عَنْ محمود بن لبيد الأنصاري أن النبي ﷺ قال إنَّ أخْوَفَ ما أخافُ عليكم الشِّركُ الأصْغَرُ، قالوا: وما الشِّركُ الأصْغَرُ يا رسولَ اللهِ؟ قال: الرِّياءُ؛ و زاد البيهقي في شعب الإيمان يقولُ اللهُ عزَّ وجلَّ لهم يومَ القِيامةِ إذا جُزِيَ الناسُ بأعمالِهم: اذْهَبوا إلى الذين كنتُم تُراؤون في الدُّنيا، فانظُروا هل تَجِدون عِندَهُم جزاءً؟
আলোচ্য হাদীসের তরজমা
হযরত মাহমুদ ইবনে লাবীদ আনসারী রাযি. সূত্রে বর্ণিত, নবী কারীম ﷺ বলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য যে ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বেশি ভয় করছি তা হলো- ছোট শিরক।’ সাহাবায়ে কেরাম নিবেদন করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, ছোট শিরক কী?’ নবীজি বললেন, ‘রিয়া।’ [মুসনাদে আহমাদ, হাদীসক্রম : ২৩৬৩০]
শুআবুল ঈমান গ্রন্থে ইমাম বায়হাকী রহ. এ কথাও যুক্ত করেছেন যে, (নবীজি বলেছেন), ‘কিয়ামত দিবসে যখন মানুষকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান দেওয়া হবে তখন আল্লাহ তাআলা ওই সকল লোককে বলবেন, “সে সমস্ত লোকের কাছে তোমরা যাও, যাদেরকে দেখিয়ে দুনিয়াতে আমল করেছিলে এবং দেখো তাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান পাও কি না।” [শুআবুল ঈমান, হাদীসক্রম : ৬৮৩১]
উল্লিখিত হাদীসের আলোকে এই নিবন্ধে আমরা দুটি পর্বে আলোচনা করব। প্রথম পর্বে ‘রিয়া’র পরিচয় ও প্রকারভেদের আলোচনা করা হবে। আর আগামী সংখ্যায় প্রকাশিতব্য দ্বিতীয় পর্বে আলোকপাত করা হবে রিয়া’র ভয়াবহতা ও প্রতিকার সম্বন্ধে। ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।
রিয়ার পরিচয় :
‘রিয়া’-এর আভিধানিক অর্থ হলো লৌকিকতা, লোক-দেখানো, প্রদর্শন করা বা প্রদর্শনেচ্ছা। শরিয়তের পরিভাষায় রিয়া বলা হয় আল্লাহর জন্য করণীয় ইবাদাত পালনের মধ্যে মানুষের দর্শন, প্রশংসা বা বাহ-বা’র ইচ্ছা পোষণ করা।
মুমিনের ইবাদাত ধ্বংস করে তাকে জাহান্নামী বানানোর জন্য শয়তানের অন্যতম ফাঁদ এই রিয়া। ইবাদাত যে ক্ষেত্রে একান্তই আল্লাহর ওয়াস্তে করার কথা, সেখানে অন্য কেউ দেখে ভালো বলুক- এ রূপ মনোভাব নিয়ে ইবাদাত করলে প্রকৃতপক্ষে সে ইবাদাত আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয় না। এ কারণেই রিয়াকে গোপন শিরক বা ছোট শিরক বলা হয়।
রিয়ার প্রকার ও তার হুকুম
রিয়া বা লোক-দেখানো ইবাদাত তিন প্রকার-
১. কোনো ইবাদাত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু গায়রুল্লাহকে (আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে) দেখানোর জন্য বা মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে করা এবং বাহ্যিকভাবে লোকজন যেন তার কাজটা দেখে আল্লাহর ইবাদাত বলেই মনে করে এমন মনোভাব পোষণ করা।
যদিও এতে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার বা সমান করা উদ্দেশ্য থাকে না, তথাপি এ-জাতীয় ইবাদাত শিরকের (শিরকে আসগর- ছোট শিরক) অন্তর্ভুক্ত। আর এ ধরনের ইবাদাত আল্লাহ তাআলার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ থেকে সওয়াব লাভের আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই।
কোনো মুমিন ব্যক্তি এরূপ ইবাদাত করতে পারে না। যেমন : জনসমাজে মিশলে অন্যেও শ্রদ্ধা ও প্রশংসা প্রাপ্তির আশায় নামায পড়ে রোযা রাখে, কিন্তু নির্জনে থাকলে নামায পড়ে না রোযাও রাখে না। এ-জাতীয় রিয়ার জন্য পরকালে মর্মন্তুদ শাস্তি ভোগ করতে হবে।
২. কোনো ইবাদাত মূলত আল্লাহ তাআলার জন্যই শুরু করা, তবে ইবাদাত করাকালীন বা চলাকালীন অন্য কেউ তা দেখে ফেললে বা অবহিত হয়ে গেলে তাতে আনন্দিত হওয়া। এবং তাকে দেখানোর জন্য ইবাদাতকে আরও সুন্দর করার চেষ্টা করা কিংবা পরবর্তী অংশটুকু তাকে দেখানোর জন্য পালন করা।
এ অবস্থায় আমল বা ইবাদাতটি যদি এমন হয় যে, তার এক অংশ অপর অংশের উপর নির্ভরশীল নয় বরং তার প্রতিটি অংশ পৃথক পৃথক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাহলে সেই আমল বা ইবাদাতের যে অংশটুকু রিয়া-মিশ্রিত হবে শুধু সে অংশই সাওয়াবশূন্য থাকবে, তার সম্পূর্ণ আমল বাতিল হবে না। যেমন : কোনো ব্যক্তি কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য দু শো টাকা ফকির-মিসকিনকে অল্প অল্প করে দান করতে শুরু করল, এক শো টাকা দান করার পর খেয়াল করল যে, অনেক লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে এবং তার এ দানকে প্রশংসার নজরে দেখছে, তখন তার ভেতর রিয়া বা লোকদেখানোর খাহেশাত জেগে উঠল এবং অবশিষ্ট এক শো টাকা সে তাদেরকে দেখানোর জন্য বা তাদের প্রশংসা লাভের আশায় বিলিয়ে দিল।
এমতাবস্থায় তার দানকৃত প্রথম ১০০ টাকা আল্লাহ তাআলার নিকট মাকবুল হবার যোগ্য হবে আর বাকি ১০০ টাকা প্রত্যাখ্যাত হবে।
আর যদি আমলটি এরকম না হয় বরং তার প্রথম অংশ শেষ অংশের উপর বা এক অংশ অপর অংশের উপর নির্ভরশীল হয়, অর্থাৎ আমলের প্রতিটি অংশ অপরটি ব্যতীত পূর্ণতা লাভ করতে পারে না, তাহলে এর দুই অবস্থা-
ক. ইবাদাতটি কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য শুরু করার পর ইবাদাত করাকালীন যদি রিয়া বা লোক-দেখানোর ইচ্ছা মনের মধ্যে দেখা দেয় এবং এমতাবস্থায় সে ব্যক্তি যদি ভেতরে পয়দা হওয়া লৌকিকতার মনোভাব দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রেখে আমলটি সম্পন্ন করতে পারে তাহলে তার সে আমল বাতিল হবে না। যেমন : কোনো ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নামায পড়তে শুরু করল। এমতাবস্থায় নামাযের দ্বিতীয় রাকাআতে তার অন্তরে রিয়ার উদ্রেক হলো। সাথে সাথে সে তার অন্তর থেকে এই কুমন্ত্রণা ও কুমনোভাব দূর করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে নামায সম্পন্ন করল। তার এই রিয়া তার আমলে কোনো প্রভাব ফেলবে না এবং আল্লাহ চাহেন তো তার এই নামায সাওয়াবশূন্য হবে না।
খ. যদি সে ব্যক্তি তার অন্তরের এই কুমন্ত্রণা দূর করা এবং আমলকে রিয়ামুক্ত করার চেষ্টা না করে, বরং রিয়া তথা লোক-দেখানোর উদ্দেশ্য অন্তরে পোষণ করেই আমল সম্পন্ন করে থাকে, তাহলে তার এই আমল সাওয়াবশূন্য হয়ে যাবে।
৩. আল্লাহ তাআলার জন্য পূর্ণ নিষ্ঠা ও ইখলাসের সাথে কোনো আমল আরম্ভ ও সম্পন্ন করা, তবে আমল সম্পন্ন হওয়ার পর অন্তরে রিয়ার উদ্ভব হওয়া। যেমন লোকজনের মুখে এ আমল সম্পর্কে নিজের প্রশংসা শুনে নীরবে আত্মতৃপ্তি ও গর্ববোধ করা। এ-জাতীয় রিয়া সম্পাদিত সেই আমল ও ইবাদাতে কোনোরূপ প্রভাব ফেলে না এবং এর দ্বারা ইবাদত বাতিল বা বিনষ্ট হয় না। কেননা তা ইবাদত সম্পন্ন হওয়ার পর প্রকাশ পেয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, হযরত আবু যর রাযি. বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘ঐ ব্যাক্তি সম্পর্কে আপনার অভিমত কী, যে কোনো নেক কাজ করে আর লোকেরা তার সেই কাজের দরুণ তার প্রশংসা করে?’ অপর বর্ণনায় রয়েছে- ‘এই কাজের কারণে লোকে তাকে ভালোবাসে। এতে কি তার সাওয়াব বাতিল হয়ে যাবে?’ নবীজি বললেন, ‘এরূপ প্রশংসিত হওয়া মুমিনের নগদ সুসংবাদ।’ [মুসলিম শরীফ]