সুস্থ থাকার জন্য পানিপানের গুরুত্ব বিপুল। শরীরকে ভালো রাখতে চান, মানে আপনাকে পানি পান করতে হবে। আধুনিক ডাক্তারিবিদ্যা প্রতিদিনের পানিপানের পরিমাণও জানিয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্যা ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বোর্ড অব দ্যা ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স’ এর পরামর্শ হলো শরীর ভালো রাখতে হলে প্রতিদিন পান করতে হবে দুই থেকে আড়াই লিটার পানি। দেহে পানি স্বল্পতা বহু জটিলতার জননী। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা জরুরি দেহের কোষ, কলা বা টিস্যু, বিভিন্ন অঙ্গ তথা মস্তিষ্ক, কিডনী, পাকস্থলী, ত্বক, চুল ইত্যাদির যথাযথ কার্যকারিতার জন্য। শরীরের সকল প্রকার কাজের সুষ্ঠ ও যথাযথ গতিশীলতার জন্য। কর্মসম্পাদনে দৈহিক উপযোগ নিশ্চিত করার জন্য। পানিস্বল্পতা তৈরি করে ক্লান্তি, অবসাদ। এর কারণ ব্যাখ্যা করেন পুষ্টি বিজ্ঞানী প্যালিনস্কি ওয়েড। তিনি বলেন , ‘অনেক সময় দেহে সামান্য পানির স্বল্পতা ক্লান্তি সৃষ্টি করে। কারণ মস্তিষ্কের ৮০ শতাংশ পানি দিয়ে তৈরি। তাই পানির অভাবে এর কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
পানির প্রয়োজন কেবল প্রত্যক্ষ উপায়ে পূরণ হয়, তা নয়। বরং কঠিন খাবারও পানির যোগান দেয়। মানবদেহে ২০ শতাংশ পানির যোগানদাতা হলো কঠিন খাবার। এ ক্ষেত্রে জলীয় উপাদানে সমৃদ্ধ খাবার বেশি উপকারী। যেমন ফল, সবজি ইত্যাদি। শসার কথা ধরা যাক, তার ৯৬.৭ শতাংশ পানি। লেটুস, টমেটো, তরমুজ, আঙুর ও সবুজ মরিচের প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি পানি। পুষ্টি ও ভিটামিন সমৃদ্ধ এরকম সবজি প্রাকৃতিক আয়োজনে আমাদের শরীরের পানি-চাহিদা পূরণ করে নানাভাবে। তবুও দেহের তরলতার প্রয়োজন পূরণে প্রতিদিন আটগ্লাস পানি পানের পরামর্শ আসে বিশেষজ্ঞসূত্রে। বিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ব্যক্তির লিঙ্গ, বয়স, ওজন, দৈনন্দিন শারীরিক কাজের পরিমাণ ও আবহাওয়ার তারতম্যের উপর ভিত্তি করে প্রয়োজনমত পানি পান করা সবচেয়ে উত্তম।
অতিরিক্ত পানি পানেও সমস্যা রয়েছে। এর ফলে রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা গুরুতরভাবে কমে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিকে বলে ‘হাইপোনেট্রেমিয়া’। অতিরিক্ত বা জবরদস্তিমূলক পানি পানের ফলে মস্তিষ্কে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে। অজ্ঞান অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। জন্ম নিতে পারে কোমা। ফলে যাচ্ছেতাই প্রক্রিয়ায় পানি পান চলবে না। একে কল্যাণকর মাত্রায় পান করতে হবে। তবে পানি পানের উপকারিতা পেতে হলে মাত্রা ঠিক থাকাটাই যথেষ্ট নয়, বরং সঠিক উপায়ে তা পান করতে হবে। নতুবা বিপদ। বিপদটা হলো স্বাস্থ্যগত। কারণ ভুল প্রক্রিয়ায় পানি পানে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি।
ভুল প্রক্রিয়া বলতে অনেক কিছু। যেমন শারীরিক পরিশ্রম করে খুব অবিলম্বে পানি পান কিংবা যখন খুব ঘাম হয়, তখন খুব তাড়াহুড়া করে পানি পান। প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান আত্মঘাতি। এটা মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য নষ্ট করে, রক্তচাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। খুব বেশি মাত্রায় খুব ঠাণ্ডা পানি পান ক্ষতিকর। এটা সত্য যে, ২০০৩ সালে সম্পন্ন এক গবেষণা দেখায় যে, বরফ ঠাণ্ডা পানি পানে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বিপাক বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু একই ফলাফল গরম পানিতে নেই, তা বলার সুযোগ নেই।
ঘুমের আগে পানি পান সাধারণভাবে কল্যাণকর নয়। যখন পিপাসা হয়, পানি পান করা উচিত। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ তৃষ্ণা লাগলেও পানির বদলে গ্রহণ করে খাবার। যুক্তরাষ্ট্রের পুষ্টিবিদ লিসা জুবলির মতে, এটা ঘটে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে। কিন্তু উচিত হলো, যখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা অনুভব হবে, তখন প্রথমে পানি পান করে ২০ মিনিট অপেক্ষা করা। যদি এর পরেও ক্ষুধা না মিটে তাহলে খাবার খেতে হবে। তেমনি সকালে ঘুম থেকে উঠে ২০ থেকে ৩০ আউন্স পানি পান করা বিপাক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কারণ রাতে লম্বা সময় ঘুমের মধ্যে পানি শূন্য থেকেছেন। ফলে বিপাক ক্রিয়া তখন হয় ধীর। তাই সকালে কোনো খাদ্য মুখে দেবার আগে পর্যাপ্ত পানি পান খুবই উপকারী। এতে পেট ফোলাভাব কমা, বেশি শক্তি অনুভব করা এবং ক্ষধা হ্রাস পায়।
পানিপানের অন্যতম ভুল পদ্ধতি হলো দাঁড়িয়ে ও দ্রুত পানি পান করা। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্সটিটিউট অব মেডিসিন’ জানায় দ্রুত গতিতে বা দাঁড়িয়ে পানি পান করা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করে। যখন কেউ দাঁড়িয়ে পানি পান করেন, সেই পানি সরাসরি পাকস্থলীতে গিয়ে আঘাত করে। কমিয়ে দেয় স্টমাক থেকে নিঃসৃত অ্যাসিডের কর্মক্ষমতা। বাড়িয়ে দেয় বদহজমের আশঙ্কা। তৈরি করে বহু সমস্যা, সৃষ্টি করে তলপেটে যন্ত্রণা। আপনি যখন দাঁড়িয়ে পানি পান করছেন, তখন পানি দ্রুত চলে যায় কোলন বা মলাশয়ে। যার ফলে পানিতে নিহিত প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপকরণ শরীরে শোষিত হয় না। গ্যাস্ট্রো ইসোফেগাল রিফ্লাক্স ডিজিজ এর সাথে রয়েছে দাঁড়িয়ে পানি পানের সম্পর্ক। কেউ যদি দাঁড়িয়ে পানি পানের অভ্যাস করে ফেলেন, তার ইসেফেগাসে সরাসরি পানির ধাক্কার ফলে পাকস্থলীর ভেতরের সরু নালিটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই ক্ষতি শরীরে ডেকে আনে মারাত্মক রোগ, যার নাম জি ই আর ডি বা গ্যাস্ট্রো ইসোফেগাল রিফ্লাক্স ডিজিজ।
আমাদের শরীরে রয়েছে পানি পরিশ্রম্নত করার বহু ছাকনি। পানি পানের পরে ছাকনিগুলো আপন কাজ শুরু করে দ্রুত। কিন্তু যখন দাঁড়িয়ে পানি পান করা হয়, তখন শরীরের ছাকনিগুলো সঙ্কোচিত হয়ে যায়। এর ফলে দেহে বাড়তে থাকে টক্সিনের মাত্রা। দাঁড়িয়ে পানি পান করার সঙ্গে আর্থরাইটিসের সম্পর্ক রয়েছে। এতে শরীরের ভেতরের কিছু উপকারী রাসায়নিকের মাত্রা কমতে শুরু করে। ফলে জয়েন্টের কর্মক্ষমতা কমে যেতে পারে। পানির উৎসে মুখ ডুবিয়ে কিংবা দাঁড়িয়ে পানি পানের ফলে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় কিডনির। কিডনির কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। এমনকি সেটা ড্যামেজ হবার ভয়ও বাড়তে থাকে। এর পাশাপাশি মানসিক জগতেও দাঁড়িয়ে পানিপানের প্রভাব হয় নেতিবাচক। এভাবে পানিপানের ফলে নার্ভ উত্তেজিত হয়ে যায়, এবং বাড়তে থাকে উদ্বেগের মাত্রা। শুয়ে পানি পান করাও বিপজ্জনক। এতে গলায় পানি আটকে বিষম খেতে পারেন। শ্বাসনালীতে ঢুকে যেতে পারে পানি। যার ফলে দেখা দেবে বিচিত্র ও জটিল সমস্যা।
এ পরিস্থিতি থেকে সুরক্ষার শিক্ষা রয়েছে মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাদ্যব্যবস্থাপনায়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়ানো, হাঁটা বা শোয়া অবস্থায় পানি পান না করে বসে বসে পানি পান করার নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত আনাস রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে পানি পান করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। (সহিহ মুসলিম, হাদীস-ক্রম : ২০২৪)।
একসঙ্গে অনেক পানি পান ক্ষতিকর। একটু একটু পানি পান করা উচিত। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে খুব জোরে সোরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ম্যারাথন মেডিক্যাল ডিরেক্টর অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা প্রচার করছে, ধীরে ধীরে, বিরতি নিয়ে নিয়ে পানি পান করতে হবে। কারণ পানির অপর নাম কেবল জীবন নয়, তা হবে মরণও।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা এক চুমুকে উটের মতো পানি পান করো না; বরং দুই-তিনবার (শ্বাস নিয়ে) পান করো। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস-ক্রম : ১৮৮৫)। মশক, কলসি, বড় পাত্র ইত্যাদিতে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মশকের মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে বারণ করেছেন। (রিয়াজুস সালেহিন, হাদীস-ক্রম : ৭৬৭)
পানি পানের মুহূর্তেও খেয়াল রাখতে হবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়েছেন বাম হাতে পানাহার না করতে। ব্যবহার করতে হবে ডান হাত। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস-ক্রম : ৩২৬৮)
পানি পান করতে হবে পাত্রে। পাত্র হতে হবে পরিষ্কার। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়েছেন- রাতের বেলা পানপাত্র আন্দোলিত না করে (পরিষ্কার না করে) কেউ যেন পানি পান না করে। তবে পাত্র ঢাকা অবস্থায় থাকলে ভিন্ন কথা। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস-ক্রম : ৩৪৩১)
পানির পাত্রে নিঃশ্বাস ফেলা যাবে না। কারণ আমরা জানি, এই নিঃশ্বাসের সাথে অগণিত ক্ষতিকর উপাদান পানের পানিতে এসে মিশে যায়। যা দেহের সুস্থতার জন্য বিপদ ডেকে আনবে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা (পান করার সময়) পাত্রে নিঃশ্বাস ফেলো না। (সহিহ বুখারি, হাদীস-ক্রম : ১৫৪)। এতো গেলো পানি পানের ব্যবহারিক নির্দেশনা। কিন্তু আধ্যাত্মিক নির্দেশনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে পানি আমরা পান করছি, তা আল্লাহর একান্ত দান।
স্বাস্থ্যের সাথে পানির সম্পর্ক বর্ণনার অতীত। গাছের শেকড়ে পানি না দিলে গাছ শুকিয়ে যায়, মরেও যেতে পারে। তেমনি পানির অভাবে আমাদের শরীরে পুষ্টি সরবরাহ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয়। শরীর শুকিয়ে যায়। আপনি না খেয়ে বাঁচতে পারেন কয়েক সপ্তাহ, কিন্তু পানি না পান করলে মারা যাবেন কয়েক দিনের মধ্যেই। গড়পড়তা মানুষের শরীরের ৫০-৬৫ ভাগই পানি। আর নবজাতকদের শরীরের ৭৮ শতাংশ পানি। অক্সিজেনের পরই পানি আমাদের জীবন ধারণের জন্য দ্বিতীয় উপাদান। অন্যদিকে ২৫ ভাগ অক্সিজেন পানি থেকে আসে। প্রয়োজনীয় পানিপানের অভাবে দেখা দেয় অনেক রকম সমস্যা, যেমন- পানিশূন্যতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনির সমস্যা, শরীরের টক্সিন জমা ইত্যাদি।
কিন্তু এই পৃথিবীতে ৭৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত। ২৪৮ কোটি মানুষ সঠিক পয়ঃনিষ্কাশন-ব্যবস্থার আওতায় নেই। এই বাস্তবতায় আপনি পানি লাভ করলেন, যাকে আপনি সৃষ্টি করেননি। পান করতে সক্ষম হলেন এবং এর উপকার ভোগ করছেন। ফলে আপনাকে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। যিনি এর ব্যবস্থাপনা করে দিয়েছেন, সেই প্রভুর প্রতি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন তোমরা পান করো, তখন শুরুতে বিসমিল্লাহ এবং শেষে আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করবে। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস-ক্রম : ১৮৮৫)। পানির অপচয় রোধের নির্দেশনাও দিয়েছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কোনোভাবেই অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা যাবে না। পানি নষ্ট করা যাবে না। এমনকি যখন ওযু করছেন, তখনও সাবধান থাকতে হবে। যদি আপনি প্রবহমান নদীর পাশে বসে পানি ব্যবহার করেন, তখনও অপচয় নিষিদ্ধ। একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত সাদ রাযিআল্লাহু আনহু-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় সাদ রাযিআল্লাহু আনহু ওযু করছিলেন। তার ওযুতে পানি বেশি ব্যয় হচ্ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দেখে বললেন, কেন এই অপচয়? সাদ রাযিআল্লাহু আনহু আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওযুতেও কি অপচয় হয়? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন হ্যাঁ, এমনকি বহমান নদীতে ওযু করলেও। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস-ক্রম : ৪২৫)।