নিয়তের শরঈ বিধান [সহীহ বুখারী, হাদীস-ক্রম : ০১]

 

حَدَّثَنَا الْحُمَيْدِيُّ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ الزُّبَيْرِ، قَالَ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، قَالَ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ الأَنْصَارِيُّ، قَالَ أَخْبَرَنِي مُحَمَّدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ التَّيْمِيُّ، أَنَّهُ سَمِعَ عَلْقَمَةَ بْنَ وَقَّاصٍ اللَّيْثِيَّ، يَقُولُ سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ ـ رضى الله عنه ـ عَلَى الْمِنْبَرِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ “‏ إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ ‏”‏‏.‏

উল্লেখিত (إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ) হাদীসাংশে বলা হয়েছে, ‘মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে।’ মুহাদ্দিসীনে কেরামের মতে এ কথাটির দুটি অর্থ হতে পারে। যথা-

১. নিয়ত যে মানের হবে সাওয়াবও সে হিসেবে পাবে। অর্থাৎ নিয়তে ইখলাস কম হলে সাওয়াব কম পাবে। ইখলাস বেশি হলে সাওয়াবও বেশি পাবে।

২. একটি আমলে যদি একাধিক নিয়ত হয় তাহলে সাওয়াবও একাধিক পাবে। যেমন- এক ব্যক্তি মসজিদে গেল কেবল নামাযের নিয়তে। আরেকজন গেল নামাযের পাশাপাশি মসজিদে যাওয়ার পথে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ এবং ইতিকাফ করারও নিয়ত করল। এখানে প্রথম ব্যক্তি শুধু নামাযের সাওয়াব পাবে। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি নামাযের সাওয়াবের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরও তিনটি সাওয়াব পাবে।

একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর

উপরের ব্যাখ্যার আলোকে বোঝা গেল- যেমন নিয়ত করবে, তেমনই সাওয়াব পাবে। অথচ শরীয়তের বিধান হলো যদি কোন ব্যক্তি রমযান মাসে নফল রোযার নিয়ত করে তবুও তাঁর ফরযই আদায় হবে। নফলের নিয়ত বিবেচ্য হবে না। সুতরাং এখানে তো مَا نَوَى (মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে) বাস্তবায়িত হলো না।

এর উত্তর হলো- রমযানে নফল রোযার কোন স্থান নেই। তাই এ মাসে কেউ নফলের নিয়ত করলে তা নিরর্থক হয়ে যাবে। আবার এমনও উত্তর দেওয়া যেতে পারে, ফরযের মধ্যে নফল অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ ফরয ইবাদতটি যেন একটি অতিরিক্ত নফল ইবাদতসহ আদায় হলো।

إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِوَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى  বাক্যদ্বয়ের মধ্যে পার্থক্য

বাহ্যিক অর্থের দিক দিয়ে বাক্যদ্বয় একই মর্মার্থ প্রকাশ করলেও পাশাপাশি উল্লেখ করার মাঝে বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে। যথা-

১. দ্বিতীয় বাক্যটি প্রথম বাক্যের তাকীদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ প্রথম বাক্য দ্বারা আমলের মধ্যে নিয়তের কতটুকু দখল রয়েছে তা বর্ণনা করার পর প্রথম বাক্যের মর্মার্থের যথার্থতার উপর জোর দেয়ার জন্য দ্বিতীয় বাক্যটি উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি এদিকে ইঙ্গিত করাও উদ্দেশ্য যে, নিয়তের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠতা থাকা অপরিহার্য। রিয়া পরিত্যাজ্য।

২. কেউ কেউ বলেন, প্রথম বাক্য দ্বারা শুধু এতটুকু বুঝা গেছে যে, নিয়ত অনুসারে আমল গ্রহণীয় হবে। আর দ্বিতীয় বাক্য উল্লেখ করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আমলের ক্ষেত্রে অপরজনের নিয়ত গ্রহণীয় নয়। আমল যার নিয়ত তারই হতে হবে।

৩. কারো কারো অভিমত হলো, দ্বিতীয় বাক্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে- একটি আমলে যত সংখ্যক নিয়ত থাকবে, সেই পরিমাণ সাওয়াব লাভ হবে। এমনকি  যদি কেউ একটি আমল করতে গিয়ে দশটি নিয়ত করে, তাহলে প্রতিটি নিয়ত অনুসারে সে পৃথক পৃথকভাবে দশটি সাওয়াভব লাভ করবে।

উদাহরণত

নামাযের জন্য মসজিদে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন নিয়ত সংযুক্ত হতে পারে। যেমন- (ক) নামায পড়া (খ) মহল্লাবাসীর খোঁজ-খবর নেওয়া (গ) কোনো রোগীকে দেখতে যাওয়া (ঘ) কোন অভাবীকে সাহায্য-সহযোগিতা করা (ঙ) নামাযেরর পর ওয়াজ-নসীহত শোনা (চ) ফেরেশতাদের দুআ পাওয়া (ছ) সালাম বিনিময় করা (জ) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা প্রভৃতি।

৪. আল্লামা ইবনে সামআনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- দ্বিতীয় বাক্য উল্লেখ করা দ্বারা এদিকে নির্দেশ করা হয়েছে যে, এমন কতক কাজ রয়েছে যা মূলত ইবাদত নয়, কিন্তু কেউ যদি উক্ত কাজের মাধ্যমে ইবাদতে সহায়তা লাভের নিয়ত করে, তাহলে এসব কাজের দ্বারা সে সওয়াব লাভ করবে। যেমন- পানাহার করা। যদি কেউ পানাহার করার দ্বারা ইবাদতের জন্য শক্তি অর্জনের নিয়ত করে তাহলে পানাহার করার দ্বারাও সাওয়াব লাভ হবে।

৫. মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- দ্বিতীয় বাক্যটি প্রথম বাক্যেরই ব্যাখ্যা। নতুন কোন কথা এখানে নেই। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্য দ্বারাও বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদাহরণ দ্বারা বুঝিয়েছেন। আর যেহেতু তখনকার সময় হিজরতের আমল জারী ছিল তাই হিজরতের উদাহরণ দ্বারা নিয়তের বিষয়টিকে স্পষ্ট করে দিলেন। এক ব্যক্তি মক্কা থেকে হিজরত করল এজন্য যে মদীনায় দ্বীনের পরিবেশ অনুকূলে, তাই দ্বীনের উপর আমল করা সহজ হবে। আরেক ব্যক্তি হিজরত করল এজন্য যে, মক্কায় তার নিকট থেকে যারা পণ্য ক্রয় করত তারা অনেকেই মদীনা চলে গেছে, ব্যবসার অবস্থা ভালো না। তাই ব্যবসার সুবিধার্থে হিজরত করল। আর তৃতীয় ব্যক্তি হিজরত করল জনৈক নারীকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদাহরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলেন- যার হিজরত যেই নিয়তে হয়েছে তার ফলাফল তার নিয়তের উপরই বিবেচিত হবে।

নিয়তের প্রকার  

শরীয়তের দৃষ্টিতে নিয়ত দুই প্রকার। এক. ইখলাছ দুই. লোক দেখানো।

যখন কোন মানুষ আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোন ইবাদত করে সেই ইবাদত সংক্রান্ত মনের ঐ অবস্থাকে ইখলাছ বলা হয়। আর কেউ লোক দেখানো বা অন্য কোন  উদ্দেশ্যে ইবাদত করলে ইবাদত কালীন মনের সেই অবস্থাকে বলা হয় রিয়া।

নিয়তের শরঈ বিধান

নিহতের শরঈ বিধানের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। যেমন-

১. ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর অভিমত : ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মতে ঐচ্ছিকতা ও  অনৈচ্ছিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের আমল দুই প্রকার। যথা- আমালে মাকসূদাহ ও আমালে গাইরে মাকসূদাহ।

আমালে মাকসূদাহ এর ক্ষেত্রে নিয়ত প্রয়োজন। যেমন- নামায।

আমালে গাইরে মাকসূদাহ-এর ক্ষেত্রে নিয়তের প্রয়োজন নেই। যেমন- ওযু। তবে ওযুর ক্ষেত্রে আমলের পূর্ণতার জন্য নিয়ত আবশ্যক।

২. ইমাম শাফেঈ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর অভিমত : ইমাম শাফেঈ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মতে প্রত্যেক কাজের জন্য নিয়ত শর্ত চাই তা আমালে মাকসুদা হোক বা আমালে গাইরে মাকসুদাহ। তবে জমহুর আলেমের মতে সকল প্রকার কাজই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রতিটি কাজ শুরু করার পূর্বে নিয়ত করতে হবে। নতুবা ঐ কাজে যথাযথ সফলতা অর্জিত হবে না।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT