সম্পাদকীয়, ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সংখ্যা

পাঠ্যপুস্তকে অনৈতিকতার সবক : প্রয়োজন সর্বমহলের সোচ্চার প্রতিবাদ

 

একটা গল্পের অংশবিশেষ দিয়ে এ সংখ্যার সম্পাদকীয় শুরু করি। গল্পটি সংকলিত হয়েছে নতুন পাঠ্যক্রমে সপ্তম শ্রেণিতে পঠিত ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন’ বইয়ে। একজন হিজড়ার গল্প। পড়া যাক-

শরীফা বললেন, যখন আমি তোমাদের স্কুলে পড়তাম তখন আমার নাম ছিল শরীফ আহমেদ। আনুচিং অবাক হয়ে বলল, আপনি ছেলে থেকে মেয়ে হলেন কী করে? শরীফা বললেন, আমি তখনও যা ছিলাম এখনও তাই আছি। নামটা কেবল বদলেছি। ছোট বেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময়ে বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে।

ফাতেমা : কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ছেলে-মেয়েদের চেহারা, আচরণ কাজ বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কোনো স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম নেই।

খুশি আপা : ঠিক বলেছ!

গুমন : আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমরা যেমন করে ভাবছি, অনেকেই তার চেয়ে ভিন্ন রকম করে ভাবে।

গাবা : কিন্তু সবার তো নিজের মতো, নিজের অনুভূতি, নিজের পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশের স্বাধীনতা আছে!

খুশি আপা : যতক্ষণ না তাতে অন্যের কোনো ক্ষতি হচ্ছে, ততক্ষণ নিশ্চয়ই আছে।

শিহান : তাহলে শরীফা আপারা কার কী ক্ষতি করেছেন?

খুশি আপা : একটি শিশু যখন জন্ম নেয় তখন তার শরীর দেখে আমরা ঠিক করি সে নারী নাকি পুরুষ। এটি হলো তার জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়। জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে একজন মানুষের কাছে সমাজ যে আচরণ প্রত্যাশা করে তাকে আমরা ‘জেন্ডার’ বা ‘সামাজিক লিঙ্গ’ বলি। জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়ের সঙ্গে তার জেন্ডার ভূমিকা না মিললে সমাজের প্রথাগত ধারণায় বিশ্বাসী মানুষেরা তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

সপ্তম শ্রেণিতে বাচ্চারা যে সময়টায় পাঠ নেয়, সাধারণত তারা তখন বয়ঃসন্ধিকাল পার করে। এই সময়টায় তাদের চিন্তা-চেতনা বিকশিত হয়। উদ্ধৃত গল্পাংশ ভালোভাবে পড়ে থাকলে বুঝার কথা, এসব গল্প ও বয়ানের মাধ্যমে টিনএজ ছেলেমেয়েদের কী শেখানো হচ্ছে। এই গল্পাংশের সারমর্ম যদি আমরা উদ্ধার করি তাহলে ভাষ্যটি এমন দাঁড়ায়- ‘একটি শিশু জন্মগ্রহণ করলে সমাজ ঠিক করে দেয় সে পুরুষ হবে নাকি নারী! কিন্তু সমাজ যা-ই বলুক, তোমার শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যা-ই বলুক, তুমি যদি মনে করো তুমি একজন পুরুষ, তাহলে তুমি পুরুষ। আর তুমি যদি মনে করো তুমি একজন নারী, তাহলে তুমি একজন নারী। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি কারও ক্ষতি করছ না, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার এই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আছেই।’

কী শেখানো হচ্ছে বাচ্চাদের বুঝতে পারছেন? ভয়ানক ক্ষতিকর ও বিষাক্ত একটি চিন্তা বাচ্চার মগজে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে- ‘যতক্ষণ তুমি অন্য কারও ক্ষতি করছ না, ততক্ষণ যা ইচ্ছা করতে পারো, কোনো বাধা নেই!’ অথচ এ কথাটিতে এমন মারাত্মক বিষের মিশ্রণ আছে যার মাধ্যমে সমকামিতা, ইনসেস্ট, ট্রান্সজেন্ডার ইত্যাদির মতো বিকৃত রুচির প্রবণতা পুরো পশ্চিমা বিশ্বকে কলুষিত করেছে। পশ্চিমা বিশ্ব এই বিষাক্ত মূলনীতির কারণে যে-সকল অনৈতিকতায় জর্জর, তার কিছু নমুনা এমন-–

*আপন ভাই-বোন বলছে- আমরা একে অপরকে পছন্দ করি এবং শারীরিক সম্পর্ক করি। আমরা তো কারও ক্ষতি করছি না। শুধু ভাই-বোন নয়, বাবা-মেয়ে, মা-ছেলের মধ্যেও এমন ঘৃণ্য ঘটনা অনেক আছে। গুগলে সার্চ দিলে অহরহ এমন ঘটনা পাবেন।

*আমেরিকান নেভি সিলের এক চৌকশ পুরুষ অফিসার, হঠাৎ তার মনে হলো সে আসলে নারী! পুরুষের শরীরে আটকা পড়েছে। তাই অপারেশন করে সে নারী হয়ে গেল। পরে অবশ্য আফসোস করে সে স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে, এটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। বাংলাদেশের প্রাইভেট ক্লিনিকের মতো পশ্চিমা বিশ্বে জেন্ডার চেঞ্জের ক্লিনিক গড়ে উঠছে। মূলত উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীরা আবেগের বশে অনেক কিছু ভাবে। এই আবেগকে কাজে লাগিয়েই তাদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে কথিত প্রগতিশীল আর ব্যক্তি-স্বাধীনতার পূজারীরা।

*পশ্চিমা দেশগুলোতে মাদককে বৈধ করা হয়েছে। বিনোদনের জন্য মাদক সেবন করা যাবে, যেহেতু অন্য কারও ক্ষতি করা হচ্ছে না! অথচ মাদকসেবীর জীবনই যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেটাকে তারা সুকৌশলে আড়াল করে যায়।

*সারা বিশ্বে যেভাবে সমকামিতার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে, এ ক্ষেত্রেও এই আত্মপরিচয় ও হার্ম প্রিন্সিপাল হচ্ছে মূল। আমি পুরুষ, অন্য পুরুষের সাথেই শারীরিক সম্পর্ক করতে আমার ভালো লাগে। অন্য কারও তো ক্ষতি করছি না। বা, আমি নারী, অন্য নারীর প্রতিই আমি শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করি। অন্য কারও তো ক্ষতি করছি না।

চিন্তা করুন! একটি গল্প আপনার সন্তানকে কী পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে! আমি বলছি না- এ গল্প ও পাঠের মাধ্যমে আপনার সন্তান হুবহু এমন হয়ে যাবে, কিন্তু তার মন-মেজাজে নির্ঘাত পরিবর্তন আসবে। বিকৃত রুচির এসব কালচার আপনার কাছে যেমন অস্বাভাবিক লাগছে তার কাছে তেমন লাগবে না, সে স্বাভাবিকভাবেই এগুলোকে গ্রহণ করবে। আবার তার পরবর্তী প্রজন্ম সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে এসব কাজে।

জি হ্যাঁ, এটাই এই পাঠের পরিণতি।

নতুন পাঠ্যপুস্তকের এ তো কেবল একটি ভয়াবহতার কথা বললাম। ২০২৩ সাল থেকে সারাদেশে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে স্কুল ও মাদরাসায় অভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে পাঠদানের আওতায় যে পুস্তকগুলো রচিত হয়েছে, তার সামগ্রিক চিত্র আরও ভয়াবহ। পুরো চিত্রটিতে নজর দিলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন- ইসলামবিদ্বেষ, মুসলিম ইতিহাসের বিকৃত বয়ান এবং যৌন বিকৃতি স্বাভাবিকীকরণের মধ্য দিয়ে আপনার সন্তানের ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করার সুপরিকল্পিত একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

ইতিমধ্যে ধর্মীয় অ্যাক্টিভিস্টরা এ ব্যাপারে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছেন, যার ফলশ্রুতিতে নতুন পাঠ্যপুস্তকের ‘অসঙ্গতি’ দূর করার লক্ষ্যে ধর্মীয় অথরিটি-সহকারে পর্যালোচনা করা হবে মর্মে শিক্ষামন্ত্রী ইতিমধ্যে ‘আশ্বাসবাণী’ও শুনিয়েছেন, কিন্তু এ পর্যালোচনার দ্বারা অসঙ্গতিগুলো কতটা বিদূরিত হবে তা যথেষ্ট সন্দেহের দাবি রাখে। কেননা, ইতিপূর্বে পাইলটিং কার্যক্রমের সময় বইগুলোর কন্টেন্টে আপত্তি তুলেছিলেন আলেমরা। তখন শিক্ষামন্ত্রী বইগুলো পরিমার্জন করার নির্দেশনা দেওয়া সত্ত্বেও বই প্রকাশিত হবার পর দেখা গেছে, বইয়ের কিছুই পরিবর্তন করা হয়নি।

সুতরাং সর্বমহল থেকে বিশেষত যাঁরা অভিভাবক আছেন, নিজেদের বাচ্চাদের চিন্তা-চেতনার হেফাজতের জন্য, চরিত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই বিষয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ ও সচেতনতা জারি রাখতে হবে। নয়তো প্রগতি, মানবাধিকার আর ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো মুখরোচক শ্লোগানের আড়ালে এ দেশের মুষ্ঠিমেয় ইসলামবিদ্বেষী মহল আপনার সন্তানকে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে। গড়ে উঠবে ধর্ম ও নৈতিকতাবিবর্জিত একটি অসুস্থ প্রজন্ম।

 

হামমাদ রাগিব

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT