মহানবীর খাদ্যব্যবস্থাপনা ও ফুড সাইন্স [তৃতীয় কিস্তি]

না খেয়ে মরেছে, এমন মানুষ কম দেখেছি। কিন্তু বেশি খেয়ে মরেছে, এমন মানুষ দেখেছি অনেক। কথাটা কোনো কুহক নয়। এক বাস্তবতা। খাওয়ার জন্য যারা বাঁচে, খাবারের নেশা তাদেরকে শেষ অবধি বাঁচতে দেয় না। মানুষ বাঁচার প্রয়োজনে খাবে, সুস্থতার লক্ষ্যে খাবে, নতুবা মাত্রাহীন খাওয়া ক্ষুধার চেয়েও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি গুগল একটি জরিপ চালিয়েছে অতিরিক্ত আহার নিয়ে। জরিপের তত্ত্বাবধানে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানী এবং ‘নেভার বিঞ্জ এগেইন’ বইয়ের লেখক গ্লেন লিভিংস্টোন। জরিপে দেখা যায়- স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অস্বাভাবিক সময়ে মানুষের খাবার গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে গেছে। কিন্তু খাবারের অতিরিক্ততা বা পেট ভরে খাওয়া কি মানবস্বাস্থ্যের কোনো সহায়তা করছে?

লিভিংস্টোনের জবাব হচ্ছে- না। তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস মানুষের মানসিক শক্তিকেও দুর্বল করে ফেলে। সেসময় খাওয়ার ইচ্ছাগুলো হয়ে ওঠে অদম্য। মানুষ তার জিহ্বার দাসে পরিণত হয়। এভাবে একসময় তারা পুরোপুরি আসক্ত হয়ে যায়। তাই বেশি খাওয়ার এই অভ্যাস পরিবর্তন করার জন্য অপেক্ষা করা হবে মস্ত বড় ভুল।’

লিভিংস্টোন যে ভুল থেকে সতর্ক হতে বলছেন আধুনিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে, সেই ভুলের সুন্দরতম প্রতিকার রয়েছে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহে। আল্লাহর রাসূল যখন খানা খেতেন, পেট ভরে খেতেন না। পেটের একটি অংশ খালি রাখতেন। এর পরিমাণ বা মাত্রা হলো, যে পরিমাণ খেলে ঢেঁকুর ওঠে, সে পরিমাণ না খাওয়া। নবীজি এক ধরনের ক্ষুধা থাকা অবস্থাতেই আহার গ্রহণ সমাপ্ত করতেন।

আমরা যে খাবার গ্রহণ করি এর দশ ভাগ আমাদের শরীরের অংশে পরিণত হয়। আর বাকি নব্বই ভাগ আমরা ভেঙে বের করে দিই। এর মানে হলো- খুব বেশি মাত্রায় আহার করা হলেও শরীর কেবল গ্রহণ করছে দশ ভাগ। বাকি অংশ ভেঙে বের করে দিচ্ছে। নবীয়ে কারীম সা. তাই খাবারের যথোচিত মাত্রা আমাদের জানাচ্ছেন। হযরত মিকদাম ইবনে মাদিকারিব রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীয়ে কারীম সা. বলেন- ‘মানুষ পেটের চেয়ে অধিক নিকৃষ্ট কোনো পাত্র পূর্ণ করে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে এমন কয়েক গ্রাস খাবারই আদমসন্তানের জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলে পাকস্থলির এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।’ [তিরমিযী, হাদীসক্রম : ২৩৮০; নাসায়ী, হাদীসক্রম : ৬৭৬৯; ইবনে মাজা; হাদীসক্রম : ৩৩৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীসক্রম : ১৭১৮৬]

মুসলমান খাদ্য ও পানীয়কে অন্যান্য উপকরণের মতোই মনে করে এবং এটাকে জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য মনে করে না। সুতরাং মুসলমান শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্যে পরিমিত খাবার খাবে ও পান করবে, যার দ্বারা সে স্বাস্থ্য ও সুস্থতার আনুকূল্য লাভ করবে। বুরহান উদ্দীন হালাবি আসসিরাতুল হালাবিয়ায় (৩/২৯৫) সূত্রবিহীন একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাটি হলো মিসরের রাজা মুকাওকিস উপহার হিসেবে ডাক্তার পাঠালেন নবীজির সমীপে। তখন নবীয়ে কারীম সা. বললেন-

نحن قومٌ لا نأكُلُ حتى نَجُوعَ ، وإذا أكلنَا فلا نَشْبَعَ

অর্থ : আমরা তো এমন জাতি- ক্ষুধা না পেলে খাই না; আর যখন খাই, পেটপুরে খাই না। [আবু বকর আল জাযায়েরী- মিনহাজুল মুসলিম, ১৬৪]

হাদীস হিসেবে এটি যদিও নিতান্তই দুর্বল, কিন্তু এর মর্ম সঠিক ও নানা ভাষ্যে সমর্থিত। বস্তুত মুসলিমরা কেবল খাদ্য ও পানীয়ের মজা উপভোগ করার জন্য পানাহার করবে না। একান্ত ক্ষুধার্ত না হলে আহার থেকে সে বিরত থাকবে। তেমনি স্বাস্থ্যগত প্রয়োজন, নির্দেশনা কিংবা পিপাসা না থাকলে শুধু শুধু পান করার কী দরকার?

খাদ্য কখনো সুরক্ষা, কখনও স্বাদ, কখনও অভ্যাস। আবার কখনো হতে পারে অতিরিক্ত চাপ। এটা কেবল তখনই হয়, যখন আপনি অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেছেন। পেট ভরে খাওয়ার আগে শরীর আপনাকে সতর্কবার্তা দেয়। এ বার্তা আসে লেপ্টিক হরমোনের মাধ্যমে। সে আমাদের মস্তিষ্ককে জানায় আমাদের পেট ভর্তি আছে না খালি আছে। এমনকি কখন খাবার খাওয়া থামিয়ে দেওয়া উচিত, তারও বার্তা দেয় এই হরমোন। আমরা যখন পছন্দের কোনো খাবার কব্জি ডুবিয়ে খাই, তখন এই সব অনুভূতিকে গ্রাহ্য করা আর হয়ে ওঠে না। তখন মস্তিষ্ক পেটে একটি সংকেত পাঠায়। যখন কেউ এই সঙ্কেতকেও উপলব্ধি করে না, পাত্তা দেয় না, তখন নিজের শরীরের সাথে মূলত সে শত্রুতা করছে। অবাঞ্ছিত এ খাবার শরীরকে পীড়া দেয়। মনে হয় যদি কোনওক্রমে বমি করে শরীর হালকা করা যেত। অনেক সময় বেশি খাবারের ফলে জামাকাপড়ও আঁটসাঁট মনে হয়।

অতিরিক্ত খাওয়াকে অভ্যাসে পরিণত করলে তা শরীরে সমস্যাজনক ওজন বাড়াতে পারে। অতিরিক্ত ওজন বহন করা আপনার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

কিন্তু ব্যাপারটি শুধু অবাঞ্ছিত ক্যালোরি বা অহেতুক ওজনের নয়। বরং ব্যাপারটি আরো ব্যাপক। কারণ অতিরিক্ত খাওয়া শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে প্রভাবিত করে। যার অন্যতম হলো, অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে পাকস্থলি তার স্বাভাবিক আকারের বাইরে প্রসারিত হয়ে পড়ে। প্রসারিত পেট অন্যান্য অঙ্গের বিরুদ্ধে ধাক্কা দেয়। একসঙ্গে অনেক খাবার গ্রহণের ফলে পেট বেলুনের মতো ফুলে যায়। এর মানে হলো, যে পরিমাণ খাওয়া হয়েছে, সে পরিমাণ খাদ্য পেটে জায়গা দেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তখন অনেক জায়গাজুড়ে অতিরিক্ত খাবারকে জায়গা দিতে হয়। এতে শরীরের অন্যান্য প্রত্যঙ্গের ওপর প্রচুর পরিমাণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

যা সুস্থতার জন্য ডেকে আনে অস্বস্তি। এই অস্বস্তি ক্লান্তি ও আলস্য ডেকে আনে। যা আপনার স্বাভাবিকতা হরণ করবে। আপনার গতিকে কমিয়ে দেবে। অনেকেই মনে করেন বেশি খেলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শক্তিশালী হবে। এটা ভুল। বেশি খাবারের ফলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর চাপ বাড়ে। কারণ খাদ্যগ্রহণ করার সময় সেটি মুখ থেকে পেটে, পেট থেকে ক্ষুদ্রান্ত্র এবং ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে বৃহদন্ত্রে যায়। আর ঠিক তখনই পাকস্থলি এবং লিভার থেকে হজমের উপযোগী রস নিঃসরণ হতে থাকে। স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত খাবারের জন্য প্রয়োজন হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত রস। যা শরীরকে ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়। পেটের ভেতরে অতিরিক্ত খাবারকে ভাঙা ও হজমের জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হরমোন ও এনজাইম নিঃসরণ করতে গিয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর পড়ে অতিরিক্ত প্রেসার।শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের উপর প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি চাপের সৃষ্টি হলে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়।

খাদ্য ভাঙা ও প্রক্রিয়াজাত করার জন্য, পাকস্থলি হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তৈরি করে। আপনি যদি অতিরিক্ত খান তবে এই অ্যাসিড খাদ্যনালিতে ব্যাক আপ হতে পারে। যার ফলে পাকস্থলির গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থিতে অতিরিক্ত গ্যাস নিঃসরণ হয়। এতে পেটে গ্যাস-অম্বল হতে পারে। বুক ও পেটে জ্বালাপোড়া, দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস এবং পেটে ব্যথাসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। অধিক চর্বিযুক্ত খাবারের ফলে আপনার পেট অধিক মাত্রায় গ্যাস তৈরি করতে পারে, যা আপনাকে অস্বস্তিকর পূর্ণ অনুভূতি দিয়ে ফেলে। অতিরিক্ত খাবারের ফলে আপনার বিপাক ত্বরান্বিত হতে পারে। প্রচুর পরিমাণে ঢেঁকুরেরও সৃষ্টি, অস্বস্থিকর গন্ধসহ যা আপনাকে বিব্রত করবে। অতিরিক্ত পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করা হলে সেরোটোনিন এবং মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এই দুটি হরমোনের ক্ষরণ যত বাড়তে থাকে, তত বেশি অবসাদ এবং ঝিমুনি আসতে থাকে। এই কারণেই দেখবেন দুপুর বেলা একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেলেই চোখ বুজে আসে। মনে হয় ঘুমের ছোটে কাজ মাথায় উঠবে। অতিরিক্ত খাবারের ফলে অনুভব করতে পারেন গরম, ঘর্মাক্ত বা এমনকি মাথা ঘোরার অস্থায়ী অনুভূতিও।

অতিরিক্ত খাওয়া, বিশেষ করে অস্বাস্থ্যকর খাবার আপনার পরিপাকতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পাচক এনজাইমগুলি শুধুমাত্র সীমিত পরিমাণে পাওয়া যায়, তাই আপনি যত বেশি খাবার খান, তত বেশি সময় লাগে হজম হতে। আপনি যদি ঘন ঘন অতিরিক্ত খান, তাহলে ধীর হজম প্রক্রিয়া বাড়তে থাকবে। সময়ের সাথে সাথে, এই ধীর হজম প্রক্রিয়ার অর্থ হল আপনি যে খাবার খান তা দীর্ঘ সময়ের জন্য পেটে থাকবে এবং চর্বিতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।

অতিরিক্ত খাওয়া আপনার ঘুমকেও প্রভাবিত করতে পারে। আপনার ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করে যে সার্কাডিয়ান ঘড়ি, তার শৃঙ্খলা ব্যাহত হতে পারে। অত্যধিক খাওয়া এই শৃঙ্খলাকে বিপর্যস্ত করতে পারে। যার ফলে দেহ ও মনে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা তৈরি হয়। হাদীসে তাই মাত্রাতিরিক্ত খাদ্যের প্রতি হুঁশিয়ারি ঘোষিত হয়েছে।

হযরত ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘নবীজি সা. বলেছেন-

المُؤْمِنُ يَأْكُلُ في مِعًى واحِدٍ، والكَافِرُ يَأْكُلُ في سَبْعَةِ أمْعَاءٍ.

মুমিন আহার করে একটিমাত্র পাকস্থলি পূর্ণ করে। আর কাফের আহার করে সাত পাকস্থলি ভর্তি করে। [বুখারী শরীফ, হাদীসক্রম : ৫০৯৩; মুসলিম শরীফ, হাদীসক্রম : ২০৬০; তিরমিযী শরীফ, হাদীসক্রম : ১৮১৮; তাবারানী শরীফ : ২/২২৩]

বস্তুত মহানবী সা.-এর খাদ্যব্যবস্থা শুধু আমাদের খাদ্যবিধান ও উত্তম খাবারের দিশাই দিচ্ছে না, একই সাথে নিশ্চিত করছে খাদ্যের পরিমাণের উত্তম মাত্রা ও ধরন।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT