নিয়ত : কুরআনের নির্দেশনা [সহীহ বুখারী, হাদীস-ক্রম : ০১]

 

حَدَّثَنَا الْحُمَيْدِيُّ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ الزُّبَيْرِ، قَالَ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، قَالَ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ الأَنْصَارِيُّ، قَالَ أَخْبَرَنِي مُحَمَّدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ التَّيْمِيُّ، أَنَّهُ سَمِعَ عَلْقَمَةَ بْنَ وَقَّاصٍ اللَّيْثِيَّ، يَقُولُ سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ ـ رضى الله عنه ـ عَلَى الْمِنْبَرِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ “‏ إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ ‏”‏‏.‏

১. আল্লাহ তাআলা বলেন, فَاعْبُد اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ অর্থ : “তুমি আল্লাহর ইবাদত করো তারই জন্যে, আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে।” (সূরা যুমার আয়াতক্রম : ০২) অন্যত্র আরো বলেন, “নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্য আল্লাহরই জন্য।”

উক্ত আয়াতদ্বয়ে ‘দ্বীন’ শব্দটি আনুগত্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে নির্দেশ দেয়া  হয়েছে- ‘আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যকে তারই জন্য খাঁটি করুন। যাতে শিরক, রিয়া ও যশ-খ্যাতির নাম-গন্ধও না থাকে। এরই তগিদার্থে  দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, খাঁটি ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই শোভনীয়। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এর যোগ্য নয়। হযরত আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর নিকট এসে বললেন, ‘আমি মাঝে মাঝে দান খয়রাত করি অথবা কারো প্রতি অনুগ্রহ করি এতে আমার নিয়তে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিও থাকে এবং এটাও থাকে যে, মানুষ আমার প্রশংসা করুক।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে সত্তার শপথ যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ। আল্লাহ তাআলা এমন কোন বস্তু কবুল করেন না যাতে অন্যকে শরীক করা হয়।’ অতঃপর তিনি প্রমাণস্বরূপ  أَلا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।’ বস্তুত নিয়তের একনিষ্ঠতা অনুপাতে আল্লাহর নিকট আমল গৃহীত হয়। কুরআনে কারীমের অনেক আয়াত সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহর কাছে আমলের হিসাব গণনা দ্বারা নয়, ওযন দ্বারা  হয়ে থাকে। আর আমলের মূল্যায়ন ও ওযন নিষ্ঠাপূর্ণ ওযন অনুপাতে হয়ে থাকে এবং পূর্ণ খাঁটি নিয়ত এই যে, আল্লাহ ব্যতীত কাউকে লাভ- লোকসানের মালিক গণ্য করা যাবে না। নিজের কাজকর্মে কাউকে ক্ষমতাশীল মনে করা যাবে না এবং কোন ইবাদত ও আনুগত্যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কল্পনা ও ধ্যান করা যাবে না। যে সাহাবায়ে কেরাম মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রথম সারিতে অবস্থিত, তাদের আমলের পরিমাণ তেমন একটা  বেশি দেখা যাবে না। কিন্তু এতদসত্বেও তাদের সামান্য আমল অবশিষ্ট উম্মতের বড় বড় আমলের চেয়ে উচ্চতর ও শ্রেষ্ঠ। এটা হয়েছে তাদের পূর্ণ ঈমান ও পূর্ণ নিয়তের কারণেই।

ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শেষ বাবের শিরোনাম করেছেন-  باب قول الله تعالى ونضع الموازين القسط الخ  আল্লাহ তাআলার বাণী- ‘আমি ইনসাফের পাল্লা স্থাপন করব’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ আলেমের মত হল, কেয়ামতের দিন মানুষের আমলকে ওযন করা হবে, গণনা নয়। আর এ ক্ষেত্রে মানুষের একই আমলের মধ্যে ওযনের কম-বেশি হবে তাদের নিয়তের কারণে এবং আমলের মধ্যে ইখলাসের কম-বেশি হওয়ার কারণে। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- رب عمل صغيرتعظمه النية ورب عمل كبير تصغره النية অর্থাৎ নিয়ত অনেক ক্ষুদ্র আমলকে মহৎ আমলে রূপান্তরিত করে। আবার অনেক বৃহৎ আমলকেও নিয়ত ক্ষুদ্র করে দেয়। নিয়তের গুরুত্ব আমলের চেয়েও বেশি। মানুষের নিয়ত তার আমলের চেয়ে অধিক কার্যকরী। যেমন- এক ব্যক্তি ৬০/৭০ বছর ঈমান অবস্থায় জীবিত ছিল এবং ইবাদত করলো কিন্তু তার এ নিয়ত ছিল যে, সে যদি সবসময় জীবিত থাকতো তাহলে ঈমান অবস্থায় থাকতো এবং ইবাদত করতে থাকতো এজন্যই সে মৃত্যুর পর অনন্তকাল জান্নাতে থাকবে। পক্ষান্তরে বেঈমানরা ৬০/৭০ বছর জীবিত থাকলেও তাদের নিয়তে এটা থাকে যে, তারা যতদিন জীবিত থাকবে বেঈমান অবস্থাতেই থাকবে। তাই তারাও এরূপ বদ নিয়তের কারণে সব সময় জাহান্নামে থাকবে।

২.আল্লাহ তাআলা বলেন, مَن كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ ٱلْءَاخِرَةِ نَزِدْ لَهُۥ فِى حَرْثِهِۦ ۖ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ ٱلدُّنْيَا نُؤْتِهِۦ مِنْهَا وَمَا لَهُۥ فِى ٱلْءَاخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ অর্থ : “যে পরকালের ফসল প্রত্যাশা করে আমরা তার জন্য সে ফসল আরো বাড়িয়ে দেই। আর যে ইহকালের ফসল কামনা করে আমরা তাকে এর কিছু দিয়ে দেই। কিন্তু পরকালে তার জন্য কিছু থাকবে না।” (সূরা আশ শূরা, আয়াতক্রম : ২০)

৩. فَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ অর্থ : “কিছু লোক তো এমন আছে, যারা (দুআয় কেবল) বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়ার কল্যাণ দান করুন আর আখিরাতে তাদের কোন অংশ নেই।” (সূরা বাকারা, আয়াতক্রম : ২০০)

৪. لن ينال الله لحومها ولا دماؤها ولكن يناله التقوى منكم অর্থ : “আল্লাহ তাআলার কাছে কখনও এগুলোর (কুরবানীর) গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ, আয়াতক্রম : ৩৭)

কুরবানীর ক্ষেত্রে কুরবানীর জন্তুর গোশত ও রক্ত নয়; বরং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে আল্লাহর আদেশ পালন করাই কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতি শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেন যে, ‘কুরবানী একটি মহান ইবাদত। কিন্তু আল্লাহর কাছে এর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না এবং কুরবানীর উদ্দেশ্যও এগুলো নয়; বরং আসল উদ্দেশ্য জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা এবং পূর্ণ আন্তরিকতাসহ রবের আদেশ পালন করা। অন্যান্য সব ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যও তাই। নামায, উঠা-বসা এবং রোযায় ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকা আসল উদ্দেশ্য নয়; বরং আল্লাহর আদেশ পালন করাই আসল লক্ষ্য। আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বর্জিত ইবাদত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র।

নিয়ত করার পদ্ধতি

নিয়ত মূলত অন্তরের সংকল্প ও ইচ্ছার নাম। তাই নিয়ত হবে অন্তর থেকে। যেমন- রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় নিয়ত করে রাখলাম, ভোরে ফজরের নামায আদায় করব অথবা ঘুম থেকে উঠে নিয়ত করলাম এখন ফজরের নামায আদায় করব এবং নামায আদায় করে নিলাম। অন্তরের এই সংকল্পই হচ্ছে নিয়ত। আরবি কিংবা বাংলা শব্দে তা মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। তবে যদি নামায, রোযা ইত্যাদি ইবাদতের পূর্বে নিয়ত করতে চায়, তাবে নাজায়েয বা বিদআত বলার সুযোগ নেই।

قوله ( واماالذكر باللسان فلا معتبر فيه) اى في حق الجواز لكنه حسن لاجتماع عزيمته

(العناية  এর হাওয়ালায় ‘ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত’, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ২৪)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নিয়ত বিশুদ্ধ করে ইবাদাতের উত্তম প্রতিদান অর্জন করার তাওফকক দান করুন। আমীন।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT