রাসূলের অনন্য বৈশিষ্ট্য  (শেষ পর্ব)

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য : গনীমতের মাল হালাল হওয়া

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমার জন্য গনীমতের (যুদ্ধলব্ধ) সম্পদ হালাল করা হয়েছে।’

গনীমতের মাল হালাল হওয়ার তাৎপর্য হলো, মুসলমানগণ যুদ্ধের ময়দানে কাফেরদের সাথে জিহাদ করে বিজয় লাভের পর শত্রুবাহিনীর যে সম্পদ তাদের হস্তগত হয়, তা-ই হলো গনীমতের মাল। পূর্বেকার নবীগণের জন্য গনীমতের মাল হালাল ছিল না। মূসা আ.-এর কওম জিহাদ করেছিল; কিন্তু গনীমতের মাল তাদের জন্য হালাল ছিল না। তদ্রুপ পূর্বেকার নবীগণের জন্য এই নিয়ম ছিল যে, যুদ্ধে যে গনীমতের মাল অর্জন করা হতো, তা একটি স্থানে জমা করা হতো এবং আকাশ থেকে অগ্নি এসে তা জ্বলিয়ে দিত। এটা ছিল জিহাদ কবুল হওয়ার লক্ষণ। অন্যথায় জিহাদ কবুল হয়নি বলে গণ্য করা হতো।

মাকবূল হজের লক্ষণকঙ্কর গায়েব হয়ে যাওয়া

অনুরূপ একটি মুজিযা আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরও রয়েছে। তাঁর দুটি মুজিযা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। একটি হলো আল-কুরআন, আর দ্বিতীয়টি হলো, যাদের হজ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে জামারাতে তাদের নিক্ষিপ্ত কঙ্করগুলো নিজে নিজে গায়েব হয়ে যায়; তা উঠিয়ে ফেলতে হয় না। এখন লোকেরা আশ্চর্যবোধ করে যে, কিছু কিছু পাথর তো সরাতে হয়। আমি বলি, সুদের টাকা দ্বারা হজ করলে কঙ্কর গায়েব হয় না; বরং তা সরাতে হয়। হজ যখন ইবাদাত না হয়ে ফ্যাশন হবে, তখন কঙ্কর নিজে নিজে গায়েব হয় না; বরং সরাতে হয়।

গনীমতের মাল হালাল ও পবিত্র

যাই হোক, আমি বলছিলাম যে, পূর্বেকার নবীগণের শরীয়তে গনীমতের মালের এই বিধান ছিল যে, তা নির্দিষ্ট একটি স্থানে সমবেত করা হতো এবং আকাশ থেকে আগুন এসে তা জ্বলিয়ে ফেলত। এটা ছিল জিহাদ কবুল হওয়ার আলামত। কিন্তু আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মানার্থে তাঁর শরীয়তে গনীমতের মাল হালাল ও পবিত্র করা হয়েছে। ব্যবসায়ী ব্যবসার মাধ্যমে যে হালাল মাল উপার্জন করে, তা সম্ভবত এতো পবিত্র নয়, যতটুকু গনীমতের মাল পবিত্র। কেননা, কুরআনে গনীমতের মালের জন্য দুটি শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে- حَلَالًا طَيِّبًا অর্থাৎ গনীমতের মাল হালালও আবার পবিত্রও। আজ আমরা আশ্চর্য হচ্ছি এ কারণে যে, এ আমলটি আমাদের থেকে উঠে গেছে। তাই আমরা এ বিষয়টি শোনামাত্র আশ্চর্যবোধ করি, আমল করা তো দূরের বিষয়।

গনীমতের মাল হালাল হওয়ার কারণ

আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  কী পরিমাণ সম্মান-একটু ভাবুন! পূর্বেকার নবীগণের জন্য গনীমতের মাল ব্যবহার করা হালাল ছিল না; কিন্তু আমাদের নবীজি সা.-এর জন্য তা হালাল। এর কারণ হল, পূর্বেকার নবীগণ একেকজন ছিলেন একেকটি এলাকার নবী। তাঁরা ব্যবসাও করেছেন, আবার জিহাদও করেছেন। কিন্তু আমাদের নবী নির্দিষ্ট এলাকার নবী নন, তিনি হলেন সমগ্র বিশে^র নবী। তাই তাঁর উম্মত জিহাদে বের হলে এমনও পরিস্থিতি দেখা দেবে যে, জিহাদে বের হলে ব্যবসা চলবে না, আর ব্যবসায় বসে থাকলে জিহাদ চলবে না। এ রকম তো নয় যে, জিহাদে চলে গেলে পেছন থেকে টাকা পৌঁছবে। এখন এ জাতি কী করবে? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদেরকে পেছন দিক থেকে অমুখাপেক্ষী করে দিলেন। তারা জিহাদের জন্য যেখানে যাবে সেখানে তাদের উপার্জন করতে হবে না; বরং উপার্জন করবে কাফের-মুশরিকরা, আর মুসলমানগণ তা ভোগ করবে। আল্লাহ তাআলা নবীজি সা.-এর উম্মতকে এই মর্যাদা দান করেছেন যে, তারা নিজ বাড়ি থেকে বের হবে; কিন্তু পেছন থেকে টাকা-পয়সা আসার প্রয়োজন নেই। কেননা, আমাদের প্রিয় নবী সা.-এর নবুওয়তের পরিধি ব্যাপক তথা বিশ্বের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ব্যপ্ত। এ জন্যেই সাহাবীগণ মদীনা থেকে বের হয়েছেন এবং সমুদ্রের শেষ কিনারায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, আমরা যতটুকু আসার ছিল এসেছি, এর সামনে যাওয়া আমাদের সাধ্য নেই।

এখন বলুন! সাহাবী আফ্রিকায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে বের হয়েছেন। তাহলে মদীনার সম্পদ আফ্রিকায় পৌঁছবে কীভাবে? মদীনা থেকে বের হয়েছেন, গন্তব্য খোরাসান। এখন মদীনার ব্যবসার টাকা সেখানে পৌঁছবে কীভাবে? এটা তো সম্ভব ছিল না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই দয়া করলেন যে, তিনি গনীমতের মাল হালাল করে দিয়েছেন যে, এখন পেছন থেকে জিহাদের ময়দানে টাকা-পয়সা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন এই কাফেরদের উপার্জিত অর্থ-সম্পদ নিজেরাও খাও এবং নিজেদের বাড়িতেও দাও। তোমাদের এ সন্দেহ যেন না হয় যে, এ অর্থ-সম্পদ হারাম; বরং এ অর্থ-সম্পদ হালালও, আবার পবিত্রও বটে। পূর্বের নবীগণের প্রয়োজন ছিল না; বিধায় তাদের জন্য গনীমতের মাল হালাল করা হয়নি। পক্ষান্তরে আমাদের নবীর প্রয়োজন ছিল; বিধায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর জন্য গনীমতের মাল হালাল করে দিয়েছেন। আমাদের নবীজির জন্য হালাল কেন? কারণ, তিনি হলেন শেষ নবী। তাঁর পরে কোনো নবী সৃষ্টি হবেন না। তাঁর উম্মতগণ জিহাদের জন্য দূর থেকে বহুদূর যাবে। সেখানে উপার্জন করবে কীভাবে? তাই আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন যে, কাফেররা উপার্জন করবে, আর তোমরা তাদের উপার্জিত অথ-সম্পদ ভোগ করবে।

তোমাদের খুন মিষ্ট

হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। তিনি এক যুদ্ধে ছিলেন মুসলমানদের কমান্ডার। সামনে ছিল ইরানের শত্রুবাহিনী। তাদের কমান্ডার বলল, ‘খালিদ! একটি কথা বলো, তোমরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে এসেছ, তোমরা এই দুর্বল তরবারি দ্বারা যুদ্ধ করবে কীভাবে?’ খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ বললেন, ‘যুদ্ধ তরবারি দ্বারা হয় না; যুদ্ধ হয় বাহুর শক্তি দ্বারা।’ সে বলল, ‘তোমরা এখানে এসেছ কেন?’ খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ জবাব দিলেন, ‘শুনেছি তোমাদের খুন মিষ্ট। তাই আমরা এখানে এসেছি।’ এটা যুদ্ধের ময়দানের কথা; তাহাজ্জুদের কথা নয়। আমরা বড়ই আজীব লোক, আমরা কেবল সাহাবীগণের ক্রন্দন, তাকওয়া এবং রাতের তাহাজ্জুদ দেখি; কিন্তু তাঁরা যে জিহাদের ময়দানে ছিলেন অশ্বরোহী-সেটা দেখি না। তাঁদের জীবনের শুধু একটি দিক না দেখে সকল দিক দেখা আমাদের জন্য বাঞ্ছনীয়। তাঁরা ছিলেন-রাতের বেলায় ইবাদাত-গুজার আর দিনের বেলায় অশ্বরোহী।

সেই কমান্ডার খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু আনহুক জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমরা মদীনা থেকে এখানে এসেছ, তোমাদের রশদপত্র কি মদীনা থেকে এখানে আসবে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আসবে না।’ প্রশ্ন করল, ‘তোমাদের কি অস্ত্রশস্ত্র মদীনা থেকে আসবে?’ তিনি বললেন, ‘না, আসবে না।’ সে আবার প্রশ্ন করল, ‘তাহলে খাবার কি মদীনা থেকে আসবে?’ তিনি বললেন, ‘না, আসবে না।’ কমান্ডার বলল, ‘তাহলে তোমরা কোন ভরসায় এখানে এলে?’ খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ চমৎকার জবাব দিলেন-‘সাহায্য মদীনা থেকে আসে না; সাহায্য আসে আকাশ থেকে। আমি স্বচক্ষে তা দেখতে পাচ্ছি।’ (তারীখে দিমাশক, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠাক্রম : ৯৬)

চতুর্থ বৈশিষ্ট্য : সমস্ত জমিন পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমার জন্য সমস্ত জমিন পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

পূর্বেকার নবীগণের জন্য তায়াম্মুমের অনুমতি ছিল না। একমাত্র উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য তায়াম্মুমের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। পূর্বেকার নবীগণের উম্মতেরা পানি দ্বারা ওযু-গোসল করতে হতো। তায়াম্মুমের কোনো বিধান ছিল না। কিন্তু উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য পানির অবর্তমানে ওযু-গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করার সুযোগ রয়েছে। তাই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার জন্য সমস্ত জমিন পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ পূর্বের উম্মতরা পানি দ্বারা যে কাজ সম্পন্ন করেছে, এই উম্মত সেই কাজ মাটি দ্বারাও সম্পন্ন করছে। এর কী প্রয়োজন ছিল? পূর্বেকার একেক নবী একেক জনপদে প্রেরিত হয়েছিলেন। আর জনপদে অবশ্যই পানি থাকে। যে জনপদে পানি নেই সেই জনপদ ‘জনপদ’ নয়। মানুষের বসবাসের উপযুক্ত স্থানকেই জনপদ বলে। বসবাসের উপযুক্ত না হলে সেটা জনপদ নয়। আর বসবাসের উপযুক্ত হতে হলে সেখানে অবশ্যই পানি থাকতে হবে।

মোটকথা, পূর্বের নবীগণ ছিলেন নির্দিষ্ট একটি এলাকার নবী। অতএব, যে নবী যে এলাকায় থাকবেন সেই এলাকায় পানি থাকবে। তাই তাঁদের জন্য তায়াম্মুমের প্রয়োজন ছিল না। পক্ষান্তরে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দিষ্ট কোনো এলাকার নবী ছিলেন না; তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের নবী। অর্থাৎ আমাদের নবী এবং পূর্বেকার নবীদের মধ্যে পার্থক্য হলো, পূর্বেকার নবীগণ ও তাঁদের উম্মতরা নিজের এলাকায় নামাজ আদায় করতেন। এলাকা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। পক্ষান্তরে উম্মতে মুহাম্মাদীগণকে সেখানেও যেতে হয়, যেখানে পানি নেই অথবা পানি আছে; কিন্তু ওযু-গোসলের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাহলে এই উম্মত কী করবে? তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দয়া করেছেন যে, ওযু-গোসলের প্রয়োজন; কিন্তু পানি নেই, এ ক্ষেত্রে ওযু-গোসলের পরিবর্তে মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও। এটা তোমাদের বৈশিষ্ট্য।

মক্কায় ক্ষেতকৃষি হয় না

এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হযরত ইবরাহীম আ. স্বীয় স্ত্রী হাজেরা ও পুত্র ইসমাঈলকে মক্কার মরুপ্রান্তরে রেখে যাওয়ার সময় দুআ করেছিলেন,

رَبَّنَاۤ اِنِّیْۤ اَسْکَنْتُ مِنْ ذُرِّیَّتِیْ بِوَادٍ غَیْرِ ذِیْ زَرْعٍ عِنْدَ بَیْتِكَ الْمُحَرَّمِ ۙ

তরজমা : হে আমাদের রব! আমি আমার বংশধরদের কিছু সংখ্যককে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যকায় আপনার পবিত্র ঘরের কাছে। (সূরা ইবরাহীম, আয়াত-ক্রম : ৩৭)

ইবরাহীম আ. এখানে غَیْرِ ذِیْ زَرْعٍ বলেছেন। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আমার পরিবার-পরিজনকে এমন স্থানে রেখে যাচ্ছি, যেখানে ক্ষেত-কৃষি হয় না। মুফাসসিরীনে কেরাম বলেন, ইবরাহীম আ. غَیْرِ ذِیْ زَرْعٍ বলেছেন; غَیْرِ ذِیْ مَاءٍ বলেননি। অর্থাৎ এ কথা বলেছেন যে, এখানে ক্ষেত-কৃষি হয় না; কিন্তু এরূপ বলেননি যে, এখানে পানি নেই। আজও মক্কায় ক্ষেত-কৃষি নেই। কিন্তু পানি আজও সেখানে আছে। মক্কা ক্ষেত-কৃষির অনুপযুক্ত হলেও পানির উপযুক্ত ছিল। আজও মক্কা থেকে গোটা বিশ্বে পানি সাপ্লাই হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য জায়গা থেকে মক্কায় তরি-তরকারি রপ্তানি হচ্ছে, আর মক্কা থেকে বিশ্বে পানি সাপ্লাই হচ্ছে। মক্কা একটি জনপদ, আর জনপদে পানি থাকতে হয়। পানি ছাড়া জনপদের কল্পনা করা যায় না। পূর্বেকার নবীগণ যেহেতু নির্দিষ্ট জনপদে প্রেরিত হয়েছিলেন, তাই তাঁদের জন্য তায়াম্মুমের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমাদের নবীজি হলেন গোটা বিশ্বের নবী। তাঁর উম্মত বিশ্বের আনাচে-কানাচে বিচরণ করবে। তাদেরকে এমন স্থানেও যেতে হবে যেখানে পানি নেই। এ ক্ষেত্রে তাদের তায়াম্মুমের প্রয়োজন পড়বে বিধায় মহান আল্লাহ এ উম্মতের জন্য তায়াম্মুমের বিধান নাযিল করেছেন।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT