যাপিত জীবনের উপাখ্যান

আমাদের ছোট্ট একটি নীড়। দুচালা টিনের ঘর। মা আর আমি সেই কচিনীড়ে বাস করি। আমার মনে হয়, এটিই আমাদের স্বপ্নের আবাসন। রাতের সঙ্গে নৈশালাপে নির্ঘুমে কেটেছে আমাদের হাজারও রাত। বৃষ্টির দিনে চালের ফুটো দিয়ে খটখট করে পড়েছে গায়ে অসংখ্য জলকণা। জবুথবু ঘুম ভেঙে শীতের শিহরণে জেগে উঠেছি কত-না দুপুর-রাতে। আমরা এভাবে এক চিলতে ঘরে বেড়ে উঠেছি পাখির মতো। বুঝ হওয়ার পর অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে স্বাধীন বাতাসে উড়ে যাওয়ার। পৃথিবী ছেড়ে বহুদূরে কোথাও চলে যাওয়ার। কিন্ত পারছি না!

সবাই বলে আমরা অনেক সুখী! ছোট্ট পরিবার। আমিও বলি, হ্যাঁ, আমরা তো সুখীই। না থাকুক আমাদের কোনো দালান। পাকার ঘর-দোর। ক্ষেতের জমিজায়গা। তবুও মা আমাদের বলেন, বেশ আছি বাবা! ঘরে আছে আমাদের ত্রিশ পারা কুরআন শরিফ। মায়ের একশ দানার একটি তাসবিহ-ছড়া। মুর্তা বেতের নামাজের আদি। জায়নামাজ। আমার আছে, একটি টুপি, দুটো পাঞ্জাবি, বই-পুস্তক, আর ডায়েরি লেখার দিস্তা দিস্তা খাতা। কলমের বক্সও আছে। এগুলো আমি সখ করে কিনেছি। কলম-কাগজ বেশি দরকার পড়ে।

অবসরে সময় কাটে না। মাঝে মাঝে মায়ের কাজে সহযোগী হই। নতুবা বেকার। বেকার সময় কাটানো আমার আদৌ না-পছন্দ! তাই লিখতে খুব ভালোবাসি। ইদানীং লেখালেখিটা নেশায় পরিণত হয়ে গেছে। পাঠেরও প্রবণতা আছে বড্ড। বাড়িতে এলে শোবার খাটের ওপর ছড়ানো-ছিটানো থাকে রকমারি বই। বিভিন্ন দৈনিকও। বই যে শুধু আমি একা পড়ি তা না, আমার মাও পড়েন। তিনি বই পড়তে পছন্দ করেন। সেদিন ঘরে প্রবেশ করে দেখি, মা রবিঠাকুরের গল্পগুচ্ছ পড়ছেন। আমাকে দেখে ইতস্তত গলায় বললেন, ‘কী রে বাবা; খাইলে না যে এখনো?’ ছেলেরা না খেলে বুঝি পৃথিবীর সব মা-ই বিচলিত থাকেন!

তবুও দুঃখ হয়! বই তো আর একটা-দুইটা না। হাজারটা হবে। রাখার জায়গা নেই। এই এক পিয়ালা তীব্র ব্যথা মাকে কখনও বলি না। তবে আমার বইয়ের প্রতি মা এবং ভাইয়ার অগাধ প্রেম যুক্ত আছে। ১৮ সালের বন্যা যখন রাক্ষসের মতো ধেয়ে আসছিল, পুরো মৌলভীচক গ্রাম পানিতে থৈথৈ। ভাইয়া বলল, ‘আমরা ভেসে গেলেও আমার ভায়ের বইগুলোকে ভেসে যেতে দেব না!’ আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। জৈষ্ঠ মাস ছিল। রোজা-ঈদের ছুটিতে শহরে আটকে থাকতে হয়েছে। মা ঈদের তিনদিন আগে ফোনে জানালেন, ‘বাবা, খবরদার, তুই কিন্তু বাড়ির দিকে পা বাড়াস নে!’ আমি বললাম, ‘কেন মা, কী হয়েছে?’ মা বললেন, ‘মনু গাঙ ভেঙে গেছে। বড় সড়কে হাঁটুজল। প্রচণ্ড বন্যার স্রোতে অনেক মানুষ নিখোঁজ!’

ঈদের তিনদিন পর শহর থেকে বাড়ি এলাম। বন্যার চিহৃ চতুর্দিকে বিদ্যমান। বড় সড়কে এখনও টাখনু পরিমাণ পানি। পানিতে অসম্ভব দুর্গন্ধ! আমাকে দুর্গন্ধময় কাদামাখা জল মাড়িয়ে আসতে দেখে সম্মুখ দিক থেকে পরিচিত একটি কণ্ঠ হাঁক দিয়ে উঠল, ‘থাম্ থাম্! পিছনে যা! এই নোংরা পানি পায়ে মাখিস না।’ তাকিয়ে দেখি, আমার ভাইয়া; রাসেল। ‘ভাই, কতদিন দেখি না তোমাকে! মা কেমন আছেন?’ ‘ভালো আছেন। তোকে দেখার জন্য মোড়ে বসে আছেন।’ আহা, মায়ের মন! ভাইয়া তাড়া দিলো—‘তাড়াতাড়ি বাড়ি চল্।’ তারপর অন্য পথে বাড়িতে গেলাম। ভাইয়া জানাল, বন্যার জল মহামারির মতো। গা পঁচে যায়। পা পঁচে যায়। বন্যার দিনে শুদ্ধ পানির জন্য মানুষ তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারেনি। গোসলও করতে পারেনি। রান্নাবাড়া করে ঠিক মতো খেতেও পারেনি। শহরে পত্র-পত্রিকায় দেখেছি আপন গ্রামের বন্যাকবলিত ছবি! মানুষের অসহায় মুহূর্তে হৃদয়ে, আত্মায় কলিংয়ের মতো বেজেছে কেবল পাড়-ভাঙার শব্দ!

গোরস্তান পার হতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমাদের দুচালা টিনের ঘর। আম্মা অবাক চোখে এসে আশ্চর্য বুকে আমাকে জড়িয়ে ধরে দুকপোলে চুমু খেলেন। আমি হাড্ডিসার দাঁড়ানো মায়ের মায়াবী চেহারার দিকে তাকিয়ে তৃপ্ত হলাম। মা, তুমি এমন কেন? তোমাকে এক পলক দেখার জন্য বাড়ির মেঘলা আকাশের দিকে কতবার মাতৃস্নেহের অনাহারে তাকিয়েছি। আকাশে দেখেছি, অখণ্ড হিজলরঙা মেঘ। মেঘের চারিদিকে লুকোচুরি খেলতে দেখেছি চাঁদকে। অসংখ্য তারার মাঝে মুঠো মুঠো স্বপ্ন নিয়ে ছুঁতে চেয়েছি কেবল ঐ একটাই তারাকে। যে তারা আজ ধবল জোছনাকুমারী হয়ে দেখেছে আমার মায়ের গোমটা-ভরা মুখ!

বেড়ার ঘর বলে তেমন সাজগোছ নেই। প্রাচীন বাঁশের বেড়া। বাড়িতে সবার ঘরের দেয়ালে ইট, সিমেন্টের আস্তর। শুধু আমাদের ঘরটাই কাঁচা। তারপরও মা আছেন, তাই ঘরটা অদ্ভুত সুখময়। দু-চারদিন পর মেঘবাদলার দিন হবে। প্রচণ্ড তোফান বইবে বোশেখে। বোশেখের তোফান ভীষণ ভয়ংকর। তোফান যেন শুধু আমাদের মতোই ঘরদোর-ওয়ালা লোকদের মনে ভীতি সঞ্চারক। তাই অস্থিরতা বোধ করে মা খুন্তি দিয়ে গর্ত করে খুঁটি লাগানোর প্ল্যান করলেন। মানুষ মানুষের কাজে ব্যস্ত! সময় এখন সোনার হরিণ। টাকা দিয়েও কাজের লোক জুটছে না। হঠাৎ একদিন পড়ন্ত বিকেলে, পাশের বাড়ির ‘বুরহান দাদা’ আমাদের বাড়িতে এলেন। মানুষ এমনও হয়! যারা দুঃখ বুঝে অন্য মানুষেরও। আম্মার সাথে আলাপআলোচনার পর বললেন, ‘আরে তোমাদের ঘরের বেড়া তো দেখছি হাল্কা বাতাস দিলেই ধসে যাবে।’

পরদিন ভোরবেলা বুরহান দাদা এসে আমাদের ঘর ঠিক করে দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমারও তো তোমাদের মতো ছোট্ট কুটির। গেল রোববার মেরামত করেছি। কিন্তু তোমাদের ঘর মেরামত না করলে বর্ষাদিনে মসিবতে পড়বা। তাই সাহায্য করতে মন চাইল!’ বুরহান দাদাকে দুবেলা ভাত, মাঝে মাঝে চা নাশতাও খাওয়ালাম। মজুরির টাকা দিতে গেলে বুরহান দাদা নিতেই চাইলেন না! তারপরও আম্মা তিনশ টাকা হাতে দিয়ে বললেন, মিলের বাজারে চা খেয়ে যেও!

ঘরের সকল কাজ মা-ই গোছান একহাতে। যেমন রান্নাবাড়া, শাকসবজি কুটা, চুলোয় আগুন জ্বালানো, ঘুমের সময় মশারি টাঙানো, বিছানা পরিচ্ছন্ন করা, ঘর ঝাড়ু দেওয়া, সকালে চা করা, তিন বেলার পাকশাক মা একাই আঞ্জাম দিয়ে যান। সন্ধ্যেটা ঘরে খুব মধুর হয়ে কাটে। এই যেমন নামাজ পড়ে বই পড়ায় মগ্ন হলাম, আম্মা সুরা ওয়াকেয়া তেলাওয়াত করে প্রথমে চা করেন। ওয়াকেয়া পড়ার সময় আমি মায়ের মুখের দিকে তাকাই। বারবার তাকাই। মা এত মিষ্টি সুরে কোরআন পড়তে পারেন! নির্ভুল উচ্চারণে। একদিন গল্পে গল্পে মা বলেছিলেন তাঁর মক্তব জীবনের গল্প। মা স্কুলেও পড়েছেন।

দাদা যেদিন মাকে ‘বৌ-মা’ বানিয়ে আনতে গেলেন সেদিন মাকে দুটো প্রশ্ন করেছিলেন; মা কি কুরআন শরিফ তেলাওয়াত করতে পারেন আর চিঠি কি লিখতে পারেন? আমার নানা আব্দুল লতিফ সেদিন বুক ফুলিয়ে আপন মেয়েকে নিয়ে গর্ব করতে পেরেছিলেন বেয়াই-লোকদের সামনে। আমার মায়ের নাম ‘শিল্পী বেগম’। আমার নানু এখনও বেঁচে আছেন, মাঝে মাঝে মায়ের গল্প নানুও করেন। মায়ের ছোটবেলার কোন কথা কেউ শোনালে, নড়েচড়ে বসি। আবেগ জমে বড্ড। তো নানুও বলেন, ‘তোর মা হুরুবেলায় পড়ালেখায় অত্যন্ত ভালা আছিল। মেধায় প্রখরতা আছিল। একদিনও ইশকুল, মক্তব বাদ দিত না।’ নানুদের লাগোয়া বাড়িতে তখন হিন্দুরা বসবাস করত। অনেকদিন রাতের বেলা মায়ের সঙ্গে নানাবাড়ি যাওয়ার সময় মণ্ডপের আগুন দেখে দেখে যেতাম। নানু বললেন, ‘একদিন হয়েছে কি জানিস, ঐ বাড়িতে উজা আসবে। পুরো পালপুরবাসী উজার মন্ত্র পড়া দেখতে যাবে। তোর বড় মামা মুখলিছ তখন শিল্পীকে হিন্দু বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছে।’ কেন? নানু বললেন, ‘সে তো তখন যা শুনত মুখস্থ করে ফেলত। সেগুলা ফের এসে এখানে বলবে আর ভূত-প্রেত আমাদের বাড়িতে চলে আসবে। সেই জন্য।’

মা এবং ভাইকে নিয়ে আমার ছোট্ট পরিবারের কত অগোছালো গল্প আছে। আমরা যখন খুব ছোট্ট, মা পৃথিবীকে একদিকে সরিয়ে আমাদের লালন-পালন নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিলেন। করোনার এই সময়ে নবধ্বনির জন্য ঘরবন্দী জীবন নিয়ে লিখতে বসে কী অগোছালো কথা লিখে ফেললাম।

মৌলভীচক, রাজনগর, মৌলভীবাজার

 

এ জাতীয় আরো লেখা

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT