মহানবীর খাদ্যব্যবস্থাপনা ও ফুড সাইন্স (চতুর্থ কিস্তি)

চামচ দিয়ে খাওয়া বৈশ্বিক এক প্রবণতা। কারো কাছে এটি প্রগতিশীলতা, কারো কাছে লাইফ স্টাইল, কারো কাছে উন্নত রুচির ব্যাপার। কিন্তু আসলেই কি চামচ দিয়ে খাওয়া উন্নত কোনো বৈশিষ্ট্য? এতে কি আছে কোনো উপকার? শুরুতেই বলে রাখি, একান্ত প্রয়োজনে কাটা চামচ দিয়ে খাওয়া শরিয়ার বিচারে অবৈধ নয়। যেভাবে অবৈধ নয় হাতিয়ারের ব্যবহার। কিন্তু সুন্নাহ হলো ডান হাত দিয়ে খাওয়া। প্রিয় নবী ﷺ আঙুল ও পাত্র চেটে খাওয়ার আদেশ দিয়েছেন। তাঁর আদেশের প্রজ্ঞা ও কল্যাণকারিতা বিপুল। এ বিশ্বাস রেখেও অনুসন্ধানী মানুষ জানতে চায় কী ক্ষতি কাটা চামচ দিয়ে খেলে? কী উপকার হাত দিয়ে খাওয়ার?

কাটা চামচে খাওয়া অধিক উপকারী না হাত লাগিয়ে খাওয়া, এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ফলাফল উপস্থাপন করে টাইমস অব ইন্ডিয়া। ২০২০-এর ৯ এপ্রিল প্রকাশিত এ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- Eating with spoon or with hands? Find what’s better for your health| এ প্রতিবেদনে হাত দিয়ে খাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হয় স্বাস্থ্যগত ও মানসিক উপকারের বিচারে। এ প্রাধান্যদানের পাঁচটি দিক ছিল-

এক. Increases blood circulation মানে হাত দিয়ে খাবার গ্রহণ শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়।

দুই. Helps you maintain food proportion, মানে হাত দিয়ে খাবার গ্রহণ খাদ্যের মাত্রা ও অনুপাত বজায় রাখতে সহায়তা করে।

তিন. Forms a connection with food মানে খাবার গ্রহণের এ প্রক্রিয়া খাবারের সাথে সংযোগ ও সামঞ্জস্য নিশ্চিত করে।

চার. Better digestion মানে হাত দিয়ে খাবার গ্রহণে উত্তমভাবে হজম নিশ্চিত হয়।

পাঁচ. Might prevent type-2 diabetes মানে হাত দিয়ে খাবার গ্রহণের প্রক্রিয়া টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে সক্ষম।

খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ক বিখ্যাত সাময়িকী টাইমস ফুড এ বিষয়ে প্রকাশ করে একাধিক প্রতিবেদন। ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল 9 Reasons why you must feel good about eating with hands| এতে দেখানো হয় ৯টি এমন দিক, যা হাত দিয়ে খাওয়াকেই উত্তম প্রমাণ করে। দিকগুলো হচ্ছে-

১. It increases blood circulation হাত দিয়ে খেলে রক্তসঞ্চালন বাড়ে।

২. It intensifies sensual connection with food এ প্রক্রিয়া খাবারের সাথে ইন্দ্রিয়গত সংযোগকে তীব্র করে।

৩. Better digestion হজমের ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া উত্তম।

৪. It directly affects our chakras হাত দিয়ে খাওয়ার ফলে গতি ও স্পর্শ আমাদের দেহের চক্রকে প্রভাবিত করে, সক্রিয় করে।

৫. You know your food is hot হাত দিয়ে খেলে আপনি জানবেন খাবারটি কেমন? গরম না ঠান্ডা। কাটা চামচের চেয়ে অবশ্যই মানুষের হাত বেশি অনুভূতিসম্পন্ন।

৬. It is hygienic too স্বাস্থ্যগত উপকারে এর জুড়ি নেই।

৭. Cutting a paratha with knife শহরভব কাটা চামচ দিয়ে পরোটা খাওয়া যায়, যেভাবে চামচ দিয়ে ডাল। এটাই সুবিধাজনক। সহজাত।

৮. Non-veg with bones আমিষ খাবারে হাড় আছে। তাকে খেতে হাত জরুরি।

৯. Food served on leaves মানে বিভিন্ন জায়গায় ও পরিস্থিতিতে খাবার পরিবেশন করা হয় পাতা বা পাতার মতো সমতল জিনিসে বা প্লেটে। হাত দিয়ে খেলে খাবারকে সামলানো যাবে। কাটা চামচ দিয়ে খেলে খাবার ছড়িয়ে পড়বে। বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হবে।

বস্তুত হাত দিয়ে খাওয়াটাই প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতা। হাতের অন্যতম কাজ হলো খাদ্যগ্রহণ। আমরা যদি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের কথা শুনি, তাহলে সে জানাচ্ছে হাতের পাঁচ অঙুল প্রকৃতির পাঁচ উপাদানের সাথে যুক্ত। বৃদ্ধাঙুলির সাথে যুক্ত দিকের উপাদান, তর্জনীর সাথে যুক্ত হাওয়ার উপাদান, মধ্যমার সাথে যুক্ত আগুনের উপাদান, অনামিকার সাথে যুক্ত পানির উপাদান, আর কণিষ্ঠা মাটির সাথে সম্পর্কিত। এ বক্তব্য কোনো বৈজ্ঞানিক মতামত না হলেও বহু প্রজন্মের মানুষের অভিজ্ঞতাজাত দাবি হলো পাঁচ আঙুল যখন খাবারের সাথে যুক্ত হয়, তখন খাবারে নিহিত প্রকৃতির এসব উপাদান উজ্জীবিত হয়। মানবদেহে আপন উপাদান সমূহকে বিস্তার করে খাবারের সাথে।

কথাটি হয়তো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। কিন্তু এটা প্রমাণিত যে, হাত দিয়ে খাবার খেলে আমাদের অজান্তেই দেহের একাধিক পেশি সঞ্চালিত হতে থাকে। ফলে হাতের পাশাপাশি সারা শরীরে ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়তা অধিকমাত্রায় বাড়ে। খাবার মাখতে হয় আঙুল দিয়ে। যা রক্ত সরবরাহকে উদ্দীপিত করে। ফলে হাতে তো বটেই, সারা শরীরে রক্তের চলাচল বেড়ে যায়। আমাদের বিভিন্ন অঙ্গে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্তও পৌঁছে যায়। গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে জীবনীশক্তির প্রবাহ!

অনেকেই হয়তো বলবেন হাতে অনেক ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাদের ক্ষতি থেকে বাঁচতে চামচ দিয়ে খাওয়াই উচিত। কিন্তু সভ্য মানুষ মাত্রই পরিচ্ছন্নভাবে খাবে, খাবার আগে অবশ্যই হাত ধুবে। ইসলাম খাবারের আগে উত্তমভাবে হাত পরিষ্কারের নিয়ম শিখিয়েছে। খাবারের সাথে পবিত্রতাকে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত করেছে। নিজে যেমন পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, তেমনি খেতে হবে হালাল, পবিত্র খাবার। মহান আল্লাহ বলেন-

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُلُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا رَزَقۡنَٰكُمۡ

অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে আমরা যেসব পবিত্র বস্তু দিয়েছি তা থেকে খাও।

নিশ্চয় পবিত্র মানে হালাল ও উত্তম জিনিস। ময়লা, অপরিচ্ছন্ন জিনিস নয়। এগুলো যেমন খেতে নেই, তেমনি অপরিচ্ছন্ন , নোংরা হাত দিয়েও খেতে নেই। খাবার গ্রহণের আগে হাত ধোয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহানবী ﷺ। মুমিন জননী হযরত আয়েশা রাযি. জানান, প্রিয় নবী ﷺ পানাহারের ইচ্ছে করলে তাঁর দুই হাত মুবারক ধুয়ে নিতেন। এরপর কিছু খেতেন কিংবা পান করতেন। [বুখারী শরীফ, হাদীসক্রম : ২৮৮; মুসলিম শরীফ, হাদীসক্রম : ৩০৫; আবু দাউদ শরীফ, হাদীসক্রম : ২২২; নাসায়ী শরীফ, হাদীসক্রম : ২৬৭]

তার পরও সব ব্যাকটেরিয়া মরে যায় না। কিংবা সাফ হয় না। কিছু ব্যাকটেরিয়া থেকে যায়, থেকে যেতেই পারে। সেগুলোর মধ্যে বহু ব্যাকটেরিয়া আছে উপকারী। হাত দিয়ে খাবারের ফলে তারা খাদ্যে মিশে যায় এবং খাদ্য পরিপাকে দারুণভাবে সহায়তা করে। এসব ব্যাকটেরিয়া মুখ, গলা এবং ইন্টেস্টাইনকে সুরক্ষিত রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

কাটা চামচ দিয়ে খেলে যা আদৌ হবে না। হাত দিয়ে খাবার গ্রহণ করলে আঙুলের মাধ্যমেই মস্তিষ্কের বার্তা পাকস্থলীতে পৌঁছে যায়। যা খাদ্যের জন্য উদ্দীপক। এতে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন ক্ষরিত হয়। সক্রিয় হয় স্বাদকোরক। খাবার হয় অধিকতর সুস্বাদু ও আনন্দদায়ক। তৃপ্তিকর। হাত দিয়ে খাবার খেলে বদ হজম এবং গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর হয় সহজেই। কিন্তু চামচে খেলে জিহ্বায় ধাতব বস্তুর স্পর্শ লাগে। এতে স্বাদকোরক সক্রিয় হয় না এবং রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রক হরমোন ক্ষরণের মাত্রাও কমে যায়। হাত দিয়ে খাবারের তুলনায় চামচের খাবার খাদ্যগ্রহণের পরিমাণের দিক থেকে গড়পড়তায় কম হয়ে থাকে। যা একদিকে স্বাদ ও উপকারের বিচারে খাদ্যের মূল লক্ষ্যকে সহায়তা করে না, অপরদিকে মানসিক তৃপ্তি ও সুখপ্রদ অস্বাদকে নিশ্চিত করে না। কাটা-চামচের বদলে হাত দিয়ে খাবার খেলে প্রতিটি দানার সঙ্গে মনের একটা সংযোগ তৈরি হয়। মনে স্নায়ুবিক সংযোগ বৃদ্ধি পায়। এতে মনোযোগ বাড়ে। হাতের একাধিক নার্ভ সচল হলে সরাসরি প্রভাব পড়ে ব্রেনের ওপর। আরেক গুরুতর দিক হলো চামচের খাবার টাইপ-২ ডায়াবেটিসের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। চামচ দিয়ে যেহেতু দ্রুত ও কম চিবিয়ে খাওয়া হয়ে যায়, ফলে রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে যায়। যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে আমন্ত্রণ করে। অতএব আমেরিকান হেলথ সাইন্সের বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নেন, চামচ দিয়ে খাওয়ার চেয়ে হাতের অঙ্গুলি দিয়ে মেখে খাওয়া স্বাস্থ্যকর।

প্রিয় নবী ﷺ হাত দিয়ে নিজে খেতেন এবং অন্যদেরও শেখাতেন। উমর ইবনে আবু সালামা রাযি. বলেন, আমি বালকবেলায় নবীজির কোলে (বসা ছিলাম)। আমার হাত (খাবারের সময়) পাত্রের এখানে সেখানে ছোটাছুটি করছিল। তিনি আমাকে বললেন-

يَا غُلاَمُ سَمِّ اللَّهَ وَكُلْ بِيَمِينِكَ وَكُلْ مِمَّا يَلِيكَ

অর্থ : ওহে বৎস! আল্লাহর নাম নাও, তোমার ডান হাত দিয়ে খাও এবং নিজের সামন থেকে খাও। [বুখারী শরীফ, হাদীসক্রম : ৫৩৭৬; মুসলিম শরীফ, হাদীসক্রম : ৫৩৮৮৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীসক্রম : ১৬৩৭৫]

উমর ইবনে আবু সালামা বলেন-

فَمَا زَالَتْ تِلْكَ طِعْمَتِي بَعْدُ

অর্থ : এরপর থেকে আমি সব সময় এ নিয়মেই খাদ্য গ্রহণ করতাম। [বুখারী শরীফ, হাদীসক্রম : ৫৩৭৭, ৫৩৭৮]

শুকনো খাবারে তিন আঙুলির ব্যবহারই যথেষ্ট। প্রিয় নবী ﷺ প্রায়ই তিন আঙুলের ব্যবহার করতেন খাবারে। হাত ধুয়ে ফেলার আগে চেটে খেতেন আঙুলসমূহ। কাব ইবনে মালিক রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ তিন আঙুলে আহার করতেন এবং হাত মুছে ফেলার পূর্বে তা চেটে খেতেন। [সহীহ মুসলিম, হাদীসক্রম : ৫১২৫] হযরত জাবের রা. বর্ণনা করেন, নবীজি ﷺ (খাওয়ার শেষে) আঙুলসমূহ ও খাদ্যপাত্র চেটে খাওয়ার আদেশ দিয়েছেন আর বলেছেন, খাদ্যের কোন অংশটির মধ্যে বরকত রয়েছে, তোমরা নিশ্চয় তা জানো না! [মুসলিম শরীফ, হাদীসক্রম : ১৩৩; মুসনাদে আহমদ, হাদীসক্রম : ১৫২২৪; আত্ তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদীসক্রম : ২১৫৯; মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদীসক্রম : ২৪৪৫৫; আল মুজামুল কাবীর লিত তবারানী, হাদীসক্রম : ১১২৩২]

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT