যালিমদের পরিণতি

হযরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা হাদীসে কুদসীতে বলেন, ‘হে আমার বান্দাগণ! আমি যুলুমকে নিজের উপর হারাম করেছি এবং তোমাদের উপরও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর যুলুম কোরো না।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস-ক্রম : ২৫৭৭)

বর্তমানে মানব সমাজে ব্যাপক আকারে যুলুম-নির্যাতন ছড়িয়ে পড়েছে। পবিত্র কুরআন ও রাসূলের হাদীসে যুলুমকে হারাম ঘোষাণা করা হয়েছে। তার সাথে আবার যুলুমের নিন্দাও করা হয়েছে এবং এর ভয়াবহ পরিণামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উপরোল্লেখিত হাদীস ছাড়াও মুসলিম শরীফের অন্য একটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘তোমরা যুলুম থেকে বিরত থাকো। কেননা, কিয়ামাতের দিন যুলুমের পরিণাম হবে খুবই অন্ধকার।’

নিম্নে আমরা যুলুমের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও তার কিছু নমুনা সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।

যুলুম কাকে বলে?

وَالظُّلْمُ:  هُوَ وَضْعُ الشَّيْءِ فِيْ غَيْرِ مَحَلِّهِ.

অর্থাৎ কোনো বস্তুকে তার আসল স্থানে না রেখে অন্য স্থানে রাখার নাম হচ্ছে যুলুম।

যুলুমের প্রকারভেদ : যুলুম প্রথমত তিন প্রকার। যথা-

(১) اَلظُّلْمُ فِيْ عِبَادَةِ اللهِ -আল্লাহর ইবাদাতের ক্ষেত্রে যুলুম। মানুষের উপর আবশ্যক হলো, তারা তাদের সকল ইবাদাতকে সঠিক স্থানে রাখবে তথা এককভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে। কিন্তু অনেক মানুষ তা না করে আল্লাহর ইবাদাতে এমন এমন বস্তুকে শরিক করে থাকে, যা ইবাদাত পাওয়ার কোনো অধিকারই রাখে না। যেমন : মূর্তি, গাছ, পাথর, ওলি-আউলিয়া ইত্যাদিকে মানুষ আল্লাহর সাথে শরিক নির্ধারণ করে থাকে। আমাদের বাংলাদেশসহ আরও অনেক মুসলিম দেশের মাজারগুলোতে যে ধরনের শিরকের বাজার জমে উঠেছে, তা সুস্পষ্ট ও বিরাট একটি যুলুম।

আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘নিশ্চয় শিরক অতি বিরাট এক যুলুম।’ (সূরা লুকমান, আয়াত-ক্রম : ১৩)

(২) ظُلْمُ الْإِنْسَانِ لِنَفْسِهِ -বান্দা কর্তৃক তার নফসের উপর যুলুম। মানুষ তার কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে নানা অপরাধ ও পাপকাজে লিপ্ত হয় এবং তার প্রভুর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে থাকে। সেই ওয়াজিব ও ফরজ ইবাদাতগুলো পালনে অলসতা করে।  আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আর আল্লাহ তাদের উপর যুলুম করেননি। বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর যুলুম করত। (সূরা নাহল, আয়াত-ক্রম : ৩৩)

(৩) ظُلْمُ الْإِنْسَانِ لِغَيْرِهِ مِنْ عِبَادِ اللهِ وَ مَخْلُوْقَاتِهِ আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর বান্দাদের উপর মানুষের যুলুম। এই প্রকারের জুলুম হয়ে থাকে অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করা, মারপিট, গালিগালাজ ইত্যাদির মাধ্যমে। সাধারণত সমাজের দুর্বল ও অসহায়দের উপরই এ প্রকারের যুলুম বেশি হয়ে থাকে।

বান্দার পারস্পরিক যুলুমের কিছু নমুনা

(ক) কারও জমি অন্যায়ভাবে জবর দখল করা : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-‘যে ব্যক্তি কারও অর্ধহাত জমি জবরদখল করবে, কিয়ামাত দিবসে তার গলায় সাতটি জমি ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।’ (বুখারী ও মুসলিম)

(খ) অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করা : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমি কিয়ামাতের দিন তোমাদের কাউকে এমন অবস্থায় দেখতে চাই না যে, সে ঘাড়ে একটি চিৎকাররত ছাগল কিংবা ঘোড়া বহন করছে। সে আমাকে ডেকে বলছে, “হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করুন!” তখন আমি বলব, “আমি তোমার কোনো উপকার করতে পারব না। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি।” তোমাদের কেউ যেন কিয়ামাতের দিন গলায় এমন একটি উট ঝুলন্ত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ না করে, যে উটটি আওয়াজ করতে থাকবে।  সে বলবে, “হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন!” আমি তখন বলব, “আমি তোমার কোনো উপকার করতে পারব না। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি। তোমাদের কেউ যেন কিয়ামাতের দিন গলায় স্বর্ণ-রৌপ্য ঝুলন্ত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ না করে। সে বলবে, “হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন!” তখন আমি বলব, “আমি তোমার কোনো উপকার করতে পারব না। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি।”  তোমাদের কেউ যেন কিয়ামাতের দিন গলায় কাপড়ের বোঝা ঝুলন্ত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ না করে। সে বলবে, “হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন!” তখন আমি বলব, “আমি তোমার কোনো উপকার করতে পারব না।  আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি।” (বুখারী

(গ) বিনা কারণে কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া : বিনা প্রয়োজনে কোনো প্রাণী হত্যা করাও যুলুম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-‘আমার কাছে জাহান্নামকে পেশ করা হলো। তাতে দেখলাম, বনী ইসরাঈলের একটি মহিলাকে একটি বিড়াল হত্যা করার অপরাধে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। উক্ত মহিলা বিড়ালটিকে বেঁধে রাখত। সে নিজেও বিড়ালকে কোনো কিছু খেতে দেয়নি এবং যমীন থেকে পোকা-মাকড় ধরে খাওয়ার জন্য ছেড়েও দেয়নি। এভাবে ক্ষুধার তাড়নায় বিড়ালটি মৃত্যুবরণ করে।

(ঘ) ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা : আল্লাহ তাআলা বলেন-‘যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করে নিশ্চয় তারা স্বীয় উদরে অগ্নি ব্যতীত কিছুই ভক্ষণ করে না এবং সত্বরই তারা প্রজ্বলিত অগ্নিতে প্রবেশ করবে। (সূরা নিসা, আয়াত-ক্রম : ১০)

ঙ) বিনা কারণে কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ইত্যাদি। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয় হতে বিরত থাকবে।’ সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেগুলো কী কী?’ নবীজি বললেন, ‘তা হলো (১) আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করা, (২) জাদু করা, (৩) আল্লাহ তাআলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, (৪) সুদ খাওয়া, (৫) ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা (৬) যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করা (৭) সতী-সাধ্বী মুমিন মহিলার ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া।’

এমনিভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, মানুষকে কষ্ট দেওয়া, চুরি করা, কারও নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, শ্রমিকের অধিকার নষ্ট করা, আমানতের খেয়ানত করা, মানুষের গিবত করা, মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করা, ওয়াদা-অঙ্গীকার ভঙ্গ করাসহ আরও অসংখ্য যুলুম রয়েছে, যা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।

রাষ্ট্রীয়ভাবে যুলুম

বর্তমানকালে যে যুলুমটি দিবালোকের মতো সুষ্পষ্ট ও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে যুলুম। এ ক্ষেত্রে আমরা মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের পক্ষ হতে জনসাধারণের উপর যে যুলুম হচ্ছে তার কিছু উদাহরণ পেশ করার চেষ্টা করব।  যুগে যুগে অনেক যালিম সরকার বা রাষ্ট্রনায়ক পৃথিবীর বুকে আগমন করেছে। তাদের প্রত্যেকেই করুণ ও ভয়াবহ পরিণতির শিকার হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ফেরাউন ভেবেছিল সে দুর্বলের উপর যুলুম করে চিরস্থায়ী হতে পারবে। কিন্তু সে আল্লাহর পাকড়াও হতে রেহাই পায়নি। কুরআন বলছে, ‘সকাল-বিকাল ফেরাউন সম্প্রদায়ের সামনে জাহান্নামের আযাব পেশ করা হয়। কিয়ামাতের দিন তাদেরকে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ করা হবে।’

নমরুদ তা-ই ভেবেছিল। সেও একইভাবে পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছে। তদ্রুপ আরও অনেক স্বৈরাচার পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে আল্লাহর বান্দাদেরকে কষ্ট দিয়ে শেষ রক্ষা পায়নি। বর্তমান শতাব্দীর মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় স্বৈরশাসকের কথাই বলি। তিউনিসিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদীনের নামটি খুবই সুন্দর। কিন্তু তার কাজগুলো শয়তানি কর্মকাণ্ড ছাড়া কিছুই ছিল না। এই অহংকারী যালিম সমগ্র তিউনিসিয়াকে একটি বিশাল জেলখানায় পরিণত করেছিল। এই যালিম ও স্বৈরাচারের কর্মকাণ্ডে বোঝা যাচ্ছিল ক্ষমতায় সে চিরস্থায়ী হবে। তিউনিসিয়ার যমীন থেকে ইসলামের নাম-নিশানা মিটিয়ে ফেলতে সে কোনো প্রচেষ্টাই বাদ রাখেনি। ইসলামপন্থিদের উপর যে নির্যাতন সে করেছে, তার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। সে তার রাষ্ট্রে মুসলিম নারীদের উপর হিজাবকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। কোনো একজন আরব লেখক আফসোস করে বলেছেন-জয়নুল আবেদীন তার দেশে নারীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করেছিল। পরিশেষে সে তার হিজাব পরিহিত স্ত্রীসহ হিজাবের দেশেই পলায়ন করতে বাধ্য হলো (তার এক সময়কার বন্ধু ফ্রান্স এবং অন্যান্য রাষ্ট্র তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় সে তার হিজাব পরিহিত স্ত্রীসহ সৌদি আরবে পালিয়ে গিয়েছে)।

পরিশেষে বলতে চাই, হে অন্যের উপর যুলুমকারী! জেনে রাখো, মাযলুমের দুআ অচিরেই কবুল হবে। ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-‘তোমরা মাযলুমের বদদুআ থেকে বেঁচে থাকো। যদিও সে কাফির হয়। কেননা, মাযলুমের দুআ কবুল হওয়ার কোনো অন্তরায় নেই।’

সুতরাং হে যালিম! যুলুম থেকে বিরত হও। অন্যথায় অচিরেই মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে যুলুমের ফলাফল তোমাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে।

হে জালিম! তুমি আল্লাহর সেই বাণীকে স্মরণ করো, যেখানে তিনি বলেছেন-‘যালিমরা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহকে কখনও বেখবর মনে করো না। তাদেরকে তো ওই দিন পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে রেখেছেন, যেদিন চক্ষুসমূহ অবনত হবে। তারা মস্তক উপরে তুলে ভীত-বিহ্বল চিত্তে দৌড়াতে থাকবে। তাদের দিকে তাদের দৃষ্টি ফিরে আসবে না এবং তাদের অন্তর উড়ে যাবে।’ (সূরা ইবরাহীম, আয়াত-ক্রম : ৪২-৪৩)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন-‘আর তোমার পরওয়াদেগার যখন কোনো যালিম জনপদকে ধরেন, তখন এমনিভাবেই ধরে থাকেন। নিশ্চয় তাঁর পাকড়াও খুবই মারাত্মক, বড়ই কঠোর।’ (সূরা হুদ, আয়াত-ক্রম : ১০২)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন-‘যালিমরা শীঘ্রই জানতে পারবে তাদের গন্তব্যস্থল কীরূপ।’ (সূরা শুআরা, আয়াত-ক্রম : ২২৭)

সুতরাং হে যালিম! এখনও সময় আছে। আল্লাহর বান্দাদের উপর যুলুম করা থেকে ক্ষ্যান্ত হও। আল্লাহর কাছে তাওবা করো। তোমার জন্য এখনও তাওবার দরজা খোলা আছে। তাওবা করলে তোমার সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।

হে আল্লাহ! আপনি মাযলুমদের দুআ কবুল করুন। যালিমদের পতনকে তরান্বিত করুন এবং তাদেরকে হিদায়াত করুন। দুর্বল ও অসহায়দেরকে সাহায্য করুন। আমীন।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT