কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে ঈসালে সওয়াবের প্রমাণ
আমরা পরস্পর আলোচনা করে থাকি যে, কেউ কুরআন তিলাওয়াত করে এর সওয়াব মৃতকে বখশিয়ে দিতে পারবে কি না? এক কথায় কুরআন তিলাওয়াত করে ঈসালে সওয়াব জায়েয আছে কি না? আমরা এর উত্তরে বলি, বান্দা কুরআন পড়ে এর সওয়াব মৃত ব্যক্তিকে বখশিয়ে দিতে পারবে। আল্লাহ তাআলা এই সওয়াব মৃতকে দান করবেন। উল্লেখ্য যে, বান্দা নিজের আমলের প্রতিদান নিজে গ্রহণ করলে সেটাকে ‘সওয়াব’ বলা হয়। পক্ষান্তরে নিজে আমল করে এর প্রতিদান অন্যকে দিলে সেটাকে বলা হয় ‘ঈসালে সওয়াব’ (সওয়াব বখশিয়ে দেওয়া)।
এবার আমাদের জানার বিষয় হলো, কুরআনের মাধ্যমে ঈসালে সওয়াবের প্রমাণ কী? একটু মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর দিন একটি পশু জবাই করলেন আর বললেন, ‘হে আল্লাহ! এই কুরবানী আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের মধ্যে যে কুরবানী দিতে পারেনি তার পক্ষ থেকে।’ [মুসনাদু আহমাদ ইবনি হাম্বাল, হাদীস-ক্রম : ১৪৮৯৩]
এবার বলুন! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর পশু জবাই করে এর সওয়াব উম্মতকেও বখশিয়ে দিয়েছেন কি না? (অবশ্যই দিয়েছেন)। তিনি মাংস দেননি; বরং দিয়েছেন এর সওয়াব। সুতরাং মাংসের সওয়াব পৌঁছতে পারলে কুরআনের সওয়াব পৌঁছতে পারবে না কেন?
যদি তিনি কুরআন পড়ে এর সওয়াব বখশিয়ে দিতেন, তাহলে মাংসের সওয়াব পৌঁছবে কি না, তা বুঝা যেত না। কিন্তু তিনি মাংসের মাধ্যমে ঈসালে সওয়াবের মাসআলা শিখিয়ে দিয়েছেন। এতে আপনাআপনিই কুরআনের মাধ্যমে ঈসালে সওয়াবের মাসআলা বোঝা গেল। একটি মাসআলা বলে দিয়েছেন, এতে আরেকটি মাসআলা আপনাআপনি সাব্যস্ত হয়ে গেল। (এটাই জাওয়ামিউল কালিম, যা নবীজির অনন্য এক বৈশিষ্ট্য)।
শিং, পশম ও খুরের সওয়াব বর্ণনা করার দ্বারা মাংসের সওয়াব আপনাআপনি বুঝে আসা
তদ্রুপ একটি হাদীস আপনি শুনে থাকবেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর ফযীলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘কুরবানীর দিন (পশু জবাইয়ের মাধ্যমে) রক্ত প্রবাহিত করা অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় মানুষের কোনো আমল নেই। কিয়ামাতের দিন উক্ত পশু তার শিং, পশম ও পায়ের খুর-সব নিয়ে উপস্থিত হবে। [জামে তিরমিযী, কুরবানীর ফযীলত অধ্যায়]
হাদীসের ভাবার্থ হলো, বান্দা কুরবানীর দিন যে পশু আল্লাহর নামে জবাই করেছে, আল্লাহ তাকে ওই পশুর শিংয়েরও সওয়াব দেবেন, এর পশমেরও সওয়াব দেবেন এবং খুরেরও সওয়াব দেবেন। (সুবহানাল্লাহ!)
এবার বলুন, কুরবানী দিলে কেউ কি এর পশম, শিং কিংবা খুর খায়? নিশ্চয় না! খায় বরং পশুর মাংস। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাংসের সওয়াব না বলে পশমের সওয়াব বলেছেন। কেন? এর কারণ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি কলিজা কিংবা মগজের সওয়াব বলতেন, তাহলে পশমের সওয়াব বুঝে আসত না। এ কথা যে-কারো বলার সুযোহ থাকত যে, ‘ভাই! কলিজা তো খাবারের বস্তু! এটা নিজেও খাওয়া যায় এবং অপরকেও আহার করানো যায়। তাই এর সওয়াব অবশ্যই হবে। কিন্তু পশম তো খাওয়া যায় না। তাহলে এর কি কোনো সওয়াব নেই?’ তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাংসের সওয়াব না বলে শিং, পশম ও খুরের সওয়াব বলে দিয়েছেন। এতে মাংসের সওয়াব এমনিতেই বোঝা গেছে।
এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনন্য বৈশিষ্ট্য ‘জাওয়ামিউল কালিম’। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে জাওয়ামিউল কালিম (তথা স্বল্প কথা অথচ ব্যাপক অর্থবোধক) কথা বলার যোগ্যতা দান করা হয়েছে।’ তিনি একটি হাদীস বলেন, আর তা থেকে মাসআলা বের হয় একাধিক। প্রশ্ন হতে পারে যে, ‘জাওয়ামিউল কালিম’ কেবল আমাদের নবীজির বৈশিষ্ট্য কেন? পূর্বেকার নবীগণকেও কেন তা দেওয়া হয়নি? এর জবাব হলো, হাদীসে এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার মাধ্যমে নবীগণের আগমনের সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। (আমার পরে আর কোনো নবী আসবেন না)।’ অর্থাৎ তিনি হলেন শেষ নবী। তাই কিয়ামাত অবধি সময়ের জন্য তাঁকে এমন কিছু কথা দান করা হয়েছে যে, সেগুলো নিয়ে যুগ যুগ ধরে গবেষণা চলবে এবং মাসআলা-মাসাইল বের করা হবে। এ ক্ষেত্রে না কোনো নবীর প্রয়োজন, আর মাসআলা বের করার জন্য না কোনো অতিরিক্ত শব্দ-ভাণ্ডারের প্রয়োজন। এটা আমাদের নবীর বিশেষ মর্যাদা। শব্দ-ভাণ্ডার মজুদ আছে, তুমি কেবল মাসআলা বের করতে থাকো!
হাদিস–ভাণ্ডার থেকে মাসআলা বের করবেন কে?
এবার একটি কথা লক্ষ করুন! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে হাদীসের যে বিশাল ভাণ্ডার দান করেছেন, সেগুলো থেকে মাসআলা বের করবেন কে? যে-কারো এই সামর্থ্য নেই যে, সে হাদীসের গভীরে পেঁৗছে মাসআলা বের করবে। দেখুন, আল্লাহ তাআলা ভূ-গর্ভে এই পরিমাণ পানি রেখেছেন যে, কিয়ামাত পর্যন্ত আগত লোক তা থেকে পানি বের করতে থাকবে; কিন্তু না পানি শেষ হবে, আর না নতুন কোনো জমিনের প্রয়োজন পড়বে। বরং এই জমিনের গর্ভেই পানি মজুদ করা আছে। এভাবে কিয়ামাত পর্যন্ত যে পরিমাণ পেট্টোলের প্রয়োজন ছিল, সেই পরিমাণ পেট্টোল তিনি রেখে দিয়েছেন জমিনের গভীরে। এর জন্য নতুন কোনো জমিনের প্রয়োজন পড়বে না এবং পেট্টোলও শেষ হবে না। তদ্রুপ কিয়ামাত পর্যন্ত মানুষের যে পরিমাণ গ্যাসের প্রয়োজন ছিল, সেই পরিমাণ গ্যাস তিনি রেখে দিয়েছেন মাটির নিচে।
এই জমিন যেহেতু কিয়ামাত পর্যন্ত থাকবে, তাই কিয়ামাত পর্যন্ত যতটুকু পানির প্রয়োজন, ততটুকু পানি তিনি তাতে মজুদ করে রেখেছেন। যতটুকু পেট্টোলের প্রয়োজন, ততটুকু পেট্টোল মাটির নীচে রেখেছেন। নতুন জমিন আর আবিষ্কৃত হবে না; বরং এই জমিনের নিচেই মজুদ রয়েছে এ সকল পদার্থ। ঠিক তদ্রুপ কোনো নতুন নবী যেহেতু আর আসবেন না; বরং কিয়ামাত পর্যন্ত যত মাসআলার প্রয়োজন পড়বে, এই শেষ-নবীর (রেখে যাওয়া) শব্দ-ভাণ্ডারের গভীরেই রয়েছে সে-সকল মাসআলা। এখন কেবল মাসআলা আবিষ্কারক থাকা চাই, যিনি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস-ভাণ্ডার থেকে মাসআলা বের করবেন। এটা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। মাসআলা বের করাকে ‘ফিকহ’ বলা হয়। আর যিনি বের করেন তাঁকে ‘ফকীহ’ বা ‘মুজতাহিদ’ বলা হয়।
ফকীহ–এর কাজ
এটা আমি একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করব। ধরুন, আপনি একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন। তো মুসল্লীদের ওযু-ইস্তিঞ্জার জন্য পানির প্রয়োজন। পানি তো এই জমিনের নিচেই আছে; কিন্তু তাই বলে আপনি পানি বের করতে পারবেন না। এর জন্য আপনাকে যোগাযোগ করতে হবে একজন টিউবওয়েল মিস্ত্রির সাথে। এভাবে মসজিদের বিদ্যুতের জন্য আপনাকে যেতে হবে ইলেক্টিক্যাল মিস্ত্রির কাছে। তদ্রƒপ আল্লাহ তাআলা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের গভীরে রেখে দিয়েছেন বহু মাসআলা-মাসাইল। আর সেগুলো বের করার জন্য উম্মতকে দান করেছেন ফুকাহা-মুজতাহিদগণকে। তাঁদের সাথে যোগাযোগ রাখবেন, তো মাসআলা বের হবে। তাঁদেরকে গালি দেবেন, তো মাসআলা বের হবে না।
প্রতিটি শাস্ত্র–বিশেষজ্ঞের প্রতি আস্থা রাখা জরুরি
ধরুন, আপনি জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের নিকট গিয়েছেন। ডাক্তার চেকাপ করে বললেন, ‘আপনাকে ইনজেকশন নিতে হবে।’ আপনি বললেন, ‘ইনজেকশন কেন নেব?’ ডাক্তার বললেন, ‘আপনার শরীরে ১০৫ ডিগ্রি জ্বর।’ আপনি বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব! আপনি কেমন করে জানলেন যে, আমার শরীরে ১০৫ ডিগ্রি জ্বর?’ ডাক্তার বললেন, ‘আরে মিয়া! আপনাকে এটা বুঝাতে পারব না। আপনাকে এটা বিশ্লেষণসহ জানতে হলে আমাদের ক্লাসে আসতে হবে। তখন বুঝিয়ে দেবো। ফার্মেসিতে কেবল ঔষধ দেওয়া হয়; এখানে বুঝানো হয় না। এখানে বুঝাতে গেলে সময় নষ্ট হবে।’
উলামায়ে কেরামের প্রতি আস্থা রাখুন
আমাকে বড় দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, অনেক মানুষ উলামায়ে কেরামের প্রতি আস্থা রাখে না। তারা বলে, ‘আমাদেরকে তাহকীক বা অনুসন্ধান করতে হবে।’ এদের কাউকে কাউকে আমি বলি, ‘তাহকীক-অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের মারকাযে এসো।’ সে বলে, ‘জ্বি না, আমার সময় নেই। এখনই মাসআলাটি বুঝিয়ে দিন।’ আমি বলি, ‘ডাক্তার তোমাকে তো তাৎক্ষণিক বুঝিয়ে দেয় না, তাতে তোমার কোনো আপত্তি থাকে না; কিন্তু একজন আলিমের পেছনে এই বলে লেগে আছ যে, এখনই বুঝিয়ে দাও!
যাইহোক, আমি বলছিলাম, যেভাবে আল্লাহ তাআলা মাটির নিচে পানি রেখেছেন, আর তা বের করে আনার জন্য বান্দাকে ইঞ্জিনিয়ার দান করেছেন; তদ্রুপ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের গভীরে অনেক মাসআলা রেখেছেন। আর সেগুলো বের করে আনার জন্য উম্মতকে মুজতাহিদীনে কেরাম দান করেছেন। আমরা যে মুজতাহিদের অনুসরণ করে থাকি, তিনি হলেন ইমাম আযম আবু হানীফা নুমান ইবনু সাবিত রাহিমাহুল্লাহ। তিনি তাহকীক-গবেষণা করে হাদীস-ভাণ্ডার থেকে মাসআলা-মাসাইল বের করেছেন। সেই মাসআলাসমূহের নাম ‘ফিকহে হানাফী’। তাই আমরা বলে থাকি যে, ‘ফিকহে হানাফী’ কুরআন-হাদীসের বাইরের কিছু নয়।