সমাজ ও রাষ্ট্রে টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সুশাসন। আমরা যতই উন্নয়নের কথা বলি, সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে কখনোই টেকসই উন্নয়ন সর্বজনীনভাবে কার্যকর হতে পারে না। আমাদের দেশে সুশাসন কতটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে বা আদৌ আছে কি না, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর এসেও এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের নীতি-নির্ধারকগণ, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, আইন-প্রণেতা এমনকি দেশের আম-জনতা সকলেই একমত। সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সর্বমহলে অনস্বীকার্য ও আলোচ্য বিষয়। আমাদের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সেমিনার আয়োজন, গোলটেবিল আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখন ও রিপোর্ট প্রকাশ করে যাচ্ছেন। এসব প্রকাশনাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়সমূহ চিহ্নিত করা হলেও টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষার ওপর কাঙ্ক্ষিত গুরুত্বারোপ করছেন না।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধের একমাত্র উৎস হলো ইসলামী শিক্ষা। ইসলামী শিক্ষাকে উপেক্ষা করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছুই করা হোক না কেন, সবকিছুই হবে হতাশাব্যঞ্জক।
ইসলামী শাসনব্যবস্থায় সকল বিধানের উৎস হিসেবে কুরআন ও সুন্নাহ অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করে। এ শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার সব রকমের উপনাদান রয়েছে।
সুশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জবাবদিহিতা। জবাবদিহিতার ভয় না থাকলে শাসকশ্রেণি স্বৈরাচারী হয় এবং দুর্নীতি বাড়ে। জবাবদিহিতা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “অতএব আপনার পালনকর্তার কসম, আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করব, সেই বিষয়ে যা তারা করে।” (সূরা হিজর : আয়াতক্রম : ৯২-৯৩)
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবার জন্য ন্যায়বিচার আরও একটি অপরিহার্য উপাদান। বিচারব্যবস্থায় যে সমাজে সাম্য নেই, সে সমাজে প্রকৃত সুশাসন সুদূর পরাহত। পেশাদারিত্ব ও স্বাধীন বিচার বিভাগের গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
‘ন্যায় বিচারকগণ (কিয়ামাতের দিন) আল্লাহর নিকটে নূরের মিম্বারসমূহে মহামহিম দয়াময় প্রভুর ডানপার্শ্বে উপবিষ্ট থাকবেন। তার উভয় হাতই ডান হাত (অর্থাৎ, সমান মহিয়ান)। যারা তাদের শাসনকার্যে তাদের পরিবারের লোকদের ব্যাপারে এবং তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বসমূহের ব্যাপারে সুবিচার করে।’ (মুসলিম, হাদীসক্রম : ৪৬১৫)
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সংস্থা বর্তমানে আমাদেরকে যে-সব সবক শিক্ষা দিচ্ছে, ইসলাম সে সম্পর্কে আমাদেরকে আরও সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে ১৪০০ বছর আগেই। ইসলামী আইন ও অনুশাসনের সামগ্রিক কল্যাণ পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশের প্রখ্যাত মুসলিম রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ‘আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া’ ইসলামী আইনের বেশকিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো-
১. ইসলামী আইন সকল প্রকার জুলুম, নির্যাতন, পক্ষপাতিত্ব ও বাড়াবাড়ি মুক্ত।
২. ইসলামী আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে আত্মিকভাবেও পরিশুদ্ধ করে।
৩. এ আইনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইন মেনে চলার অনুপ্রেরণাদায়ক শক্তি বিদ্যমান রয়েছে।
৪. ইসলামী আইন সর্বজনীন ও সর্বকালীন।
৫. এ আইন মানুষের জাগতিক সফলতার সর্বোচ্চ পন্থা নির্দেশ করে। পাশাপাশি মানুষের নৈতিক মানকেও উন্নত করে।
তাই, দেশ ও জাতির উন্নয়নকে আরও টেকসই করতে এবং রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ইসলামী শাসনপদ্ধতি অবলোকন করাই একমাত্র নিরাপদ পন্থা। আমাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা ও তাঁর নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও তাকওয়ার গুরুত্ব, তাৎপর্য অনুধাবন করে দৃপ্ত কদমে এগিয়ে চলতে হবে।
সালাহ উদ্দীন তারেক
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মাসিক হেফাজতে ইসলাম