عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ: تَكُوْنُ فِتْنَةٌ اَلنَّائِمُ فِيْهَا خَيْرٌ مِنَ الْيَقْظَانِ وَالْيَقْظَانُ فِيْهَا خَيْرٌ مِنَ الْقَائِمِ وَالْقَائِمُ فِيْهَا خَيْرٌ مِنَ السَّاعِيْ فَمَنْ وَجَدَ مَلْجَأً أَوْ مَعَاذًا فَلْيَسْتَعِذْ
অনুবাদ :
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সা. বলেছেন, ‘অচিরেই ফিতনা দেখা দেবে। তখন ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত ব্যক্তি থেকে ভালো থাকবে। আর জাগ্রত ব্যক্তি তখন দাঁড়ানো ব্যক্তি থেকে ভালো থাকবে। এবং দাঁড়ানো ব্যক্তি দ্রুতগামী ব্যক্তি থেকে ভালো থাকবে। তখন যদি কোনো ব্যক্তি আশ্রয়স্থল অথবা রক্ষাস্থান পায় তবে সে যেন আশ্রয় গ্রহণ করে। (সহীহ মুসলিম : ৬৯৮৫)
ব্যাখ্যা :
ফিতনা মানবেতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষত আমরা এখন যে সময়ে বাস করছি তাতে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ফিতনা প্রায়শই চরম আকার ধারণ করে। দেশে বলুন, দেশের বাইরে বলুন সর্বত্র মানুষের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য, যা হঠাৎ করেই রূপ নেয় ঝগড়ায়, ঘৃণায়, খুনাখুনিতে। ফিতনা যখন চরম আকার ধারণ করে তখন ভালো-মন্দের পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে, আর এই সময়ে অনেকেই কনফিউজড হয়ে পড়ে যে, আমার কী করণীয়? ফিতনার সময় একজন প্রকৃত মুসলিমের দায়িত্ব কী, এই সমন্ধে কুরআন আর হাদীস কী বলে, এখানে আমরা সে সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
ফিতনা কাকে বলে?
ফিতনা শব্দের অর্থ হলো, ‘পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে পরীক্ষা করা। এই পরীক্ষা আমাদের প্রিয় কোনো কিছু (যেমন : অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা, পুরুষের জন্য নারী অথবা নারীর জন্য পুরুষ) দিয়ে হতে পারে, আবার হতে পারে আমাদের অপছন্দনীয় কিছু দিয়ে (যেমন : অকস্মাৎ বিপদ, গৃহযুদ্ধ, বিশৃংখলা, অত্যাচারী শাসক ইত্যাদি)।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ফিতনার মাধ্যমে তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে অকৃতজ্ঞ মানুষ থেকে পৃথক করেন। সাধারণ মানুষের ধারণা- ফিতনা মানেই বুঝি খারাপ কিছু। ধারণাটা ঠিক নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফে সন্তান ও সম্পদকে ফিতনা বলেছেন, অথচ আমরা এগুলোকে ভালো কিছু বলেই জানি। কাজেই, কোনো কিছু ফিতনা কি না তা নির্ধারণ করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। চলমান কোনো ঘটনা ফিতনা কি না তা ভালো বলতে পারবেন ওই সময়ের ও ওই এলাকার বিজ্ঞ আলেমরা। কিন্তু, যে কোনো ফিতনারই দুটি কমন বৈশিষ্ট্য থাকে। এগুলো হলো-
(১) ফিতনা প্রচণ্ড আকর্ষণের সৃষ্টি করে। যে কোনো ফিতনাই মানুষকে চুম্বকের মতো টানে। যে লোক কোনোদিন খবরের কাগজ পড়ে না, ফিতনার সময় সেও সবাইকে জিজ্ঞেস করে- ‘আচ্ছা এর পর কী হয়েছিল?’ বর্তমান যুগে ফিতনা চেনার একটা সহজ উপায় হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক। যখন যে ফিতনা শুরু হয়, ফেসবুকের হোম পেজ আর প্রোফাইল পিকচার ভরে যায় ওই ফিতনায়।
(২) ফিতনা মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কিছু কিছু ফিতনা আছে যেগুলোর উপস্থিতিতে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে মানুষের পক্ষে আল্লাহর ইবাদত করা কঠিন হয়ে পড়ে (যেমন : যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ)। অন্যদিকে কিছু কিছু ফিতনা আছে (যেমন : বিশ্বকাপ খেলা) যেগুলোতে মানুষ এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে যায় যে, সে ভুলে যায় তার উপর তার প্রতিপালকের দেওয়া দায়িত্ব। নামাযী ব্যক্তি ফিতনার আকর্ষণে সময় মতো নামায পড়তে পারে না, মা-বাবা ও পরিবারের উপর দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফিতনার আপডেট জানার জন্য। ফিতনার সময় গিবত বেড়ে যায়, বেড়ে যায় মিথ্যার চর্চা, চোগলখুরি আর কাঁদা ছোড়াছুড়ি।
ফিতনার মুকাবিলায় করণীয় কাজগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে- আত্মিক ও পার্থিব। আত্মিক কাজগুলো পার্থিব কাজগুলোর ভিত্তি, যদিও দুই ভাগের কাজগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। আত্মিক যে কাজগুলো করতে হবে তা হলো-
১. বিপদগ্রস্ত মানুষের জন্য কষ্ট অনুভব করা : ফিতনা তার সাথে নিয়ে আসে বিপদ আর কষ্ট। সর্বনিম্ন আমরা যা করতে পারি তা হলো ফিতনায় পড়া মানুষের জন্য কষ্ট অনুভব করা। ফিতনায় পতিত মানুষগুলো যদি মুসলিম হয়, তাহলে তাদের জন্য কষ্ট অনুভব করা আমাদের ঈমানের অংশ। যখন বাংলাদেশ, ফিলিস্তিন, গুয়ানতানামো, সিরিয়া, মিশর, ইরাক, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান বা বার্মায় মুসলিমরা ফিতনায় পড়ে, তখন যদি আমরা বিন্দুমাত্র কষ্ট অনুভব না করে নিজের স্বাভাবিক জীবনকার্য চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে বুঝে নিতে হবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে- আমরা কি আসলেই মুসলিম?
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-‘সকল ঈমানদার তো পরস্পর ভাই ভাই।’ (সূরা হুজুরাত, আয়াতক্রম : ১০)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যদি ঈমানদার না হও, তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যদি একজন আরেকজনকে ভালো না বাসো।’ (মুসলিম শরীফ, হাদীসক্রম : ৯৮)
প্রিয় নবী সা. আরও ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই ভালোবাসে যা সে নিজের জন্য ভালোবাসে।’ (বুখারী শরীফ, হাদীসক্রম : ১৩)
২ . দুআ করা : বর্তমান সময়ে দুআ করাকে আমরা খুব তুচ্ছ একটা ব্যাপারে মনে করি। আমরা মনে করি, দুআ করে কী হবে? আসলে এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ঈমানী দৈন্যতাই প্রকাশ করি। আমরা যে আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতায় বিশ্বাস করি না তা-ই প্রমাণ করি। অথচ, দুআ হচ্ছে মুমিনের অস্ত্র। একজন মুসলিম বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ সর্বসময় শুধু তাঁর কাছেই আছে। তাই একজন মুসলিম বড় বড় ব্যাপার থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারেও আল্লাহর কাছে দুআ করে, একগ্লাস পানি খাওয়ার জন্য হাতটা যেমনি আগে বাড়ায়, তেমনি বিসমিল্লাহ বলে আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতাকেও স্বীকার করে। সে ফিতনার আগে দুআ করে, ফিতনার সময় দুআ করে, ফিতনার পরেও দুআ করে।
আমরা দুআ করব ফিতনায় না পড়ার জন্য, আর দুআ করব ফিতনার সময় যাতে মনোযোগ না হারিয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদাত করতে পারি। আমরা দুআ করবো অত্যাচারীতের জন্য যেন সে অত্যাচার থেকে মুক্তি পায়, এমনকি দুআ করবো অত্যাচারীর জন্য যাতে সে অত্যাচারের পথ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘তোমাদের রব বলেন : আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সূরা মুমিন, আয়াতক্রম : ৬০)
আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন- ‘আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং আমি জানি তার মন তাকে কী কুমন্ত্রণা দেয়। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনীর চেয়েও নিকটতর।’ (সূরা ক্বাফ, আয়াতক্রম : ১৬)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে প্রকাশ্য ও গোপন ফিতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করো।’ (মুসলিম শরীফ, হাদীসক্রম : ২৮৬৭)
৩. ইসলামের উপর অবিচল থাকা : ফিতনার সময় শয়তান এসে মানুষকে বলে- ‘দেখো, আজ ইসলাম ধর্মের কারণেই পৃথিবীতে এত সমস্যা। ধর্মের কারণেই এত বিভেদ, মানুষে মানুষে এত মারামারি। আর আল্লাহ যদি সত্যিই থেকে থাকেন তাহলে এখন তিনি মুসলমানদেরকে সাহায্য করছেন না কেন?’ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাহায্য আসবেই। কিন্তু তার আগে আল্লাহ ফিতনার মাধ্যমে মানুষের ঈমান পরীক্ষা করবেন, যেভাবে তিনি অত্যাচারী ফেরাউনের মাধ্যমে বনী ইসরাইলের ঈমান পরীক্ষা করেছিলেন, অত্যাচারী কুরাইশবাসীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সা. আর সাহাবিদের ঈমান পরীক্ষা করেছিলেন।
ফিতনার সময় যারা মুমিন তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে যায় না; বরং পরীক্ষা যত কঠিন হতে থাকে ইসলামের রজ্জুকে সে তত শক্ত করে অঁাকড়ে ধরে, অন্যদিকে মুনাফিকরা এই সময় মুসলিমদের থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে কাফিরদের সাথে হাত মেলায়।
ফিতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিচের এই দুআটি রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের শিখিয়ে গেছেন-
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلَى دِيْنِكَ
অর্থ : ‘হে হৃদয় পরিবর্তনকারী! আমাদের হৃদয়কে আপনার দ্বীনের উপর সুদৃঢ় করে দিন।’ (মুসনাদে আহমদ)
৪. ইবাদাত বৃদ্ধি করা : ফিতনার সময় মানুষের মন বিক্ষিপ্ত থাকে, টেনশন করে, এটা-সেটা চিন্তা করে সময় পার করে দেয়। মনের এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার ঔষধ হলো আল্লাহর ইবাদত বৃদ্ধি করা, ধীরে ধীরে সময় নিয়ে নামায পড়া, নফল রোযা রাখা, বুঝে বুঝে কুরআন পড়া, হক্কানী উলামায়ে কেরামের ওয়ায-নসীহত শোনা, কুরআনের অর্থ নিয়ে চিন্তা করা।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘ফিতনার সময় ইবাদত করা, হিজরত করে আমার কাছে আসার সমতুল্য।’ (মুসলিম শরীফ)
সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল সাহাবীরা হলেন যাঁরা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে হিজরত করেছিলেন। আপনার মনে আফসোস আপনি কেন সাহাবী হয়ে জন্মালেন না? সাহাবীগণের সমান নেকী অর্জনের সুযোগ আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন; ফিতনার সময় ধৈর্য ধরে আল্লাহর ইবাদত করুন, ইবাদত বৃদ্ধি করুন।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘তোমরা অন্ধকার রাতের টুকরোগুলোর মতো (যা ক্রমশই গভীর হতে থাকে) ফিতনা আসার পূর্বে নেকীর কাজ দ্রুত করে ফেলো। সেই সময়ে মানুষ সকালে মুমিন হয়ে ঘুম থেকে উঠবে এবং রাত শুরু করবে কাফির হয়ে, অথবা সে রাত শুরু করবে মুমিন হয়ে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠবে কাফির হয়ে। তখন সে নিজের দ্বীনকে দুনিয়ার সম্পদের বিনিময়ে বিক্রয় করবে।’ (মুসলিম শরীফ, তিরমিযী শরীফ, মুসনাদে আহমদ)
৫. ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করা : মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা যত কম থাকবে তত সহজেই তারা ইসলামের শত্রু এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদানকারী ইসলামিস্ট- এই দুই গ্রুপের লোকদের দ্বারা সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। ফলে, ইসলামী শিক্ষায় স্বল্পশিক্ষিত মুসলমানেরা তখন হয় ইসলামের শত্রুদের পক্ষ নেবে, অথবা বিভ্রান্তিকর ইসলামিস্টদের কথায় আবেগতাড়িত হয়ে এমন কিছু করে বসবে যার ফলে সমাজে ফিতনা তো কমবেই না; বরং অস্থিতিশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন : ‘কিয়ামত যখন কাছে চলে আসবে তখন এমন দিন আসবে যখন (দ্বীনি) জ্ঞান হারিয়ে যাবে, মূর্খতার আবির্ভাব ঘটবে, এবং প্রচুর পরিমাণে মানুষ হত্যা করা হবে।’ (ইবনু মাজাহ শরীফ, বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)
লক্ষ করুন, রাসূলুল্লাহ সা. মানুষ হত্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে জ্ঞানের অভাবকে কীভাবে যুক্ত করেছেন। মানুষ যত বেশি জ্ঞানবিমুখ হবে, ইসলাম ও দুনিয়া সম্বন্ধে যত কম জানবে, তত সহজেই সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তাদের ব্রেইনওয়াশ করে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারবে। কাজেই, ফিতনা থেকে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের মনোযোগী হতে হবে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের প্রতি, আলিমদের লেকচার শুনতে হবে, তাঁদের সান্নিধ্যে যেতে হবে, প্রচুর বই পড়তে হবে, সাধনা করতে হবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। আমাদের দেশে যখনই ইসলাম বিষয়ক কিছু নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধে তখনই দেখা যায় কিছু লোক একটা কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে বিভিন্ন আয়াতের নিজের ইচ্ছামতো ব্যাখা দেওয়া শুরু করে, এদের ইসলাম বিষয়ক কথাবার্তা থেকে ১০০ হাত দূরে থাকতে হবে। এ-জাতীয় লোকেরা নিজেরাও বিপথে চলে, আর মানুষকেও বিপথে পরিচালিত করে।