হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রমযান মাস এলে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শিকলবন্দী করা হয়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-ক্রম : ২৩৬৬)
আল্লাহ তাআলা এই পবিত্র মাসকে যে-সব গুণ ও মর্যাদা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন, যত রহমত, বরকত এবং দয়া ও অনুগ্রহ দ্বারা একে মহিমান্বিত করেছেন, এ মাসের নেক আমলগুলোর যত সওয়াব ও প্রতিদান নির্ধারিত করেছেন তার হিসাব-নিকাশ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে এবং হাদীস শরীফের বিস্তৃত বর্ণনায় যে গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে, তার কিছু দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করব। আল্লাহ তাআলা সবাইকে উপকৃত করুন। আমীন।
১. সিয়াম ও কিয়ামের মাস
মুসলিম উম্মাহর নিকট রমযান মাসের আগমন ঘটে প্রধানত রোযা ও তারাবীর বার্তা নিয়ে। এটি রমযান মাসের বিশেষ আমল। তাই প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য, পূর্ণনিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে এ দুই বিষয়ে যত্নবান হওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি; যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বনকারী (মুত্তাকী) হতে পার।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)
২. কুরআন নাযিলের মাস
রমযান মাসের পরিচয় ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম এই বৈশিষ্ট্যের কথাই উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সুপথপ্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের যে-কেউ এ মাস পাবে সে যেন অবশ্যই এর রোযা রাখে।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)
৩. মুসলমানদের জন্য সর্বোত্তম মাস
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলার কসম! মুসলমানদের জন্য রমযানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমযান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা, মুমিনগণ এ মাসে (গোটা বছরের জন্য) ইবাদাতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনীমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ।’ (মুসনাদু আহমাদ, হাদীস-ক্রম : ৮৩৬৮)
৪. রহমতের মাস
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যখন রমযান মাসের আগমন ঘটে, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস-ক্রম : ১৮৯৮)
৫. জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভের মাস এবং দুআ কবুলের মাস
হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমযান মাসে প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। প্রতিরাতেই তা হয়ে থাকে।’ (সুনানু ইবনি মাজাহ, হাদীস-ক্রম : ১৬৪৩)
৬. দানশীলতার মাস
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। তাঁর দানশীলতা (অন্যসময় হতে) অধিকতর বৃদ্ধি পেত রমযান মাসে, যখন জিবরীল আ. তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। জিবরীল আ. রমযানের প্রতিরাতে আগমন করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন শোনাতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল হতেন।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস-ক্রম : ৬)
হযরত যায়েদ ইবনু খালিদ আলজুহানী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, সে তার (রোযাদারের) অনুরূপ প্রতিদান লাভ করবে। তবে রোযাদারের প্রতিদান হতে বিন্দুমাত্রও হ্রাস করা হবে না।’ (তিরমিযী, হাদীস-ক্রম : ৮০৭)
৭. আমলের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধির মাস
এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক আনসারী মহিলাকে বললেন, (বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর নাম ইবনু আব্বাস রা. উল্লেখ করেছিলেন কিন্তু আমি তা ভুলে গিয়েছি, অন্য বর্ণনায় তাঁর নাম উম্মু সিনান উল্লেখ করা হয়েছে) ‘তুমি কেন আমাদের সাথে হজ করতে যাওনি?’ তিনি বললেন, ‘আমাদের পানিবহনকারী দুটি-মাত্র উট রয়েছে। একটিতে আমার ছেলের বাবা (স্বামী) ও তাঁর ছেলে হজ করতে গিয়েছেন, অন্যটি পানি বহনের জন্য আমাদের কাছে রেখে গিয়েছেন। তিনি বলেন, রমযান মাস এলে তুমি উমরা করবে। কেননা, এ মাসের উমরা একটি হজের সমতুল্য।’ সহীহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রমযান মাসের উমরা একটি হজের সমতুল্য।’ অথবা বলেছেন, ‘আমার সাথে একটি হজের সমতুল্য (সওয়াবের হিসাবে)।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস-ক্রম : ১৭৮২)
৮. পাপ মোচন ও গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের মাস
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমুআ থেকে আরেক জুমুআ এবং এক রমযান থেকে আরেক রমযান মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহকে মুছে দেয় যদি সে কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-ক্রম : ২৩৩)
৯. লাইলাতুল কদরের মাস
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে মুসলিম উম্মাহর জন্য আরেকটি বিশেষ দান হলো, এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তাআলা এ রাত সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, ‘লাইলাতুল কদর এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে ফিরিশতাগণ ও রূহ (জিবরীল আ.) তাঁদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক কল্যাণময় বস্তু নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। যে রাত পুরোটাই শান্তি, যা ফজর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ (সূরা কদর : ৩-৫)
এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়া চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়। হযরত আনাস ইবনু মালিক রা. বর্ণনা করেন, ‘রমযান মাসের আগমন ঘটলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশে বললেন, “তোমাদের নিকট এই মাস সমাগত হয়েছে, তাতে এমন একটি রাত রয়েছে, যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে প্রকৃতপক্ষে সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত। একমাত্র (সর্বহারা) দুর্ভাগাই এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়।” (সুনানু ইবনি মাজাহ, হাদীস-ক্রম : ১৬৪৪)