রাসূল সা.-এর প্রতি মুমিনের মহব্বত কেমন হবে [সহীহ বুখারী, হাদীসক্রম : ১৪]

 

حدثنا أَبُو الْيَمَانِ قَالَ أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ قَالَ حَدَّثَنَا أَبُو الزِّنَادِ عَنِ الْأَعْرَجِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَأَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ.

 

হাদীসের তরজমা :

আবুল ইয়ামান…হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার শপথ! তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা ও পুত্রের তুলনায় প্রিয়তর হই।’ (বুখারী, হাদীসক্রম : ১৪)

মহব্বত কাকে বলে?

শরীয়তের পরিভাষায় মহব্বত বলা হয়-

ميلان القلب الى الشيء المرغوب الثابت حسنه شرعا

অর্থাৎ, ‘শরীয়ত-সমর্থিত উৎকৃষ্ট ও পছন্দনীয় জিনিসের প্রতি মনের যে আকর্ষণ বা টান থাকে, তাকে মহব্বত বলা হয়।’

মহব্বতের প্রকারভেদ :

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর মতে মহব্বত তথা ভালোবাসা তিন প্রকার। যথা-

১. محبت طبعي তথা স্বভাবগত ভালোবাসা : প্রবৃত্তির চাহিদা ব্যতীত অকৃত্রিম ভালোবাসাকে স্বভাবগত ভালোবাসা বলে। যেমন, সন্তান-সন্ততির প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসা।

২. محبت عقلي তথা জ্ঞানগত ভালোবাসা : প্রকৃতির দাবিকে উপেক্ষা করে গুন, জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেচনার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, তাকে জ্ঞানগত ভালোবাসা বলে। যেমন, আরোগ্য লাভের জন্য তিক্ত ওষুধ সেবন করা, কোন জ্ঞানী-গুণীকে ভালোবাসা।

৩. محبت شرعي তথা দ্বীনী বা ঈমানগত ভালোবাসা : শুধু দ্বীনী বা ঈমানের দাবিতে যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, তা-ই মহব্বতে শরয়ী। হাদীসের ভাষায় একে الحب في الله বলা হয়। যেমন, আল্লাহ, রাসূল, সাহাবী ও অন্যান্য মুসলমানের প্রতি ভালোবাসা। এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে-

لا يؤمن احدكم حتى اكون احب اليه من والده وولده والناس اجمعين

হাদীসে বর্ণিত মহব্বত দ্বারা কোন প্রকারের মহব্বত উদ্দেশ্য; সে ব্যাপারে মনীষীগণ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছেন। তবে শেষ কথা হলো, হাদীসে বর্ণিত মহব্বত দ্বারা মহব্বতে আকলী (জ্ঞানগত ভালোবাসা) থেকে শুরু করে যত উচ্চস্তরের মহব্বত আছে তার সবগুলোকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। তাই তো সাহাবায়ে কেরাম রিযওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম আজমাঈন রাসূলের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে এভাবে জান উৎসর্গ করেছিলেন যে, তাঁকে ছাড়া দুনিয়ার কোন কিছুর পরোয়া করেননি। এই ভালোবাসার শক্তিতেই হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘরের যাবতীয় সহায়-সম্বল আল্লাহর রাসূলের কদম মোবারকের সামনে রেখেছিলেন। ঘরে কী রেখে এসেছেন জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে’। কারণ একটাই, রাসূলের প্রতি তাদের ঈমানী ও জ্ঞানগত ভালোবাসা।

রাসূলের প্রতি মুমিনের ভালোবাসা কেমন হওয়া উচিত?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আমাদের ভালোবাসা কেমন হওয়া উচিত তা তিনি নিজেই হাদীসে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তার কাছে বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি ও সবার চেয়ে আমি বেশি প্রিয় না হবো। তার মানে ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্য বুনিয়াদি শর্ত হলো, আল্লাহর রাসূলকে প্রকৃত মহব্বত করা, নামে মাত্র মহব্বত করা নয়। একজন মানুষের সবচেয়ে আপন হলো তার বাবা-মা, তারপর সন্তানাদি, তারপর অন্য কোন মানুষ। তাদের সবার চেয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি বেশি মহব্বত হতে হবে এবং তার প্রকাশ ঘটতে হবে আনুগত্যের মাধ্যমে। শুধু নীতি বাক্য নয়, মুমিনকে পৌঁছাতে হবে নবী প্রেমের এই স্তরে; সকলের উপর, সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিতে হবে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে; এমনকি নিজের জানের উপরও। আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম রাযিয়াল্লাহু বলেন-

كُنَّا مع النَّبيِّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ وهو آخِذٌ بيَدِ عُمَرَ بنِ الخَطَّابِ، فَقالَ له عُمَرُ: يا رَسولَ اللَّهِ، لَأَنْتَ أحَبُّ إلَيَّ مِن كُلِّ شَيْءٍ إلَّا مِن نَفْسِي، فَقالَ النَّبيُّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: لَا، والَّذي نَفْسِي بيَدِهِ، حتَّى أكُونَ أحَبَّ إلَيْكَ مِن نَفْسِكَ، فَقالَ له عُمَرُ: فإنَّه الآنَ، واللَّهِ، لَأَنْتَ أحَبُّ إلَيَّ مِن نَفْسِي، فَقالَ النَّبيُّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: الآنَ يا عُمَرُ.

‘একদিন আমরা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। নবীজি ওমরের হাত ধরা ছিলেন। ওমর রাযিয়াল্লাহু বলে উঠলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার কাছে সবকিছু থেকে প্রিয়, তবে আমার জান ছাড়া।’ তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না; ওমর এতে হবে না। যে সত্তার হাতে আমার জান তার কসম! (ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না) যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার জানের চেয়েও প্রিয় না হই।’ পরক্ষণেই ওমর বললেন, ‘হ্যাঁ, এখন তা হয়েছে; আল্লাহর কসম এখন থেকে আপনি আমার কাছে আমার জানের চেয়েও প্রিয়।’ তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, ওমর এখন হয়েছে।’ (বুখারী, হাদীসক্রম : ৬৬৩২)

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা যদি সবকিছুর উপর না হয় তাহলে পথ চলবে কীভাবে? আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আদেশের সামনে সমর্পিত হবে কীভাবে? আজ বাধা হবে সন্তান, কাল স্ত্রী, পরশু পিতা। কখনো জানের মায়ায় লঙ্ঘিত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ। আর মুমিন তো সেই, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত ও নির্দেশের সামনে সবকিছু পিছনে ফেলতে জানে।

পবিত্র কুরআনেও একই নির্দেশনা এসেছে। মুমিনের জন্য ভালোবাসার মূল কেন্দ্র স্বয়ং আল্লাহ, তারপর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। দুনিয়ার বুকে যত প্রেমময় মানুষ আছে, যত রকমের ভালো লাগার জিনিস আছে, সবকিছুর অবস্থান দ্বিতীয়তে। এ থেকে বোঝা যায় আল্লাহর রাসূলকে ভালোবাসা আমাদের প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। কেননা দুনিয়াতে ভালোবাসার যত কিছু আছে এর সব তাঁর কারণেই প্রেমময়। যদি তিনি আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসতে না বলতেন, আত্মীয়তার বন্ধন ঠিক রাখতে না বলতেন, সামাজিকভাবে এক থাকতে না বলতেন; ধনী-গরিব, সাদা-কালো ভুলে গিয়ে এক কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামায পড়তে না বলতেন, আমাদের মধ্যে এসব করার আগ্রহই তৈরি হতো না। আমরা তখন হতাম বিচ্ছিন্ন, শান্তিহীন। আমাদের থাকতো না কোনো সুখ।

মানুষ সামাজিক প্রাণী বটে; নিজ প্রয়োজনে দলবদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু আটলান্টিকের এপার থেকে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত ভাই ভাইয়ের সম্পর্কের স্বর্ণময় এক সভ্যতা গড়ে তোলা তার চেয়ে অনেক বড় বিষয়। আর তা একমাত্র সম্ভব হয়েছে রাসূলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা থাকার কারণে। এই শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, সে কখনো তার ওপর জুলুম করে না এবং জালিমের হাতে তাকে ছেড়ে দেয় না।’ তারপর বলেছেন, ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীরের মতো, যার একাংশ অপরাংশকে শক্তি জোগায়।’

ভালোবাসার দাবি আনুগত্য :

ভালোবাসার সার কথা হচ্ছে, আমি যাকে ভালোবাসি তার চিন্তা-চেতনা, চাওয়া পাওয়ার সাথে একাত্ম থাকা।

রুয়াইম ইবনে আহমদ আল বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মহব্বতকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন-

المحبة الموافقة في جميع الاحوال (كلمة الاخلاص للحافظ ابن رجب ص-٣٢

অর্থাৎ, ‘ভালোবাসা হলো প্রেমাস্পদের সাথে সর্বাবস্থায় একাত্ম থাকা।’ সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মহব্বতের প্রকাশ হচ্ছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার সুন্নাহর অনুসরণ করা। যদি তা অগ্রাহ্য করা হয় তাহলে মহব্বতের দাবি করা অযৌক্তিক।

হাকীম মাহমুদ ওয়াররাক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন-

لو كان حبك صادقا لاطعته # ان المحب لمن يحب مطيع

অর্থাৎ, ‘যদি তোমার প্রেম খাঁটি হতো তবে তো তুমি তার অনুগত হতে। কারণ প্রেমিক তো প্রেমাস্পদের অনুগত থাকে।’ (শরহুয্ যরকানী আলাল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়াহ, পৃষ্ঠা : ১১৮)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম রিযওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম আজমাঈন। তারা সত্যিকারের নবীপ্রেমের বেনযীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তার চুল মোবারক মুণ্ডন করা হচ্ছে, আর তাঁর সাহাবীরা তাঁকে ঘিরে আছে। তাঁরা চাইছিলেন তাঁর একটি চুলও যেন মাটিতে না পড়ে। বরং কারো না কারো হাতেই পড়ে।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীসক্রম : ২৩২৫)

এরকম বহু দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সাহাবায়ে কেরাম রিযওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম আজমাঈন। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তীরাও নবীপ্রেমের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে।

আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের সবার হৃদয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দেন। তাঁর সুন্নাহকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণ করার তৌফিক দান করেন। আমীন।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT