প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়কন্যা ফাতেমাতুয যাহরা রাদিয়াল্লাহু আনহা। যিনি জান্নাতের সকল নারীর সরদার। শেরে খোদা হযরত আলী রা.-এর জীবনসঙ্গিনী এবং জান্নাতের সকল যুবকের সরদার হাসান হুসাইন রা.-এর সম্মানিত মাতা। সেই সৌভাগ্যবান নারীর জীবনী আমাদের সঠিক পথের দিশা। তাঁর জীবনী পড়ে সেই অনুযায়ী জীবন সাজালে দুনিয়া ও আখেরাত হবে সফল।
জন্ম ও শৈশব
ফাতেমাতুয যাহরা রা. এমন একদিনে জন্মগ্রহণ করেন, সেই দিনটি হল মক্কার ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। মক্কার নেতৃবর্গ এবং অন্যান্যরা মিলে কাবা শরীফ নতুন করে মেরামত করেছেন। সকল কাজ শেষ। একটিমাত্র কাজ বাকি। হজরে আসওয়াদ স্বস্থানে রাখা। একাজ করার বিরল সম্মান অর্জন করবে কোন গোত্র এ নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। অবশেষে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছালো আমরা এই মসজিদে অপেক্ষয় থাকি আর দেখি কে এই মসজিদে প্রথম প্রবেশ করে। যেই প্রথম প্রবেশ করবে তাকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর ক্ষমতা দেওয়া হবে। সবাই মসজিদের প্রধান দরজার পানে চেয়ে থাকলেন অজানা সিদ্ধান্তদাতার অপেক্ষায়। হঠাৎ তারা লক্ষ করলেন কে একজন আসছেন। যাঁর হাঁটার ভঙ্গিতে রয়েছে অদ্ভুত ধরনের আকর্ষণ। আওে, সবার প্রিয় মুহাম্মদ! পরম সৌভাগ্য! এই সৎ ও বুদ্ধিমান তরুণের হাতেই যাচ্ছে সিদ্ধান্তের ব্যাপারটি। হন্তদন্ত হয়ে সবাই ছুটে গেল তার কাছে, জানালো তাদের সিদ্ধান্তহীনতার কথা। সব শুনে তিনি তাদেরকে একটি চাদর আনতে বললেন। পবিত্র হাজারে আসওয়াদ নিজ মুবারক হাতে সেটার উপর রাখলেন। এরপর বললেন, প্রত্যেক গোত্রের একজন করে চাদরটি উঠিয়ে হজরে আসওয়াদের জায়গায় নিয়ে যাও। অতঃপর তরুণ মুহাম্মদ সেটি তুলে জায়গামতো রেখে দিলেন।
তিনি কাবা শরীফে এসেছিলেন সন্তানসম্ভবা স্ত্রী খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহার জন্য দুআ চাইতে। সমস্যার সমাধান করে তিনি যখন বাড়িতে ফিরলেন, তখন তাঁর চতুর্থ কন্যা কলিজার টুকরা ফাতেমার জন্মের সংবাদ শুনলেন। মহান আল্লাহর কাছে জানালেন হাজারো শুকরিয়া। মা অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকলেন গোলাপের পাপড়ির মতো সুন্দর মেয়েটির দিকে। এ যেন হুবহু তাঁর বাবারই প্রতিচ্ছবি। ফাতেমা রা.-এর আকৃতি ও গঠনাদি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুরূপ। তাঁর ওষ্ঠধর ছিল লাল, দেহ মুবারক ছিল চাঁদের মতো উজ্জ্বল, মুখমÐল ছিল সদা হাস্যমুখর কিন্তু প্রকৃতি ছিল গাম্ভীর্যপূর্ণ। ফুটফুটে এই সন্তানের প্রতি বাবা-মা অকাতরে ঢেলে দিলেন সকল ¯েœহ-মমতা। বাবা-মায়ের পরম ¯েœহ আর তিন বোনের আদর-যতেœ ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন সবার ছোট আদরের দুলালী ফাতেমা। সীমাহীন ভালবাসা পেলেও সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে তাকে দেখতে হয়েছে বাবার প্রতি কোরাইশদের নিষ্ঠুর আচরণ, জুলুম-নির্যাতন। বাবা নবুওয়াত পাওয়ার পর ছোট্ট ফাতেমা দেখলেন পৃথিবীর সবাই যেন তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে চলে গেল। একের পর এক ভয়াবহ সব পরিস্থিতি তাঁকে প্রত্যক্ষ করতে হলো। অল্প কয়েকটা বছরের শান্তি সত্য-মিথ্যার তোড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ফাতিমার খেলার সঙ্গী-সাথীরাও যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। এদিকে কুরাইশরা তাদের জুলুমের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল। দাওয়াতের কাজে বাবার সাথে লেগে থাকার কারণে তাকেও নানা ধরনের অত্যাচার সইতে হচ্ছে। ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে, সন্তানদের মধ্যে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্যের সংগ্রামে তাঁর এই ছোট্ট মেয়েটিকে কাছে পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। ন্যায়ের যুদ্ধে কোমল শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন বাবার পাশে।
দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে নবীপরিবারের বড় সান্ত¡না ছিলেন হাশেমী পরিবারের এক ছোট্ট বালক। তিনি হলেন প্রথম সারির মুসলমান। মুসলমান হওয়ার কারণে তাঁর উপর বয়ে যায় নানা দুঃখ-কষ্ট। নানা দুঃখ-কষ্ট সয়েও ছিলেন সর্বদা ঈমানের উপর অটল। থেকেছেন সদা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে। যুদ্ধের ময়দানে তিনি ছিলেন বীর সেনাদের একজন। আর সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হলো, তাঁর সঙ্গে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের কলিজার টুকরা আদরের দুলালী হযরত ফাতেমাতুয যাহরা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ে দেন। রাসূলের এই সম্মানিত জামাতার নাম শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু।
বিয়ে
হযরত ফাতেমাতুয যাহরা রা.-এর বিয়ের মোহর ছিল চারশ মিসকাল রুপা। আর ব্যবহারসামগ্রী হিসাবে ছিল খেজুর আশের একটি তোষক, একটি পানির কলস মাটির দুটি মটকা এবং একটি চাদর। বিয়ের আকদ সম্পন্ন হওয়ার পর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে সালমা রা.-কে ডেকে বললেন, কনেকে তার স্বামীর ঘরে দিয়ে আসতে এবং বলে দিলেন তারা দুজন যেন নবীজির জন্য অপেক্ষা করে। কিছুক্ষণ পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ঘরে গেলেন এবং একপাত্র পানি দিতে বললেন। অতঃপর তিনি কুরআনের আয়াত পড়ে ফুঁ দিয়ে নবদম্পতিকে খেতে দিলেন। অবশিষ্ট পানি দিয়ে তিনি ওযু করে বাকিগুলো তাঁদের মাথায় ছিটিয়ে দিলেন। যাওয়ার আগে তাঁদের জন্য দুআ করেন, হে আল্লাহ তাদের মধ্যে বরকত দাও এবং তাদের বংশধরদের মধ্যেও বরকত নাযিল করো। এভাবেই বিশ^ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিয়ের আসর শেষ হয়ে গেল।
সংসারজীবন
শুরু হলো দুজনের সংসারজীবন। সচ্ছল বিলাসিতাপূর্ণ জীবন ছিল না, ছিল না বিলাসবহুল কোন অট্টালিকা। তবে রহমত আর বরকতে ভরপুর ছিল তাঁদের জীবন। ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যভরা পরিবেশে তারা সংসার করতে লাগলেন। এভাবেই দিন চলতে থকল। তৃতীয় হিজরী সনে সমস্ত মদীনাবাসীকে খুশি করে তাঁদের কোল ভরে এলেন হযরত হাসান রা.। তাঁর বয়স যখন এক বছর থেকে কিছু বেশি তখন জন্ম হলো চাঁদের মতো আরেক ফুটফুটে সন্তান হযরত হুসাইন রা.-এর। একে একে আরো দুটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। যাঁদের নাম রাখলেন তাঁর চলে যাওয়া দুই বোনের নামে যয়নব ও উম্মে কুলসুম।
দুজাহানের বাদশা সরকারে দুআলম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কলিজার টুকরা আদরের দুলালী হযরত ফাতেমাতুয যাহরা রা. ঘরের সকল কাজ নিজ হাতে সম্পাদন করতেন। মশক ভরে আনতেন, ঘর দুয়ার ঝাড়ু দিতেন, নিজ হাতে চাক্কি পিষতেন, এমনকি চাক্কি পিষার দরুণ তাঁর হাতে দাগ পড়ে যেত। একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমত হিসাবে কয়েকজন বাঁদি পেলেন। আলী রা. ফাতেমাকে বললেন, বাবার কাছ থেকে একজন বাদি চেয়ে আনতে। যথারীতি ফাতেমা বাবার কাছে গেলেন কিন্তু আসল কথা বলতে তাঁর লজ্জা হচ্ছিল। তখন আলী রা. তাঁদের প্রয়োজনের কথা নবীজিকে জানালে তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বাঁদির চেয়ে উত্তম কিছু শিখিয়ে দেব না? অতঃপর বললেন, প্রত্যেক নামাজের পরে এবং রাতে ঘুমানোর পূর্বে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়বে। এটাই তোমাদের জন্য একজন বাদি অপেক্ষা উত্তম।
এত কাজকর্মের মধ্যেও ইবাদত-বন্দেগীতে কোনো কমতি ছিল না। ঘরের কাজ করতেন আর কুরআন মজিদের তেলাওয়াত করতেন। সারারাত কাটিয়ে দিতেন নফল নামাজে, নামাজ পড়তে পড়তে রাত শেষ হয়ে যেত আর তিনি আফসোস করে বলতেন, হায় রাতটা যদি আরো দীর্ঘ হত! দান-সদকা করার বেলাও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। দানের বহু ঘটনা তাঁর জীবনীতে পাওয়া যায়। একবার আলী রা. সারারাত পানি সেঁচের কাজ করে কিছু যব নিয়ে ঘরে ফিরলেন। ফাতেমা রা. কিছু যব পিষে রুটি তৈরি করেন। যখন খাবার খেতে বসেন, তখন এক ভিক্ষুক এসে খাবার চায়। তখন পুরোটা খাবার তিনি ভিক্ষুককে দিয়ে দেন। ২য় বার খাবার তৈরি করলে এক এতিম এসে খাবার চায়। এবার খাবারটুকু তিনি এতিমকে দিয়ে দেন। অতঃপর অবশিষ্ট যবটুকু দিয়ে খাবার তৈরি করেন। তখন এক মুশরিক কয়েদি এসে আল্লাহর ওয়াস্তে খাবার চায়। তখন তিনি সম্পূর্ণ খাবার কয়েদিকে দিয়ে দেন। আর এই দিনটি তারা না খেয়ে অনাহারে কাটান।
মুহাম্মদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, লজ্জা ঈমানের অঙ্গ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র বাণীর পুরোপুরি বাস্তবায়ন দেখা গেছে খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমাতুয যাহরা রা.-এর বর্ণাঢ্য জীবনে। তার মধ্যে লজ্জাশীলতা এত বেশি ছিল যে, তা দেখলে আজকের নারীগণ তা নিয়ে উপহাস করত। কিন্তু এ কথা চিরন্তন সত্য যে নারীত্বের মূল্যবান সম্পদ ও ঈমানের অন্যতম অঙ্গ লজ্জাশীলতা যদি কোনো নারীর জীবনে না থাকে, তাহলে সে নারীর মূল সুন্দর্য্যই থাকে না। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, একবার রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করলেন, মহিলাদের সৌন্দর্য কীসে? সাহাবায়ে কেরাম নীরব। আলী রা. চলে গেলেন ফাতেমা রা.-এর কাছে। জিজ্ঞেস করলেন মহিলাদের সৌন্দর্য কীসে? ফাতেমা বললেন, নারীর সৌন্দর্য হচ্ছে কোনো পরপুরুষ যেন তাকে না দেখে এবং সেও যেন কোনো পরপুরুষকে না দেখে।
জান্নাতের পথে…
মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের মাত্র ছয় মাস পরে ফাতেমাতুয যাহরা রা. ইন্তিকাল করেন। ১১ হিজরীর পবিত্র রমযান মাসে তিনি পাড়ি জমান জান্নাতের পথে। চলে যান প্রিয় বাবার সান্নিধ্যে।