর্শী হয়ে উঠছিল, তেমনি নাহিদও উদ্ধত ঘোড়া বশ করার কৌশল শিখে ফেলেছিল মাত্র ১২ বছর বয়সে। দুই সন্তান যেন কুরআনের ভাষায় সত্যিকার অর্থেই আবুল হাসানের কুররাতু আইয়ুনে (চোখের শীতলতা) পরিণত হয়েছিল।
সরন্দীপের রাজার সঙ্গে আবুল হাসানের ভালো খাতির ছিল। এমনকি রাজার পরিবারের সঙ্গেও গড়ে উঠেছিল তাঁর পরিবারের গভীর সখ্যতা। ফলে রাজা ছিলেন তাঁর ভালো একজন বন্ধু এবং হিতাকাক্সক্ষীও।
এরই মধ্যে মুসলিম খেলাফতের কেন্দ্রীয় রাজধানী দামেস্কে নেতৃত্বের পালাবদল ঘটে। খলীফার মসনদে বসেছেন ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক। নতুন নেতৃত্ব আগমনের ফলে খেলাফত-কাটামোতে নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। বেগবান হয়েছে মুসলমানদের নিত্যনতুন বিজয়ের ধারা।
ততদিনে আবুল হাসানের সরন্দীপে বসবাসের প্রায় দুই দশক পূর্ণ হতে চলেছে। গেল বছর তিনি হজে যেতে পারেননি। ফলে মুসলিম বিশে^র খবরাখবরের বিস্তারিত কিছুই জানতে পারছিলেন না। একদিন সিন্ধি ব্যবসায়ীদের একটি জাহাজ সরন্দীপের বন্দরে নোঙর করে। সরন্দীপের মুসলমানরা জানতে পারেনÑমুসলমানদের অজেয় সিপাহসালারদের নেতৃত্বে একদিকে তুর্কিস্তান বিজিত হয়েছে, অপরদিকে বিজয়ের পতাকা ওড়াতে ওড়াতে তাঁরা দক্ষিণ আফ্রিকার গহীনেও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ওমানের একজন খ্রিষ্টানও ছিল। সেও এ সংবাদের সত্যায়ন করে।
আবুল হাসানের তর যেন আর সইছিল না। তিনি আফসোস করতে লাগলেন, মুসলমানরা বরকতপূর্ণ বিজয়গুলো অর্জন করে নিচ্ছে, অথচ তিনি কোনো হিসসা নিতে পারছেন না সেখান থেকে! না, এভাবে বসে থাকলে হয় না। আবুল হাসান সিদ্ধান্ত নিলেনÑযত দ্রæত সম্ভব তিনি সফরে বেরোবেন। খেলাফতের কেন্দ্রীয় ভ‚মি দামেস্কে গিয়ে যেকোনো মুজাহিদ বাহিনীতে নাম লেখাবেন। তার আগে কোনো এক ফাঁকে হজ ও রওজা পাকের জিয়ারতটাও সেরে নেবেন।
তাঁর এ সিদ্ধান্তের খবর রাজা জানতে পারেন। তিনি আবুল হাসানকে জানানÑমুসলমানদের খলীফা ও ইরাকের গভর্নরকে তিনি কিছু উপঢৌকন পাঠাতে চান। আবুল হাসান বললেন, ‘এ তো আমার জন্য বড় খোশনসিবির ব্যাপার। আপনি উপঢৌকন প্রস্তুত করুন, আমি সযতেœ, আমানতদারিতার সাথে তা পৌঁছে দেব তাঁদের কাছে।’
আবুল হাসানের সঙ্গে সে-বছর সরন্দীপের প্রায় সকল মুসলমান হজের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। পুরুষদের মধ্য থেকে আবু তালহাসহ মাত্র তিনজন মুসলমান অবশিষ্ট ছিলেন হজযাত্রী মুসলিমদের পরিবারের দেখভালের জন্য।
অনেকে নিজ স্ত্রী-সন্তানদেরও সাথে নিয়ে যায়। আবুল হাসানও চেয়েছিলেন স্ত্রী ও পুত্রকন্যাকে সাথে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সালমার শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। বেশ কিছু দিন ধরে তিনি অসুস্থ। এ অবস্থায় তাঁকে নিয়ে সফর করা নিরাপদ নয়। আবুল হাসান তাই তাঁদেরকে আর নিতে চাচ্ছিলেন না সাথে। কিন্তু সালমার বহু দিনের তামান্নাÑতিনি আরবের ভ‚মিতে যাবেন, আল্লাহর ঘর, নবীপাকের রওজা জিয়ারত করবেন। নবীজির রওজাপাশে দাঁড়িয়ে মনের সকল আকুতি মিশিয়ে দরূদ ও সালাম পাঠ করবেন।
স্বামীকে জানালেন, এ অসুখ সফরের জন্য বাধা হবে না। তাঁকে যেন সাথে নিয়ে যাওয়া হয়। তাছাড়া আবুল হাসানের যা মনোভাব এবং প্রস্তুতি, এ সফর অনেক দীর্ঘ হবে, কবে ফিরবেন তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তাই সালমা নাছোড়বান্দা, তাঁকে এ সফরে সাথে নিতেই হবে।
আবুল হাসান বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, যাত্রার দিনে যদি তুমি মোটামুটি সুস্থ থাকো, নিয়ে যাব।’
এ দিকে খালিদও মনে মনে যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ১৮ বছরের টগবগে নওজোয়ান সে। আশৈশব যে যুদ্ধবিদ্যা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে, যে শৌর্য সে অর্জন করেছে, তা প্রদর্শনের জন্য তর যেন আর সইছিল না তার। সে মনে মনে ভাবে, আব্বা এবার নিশ্চয় তাকে সাথে নিয়ে যাবেন। দূর রণাঙ্গনে মুসলিম ফৌজের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে লড়াই করবে কাফিরদের বিরুদ্ধে। তার রক্তে টগবগ করছে জিহাদের তামান্না।
কিন্তু যাত্রার আগের দিন ভাইবোন উভয়কে বাবা আলাদা করে ডাকলেন। বললেন, ‘তোমাদের সবাইকে তো সাথে করে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। বিশেষত, খালিদের এখন যুদ্ধের বয়স হয়েছে, দামেস্কে তাঁকে মুসলিম বাহিনীতে ভর্তি করিয়ে দেওয়া অতি জরুরি ছিল। কিন্তু তোমাদের মায়ের শরীর খারাপ। আমি বলেছি, আগামীকাল অবধি যদি সুস্থ হয়ে যায়, তাহলে সাথে নেব। কিন্তু শরীরের যা অবস্থা, আগামীকাল সে সেরে উঠবে বলে মনে হচ্ছে না। এ দিকে নাহিদ ও তোমাদের মাকে একা রেখে যেতে ভরসা পাচ্ছি না। বেটা খালিদ, এ যাত্রায় তাই তোমাকে মায়ের খেদমতে থেকে যেতে হবে। ইনশাআল্লাহ, আমি ফেরার পর অথবা সেখানে পৌঁছে তোমাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারলে লোক পাঠিয়ে তোমাদের নিয়ে যাব।’
পরদিন সরন্দীপ বন্দরে রাজকীয় সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়েছে একটি জাহাজ। সরন্দীপের রাজার তরফ থেকে মুসলিম গভর্নর ও খলীফার জন্য হিরা-জহরত ও সোনাদানার মূল্যবান উপঢৌকন তোলা হয়েছে জাহাজে। যাত্রীরাও সকলে উঠে গেছেন। কাফেলার আমির আবুল হাসান সবাই উঠল কি না, মালপত্র সব তোলা হলো কি না ইত্যাদি তদারকি করে রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সবার শেষে জাহাজে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সালমার প্রচÐ জ¦র। এ জ¦রে তাঁর বিছানায় থাকার কথা। থরথর করে কাঁপছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর অসুখের কথা স্বীকার করতে রাজি না। বারবার বলছিলেন তিনি সুস্থ আছেন। আবুল হাসান যেন তাঁকে সাথে করে নিয়ে যান। এমনকি যাত্রার সময় বন্দরে এসে পর্যন্ত হাজির হয়েছেন। খালিদ ও নাহিদ বারবার মানা করছিল, কিন্তু তিনি যেন কোনোকিছুই মানছিলেন না। দাঁড়িয়ে আছেন ঘাটে। রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবুল হাসান যখন জাহাজে উঠতে যাবেন, সালমা পথ আগলে দাঁড়ালেন।
‘আমাকে সাথে নিয়ে যান। আমি সুস্থ, সম্পূর্ণ সুস্থ।’ সালমার ভেতর ফেটে যেন কান্না আসছে। তিনি কান্নাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কপোল বেয়ে ঝরছে অবাধ্য অশ্রæর ধারা।
আবুল হাসান শান্ত-গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘সালমা, আমাদের ২০ বছরের সংসার, তোমার ইসলাম কবুলেরও ২০ বছর হয়েছে, সংসারজীবনের শুরু থেকেই মুসলিম নারীদের করণীয় সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে কত আলোচনা হয়েছে! কত গল্পঘটনা বর্ণনা করেছি বীরাঙ্গনা মুসলিম নারীদের! মুসলিম নারীরা তো স্বামী-সন্তানের যুদ্ধযাত্রায় কান্না করেন না, বরং নিজ হাতে পরিয়ে দেন যুদ্ধের পোশাক। কিন্তু তুমি এ কী করছ!’
সালমার কান্না যেন হঠাৎ থেমে গেল। চোখের অশ্রæ মুছে নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনি চলে যাচ্ছেন বলে আমি কাঁদছি না, বরং আমার দুঃখ হলো আপনার সাথে আমি যেতে পারছি না। যুদ্ধের ময়দানে নারীদেরও তো কাজ আছে, আহতদের সেবা ও দেখভাল করতে হয়। আপনি আমাকে নিয়ে গেলে আপনার বিরহের ভার আমার সইতে হতো না। রোজ রোজ অপেক্ষার আগুনে পুড়তে হতো না আমার দুর্বল হৃদয়।’
‘কিন্তু এ অপেক্ষা আর ধৈর্যটাই তো নারীদের জিহাদ, সালমা! মুসলিম সেপাহি যদি রণাঙ্গনে যায় আর তার মনে এ চিন্তা সারাক্ষণ অস্থিরতা তৈরি করে রাখে যে, বাড়িতে তার স্ত্রী/কন্যা/জননী কেঁদে কেটে অস্থির হচ্ছে, তাহলে সে কি হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করতে পারবে আল্লাহর পথে? মুসলিম নারীরা ধৈর্য ধরে থাকতে পারে বলেই মুসলিম পুরুষরা পৃথিবীর দিকদিগন্তে ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডীন করে চলেছে।’
‘আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ধৈর্য এবং ইন্তেজারকেই আমার আরাধনা হিসেবে নিলাম।’ মুখে হাসি টানার বৃথা চেষ্টা করে আবুল হাসান ও তাঁর কাফেলাকে বিদায় জানালেন সালমা। তাঁদের সবাইকে সঁপে দিলেন আল্লাহর হাতে।
***
সেই যাত্রার প্রায় ছয় মাস গত হতে চলল। এখনও কোনো খবর পাওয়া যায়নি কাফেলার। সাধারণত যাত্রার মাসখানেকের ভেতর বন্দরে আগত যে-কোনো কাফেলার কাছে সেই কাফেলার খবর থাকে। কিন্তু আবুল হাসানের জাহাজের খবর কারও কাছে নেই। কেউ তাদের দেখেনি।
সালমা প্রতিটা ক্ষণ স্বামীর কাফেলার কোনো খবরের অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু কোনো হদিশ নেই তাঁদের। সরন্দীপের রাজাও পেরেশানি করছেন। ইতিমধ্যে তিনি স্বীয় সেনাপতি দিলিপ সিংহের নেতৃত্বে একটি বাহিনীও প্রেরণ করেছেন তাদের খোঁজে। কিন্তু তাদেরও এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজ নেই।
স্বামীর জন্য পেরেশানি করতে করতে সালমা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দিন দিন তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। ক্রমশ মুমূর্ষু হয়ে পড়ছেন তিনি। পুত্রকন্যা সারাক্ষণ তাঁর সেবায় নিয়োজিত। একদিন তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোদের আব্বাকে বলিস, আমাকে ক্ষমা করে দিতে। তাঁর ওয়াদা আমি রাখতে পারিনি। অপেক্ষা ও ধৈর্যের ভার তাঁর কাছেই ফেরত দিয়ে গেলাম। আমি আশা রাখি, আমার আল্লাহ পরপারে আমাদের একত্রিত করবেন।’
ছয় মাসের মাথায় ধৈর্য আর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সালমা নিজেই পাড়ি জমালেন পরপারের ঠিকানায়।
তাঁর জানাযা ও দাফন সেরে লোকজন যখন বাড়ি ফিরছিল, রাজার সেনাপতি দিলিপ সিংহকে তখন দেখা গেল বিধ্বস্ত অবস্থায় রাজপ্রাসাদের দিকে ছুটছেন। একজন আজনবি ছাড়া আর কেউই নেই তাঁর সাথে।