তাফসীরে সূরা বালাদ [আয়াত-ক্রম : ১০-২০]

আয়াত ও তরজমা

فَلَا اقۡتَحَمَ الۡعَقَبَۃَ

(১১) তবু সে বন্ধুর গিরিপথ অবলম্বন করতে পারেনি।

وَمَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا الۡعَقَبَۃُ

(১২) (হে রাসূল!) আপনি কি জানেন বন্ধুর গিরিপথ কি?

فَکُّ رَقَبَۃٍ

(১৩) এটি হলো দাসমুক্তি,

اَوۡ اِطۡعٰمٌ فِیۡ یَوۡمٍ ذِیۡ مَسۡغَبَۃٍ

(১৪) অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাবার খাওয়ানো।

یَّتِیۡمًا ذَا مَقۡرَبَۃٍ

(১৫) এতীম আত্মীয়কে।

اَوۡ مِسۡکِیۡنًا ذَا مَتۡرَبَۃٍ

(১৬) অথবা দারিদ্র-পীড়িত নিঃস্বকে,

ثُمَّ کَانَ مِنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡمَرۡحَمَۃِ

(১৭) এরপর সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যারা ঈমান এনেছে। যারা পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবর অবলম্বনের এবং দয়া-দাক্ষিণ্যের।

اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡمَیۡمَنَۃِ

(১৮) এরাই তো পরম সৌভাগ্যবান।

وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِنَا هُمۡ اَصۡحٰبُ الۡمَشۡـَٔمَۃِ

(১৯) আর যারা আমার নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখ্যান করেছে, তারাই হতভাগা।

عَلَیۡهِمۡ نَارٌ مُّؤۡصَدَۃٌ

(২০) তারাই হবে অগ্নিতে অবরুদ্ধ।

তাফসীর

(অন্যায়ের গিরিপথটি পার হওয়ার এবং ন্যায়ের উচ্চাসনে ওঠার) সে কোনোদিনই হিম্মত দেখায়নি। অর্থাৎ এত বিপুল পরিমাণ নেয়ামতের বৃষ্টিবর্ষণ আর হেদায়াতের কার্যকারণ বর্তমান থাকতেও দ্বীনের ঘাটিতে কুদে পড়ার তাওফীক তার হল না। তাওফীক হলো না তার উন্নত চরিত্রের পথ অতিক্রম করে কল্যাণ আর সাফল্যের সুউচ্চ স্থানে পৌঁছার। এখানে ‘আক্বাবাহ’ শব্দ দ্বারা বুঝানো হয়েছে গিরিপথকে, যা সাধারণত হয় বন্ধুর।

হযরত ইবনে ওমর রাযিআল্লাহু আনহু বলেছেন, এই বন্ধুর গিরিপথটি হচ্ছে জাহান্নামের একটি পার্বত্য পথ। হাসান ও কাতাদা বলেছেন, ‘আক্বাবাহ’ হচ্ছে জাহান্নামের সেতু পারাপারের একটি গিরিপথতুল্য পথ, যা অতিক্রম করা যায় কেবল আল্লাহপাকের আনুগত্যের দ্বারা।

মুজাহিদ, যুহাক ও কালাবী বলেছেন, জাহান্নামের উপরে স্থাপিত সেতুর নাম আক্বাবাহ, যা তলোয়ারের ধার অপেক্ষা তীক্ষ্ণ এবং যার চড়াই-উত্রাই ও দৈর্ঘ্যের পরিমাণ তিন হাজার বছর পথের দূরত্বের সমান। তার দু’পাশে রয়েছে শাদা বৃক্ষের কণ্টকসদৃশ কণ্টক ও বাঁধানো আংটি। কেউ সে পথ অতিক্রম করবে অনায়াসে, কেউ ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে। কেউ অশ্বারোহীর মতো দ্রুতগতিতে। আবার কেউ অধোমুখী হয়ে পড়ে যাবে জাহান্নামের আগুনে। কেউ চলবে ঝড়ের বেগে, কেউ পদব্রজে কেউ নিতম্ব ঘষতে ঘষতে। কেউ কেউ আবার কাটার আঁচড়ে জখম হতে হতে এক সময় লুটিয়ে পড়বে জাহান্নামে।

ইবনে জায়েদ বলেছেন, ‘সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি’ অর্থ- সে তো চলেনি পরিত্রাণের পথে।

মানবতার অতন্দ্র প্রহরী একমাত্র ইসলাম

এরপর, এ লক্ষ্যবস্তুর গুরুত্ব ও মাহাত্ম তুলে ধরা হয়েছে এই আয়াতে, ‘(হে রাসূল!) আপনি কি জানেন বন্ধুর গিরিপথ কি?’ আসলে এ কথার দ্বারা এই পথের জটিলতা তুলে ধরাই শুধু উদ্দেশ্য নয়, বরং আল্লাহর কাছে আসল গুরুত্ব হচ্ছে কষ্টকর হলেও এই পথটি পার হতে হবে একথাটি বলা। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বলতে চান, এ পথটি অত্যন্ত কঠিন সন্দেহ নেই, কিন্তু তোমাদেরকে এ পথটি পার হতেই হবে। কারণ সে পথটি অতিক্রম করতে পারলেই মনযিলে মকসুদে উপনীত হতে পারবে।

এই পর্যায়ে আরও একটি কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, মূল্যবান জিনিস মূল্য দিয়েই গ্রহণ করতে হয়। চাওয়া-পাওয়ার লক্ষ্যবস্তু যতো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান হবে তা অর্জন করতে ততো বেশি কষ্ট করতে হবে ও অজস্র ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে একথাটিও এখানে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সে কঠিন পথ-পরিক্রমা তথা কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার কখনও বৃথা যেতে পারে না। সর্বশক্তিমান ও সবকিছুর মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এ আশ্বাসবাণী পাঠকের মনকে অবশ্যই উৎসাহিত করবে। আশার আলোকে উদ্ভাসিত করবে তার গোটা দেহ মনকে। আল্লাহ তাআলার এই চিত্তাকর্ষক ভাষার মাধ্যমে ‘আক্ববাহ’র যে ছবিটি এখানে ফুটে উঠেছে, তা মানুষকে আলোচ্য সত্য সঠিক লক্ষ্য বস্তুর গুরুত্ব ও মাহাত্ম বুঝতে সাহায্য করেছে এবং সেই দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এই আয়াতগুলোতে এক মধুর আবেগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

ছিন্নবস্ত্র ও অসহায় মানব সন্তান গোলামীর জিঞ্জীর পরে তোমার দুয়ারে কী করুণ অবস্থায় দাড়িয়ে আছে। চেয়ে দেখো একবার হে সভ্যতাগর্বী মানুষ! মানবতার এ নিদারুণ ব্যথা দূর করার জন্য তুমি কি এগিয়ে আসবে না? সৃষ্টিকর্তার রহস্য প্রত্যাশী হে মুমেনরা! বস্ত্রহীন সেই অসহায় মানুষকে গোলামী থেকে মুক্ত করা, অন্নকষ্টে জর্জরিত বুভুক্ষু আদম সন্তানকে অনুদান করা, ব্যাধিগ্রস্ত, রোগক্লিষ্ট, শক্তিসামর্থহীন, পথের কাংগাল, যারা সকল যামানায় বিত্তশালী ও যুলুমবাজদের হিংগ্র ব্যবহারে নিষ্পিষ্ট, তাদের উদ্ধারকল্পে এবং মানবতার গৌরবাসনে তাদেরকে পুনরায় সমাসীন করতে তোমরা এগিয়ে এসো। হে মুমেন, মুছে দাও অবহেলিত মানবতার এই নিদারুণ গ্লানি, তবেই তো তুমি রহমানুর রহীমের করুনা ধারা পাবে। মানবতার এই মুক্তি ধারায় যারা সঠিক অবদান রাখতে পেরেছে তাদের জন্য পরবর্তী আশ্বাসবাণী ‘তারপর তারা ওই সকল ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে যারা ঈমান এনেছে এবং পরস্পরকে উপদেশ দিয়েছে, সবর করার জন্য ও যথাযথভাবে দুস্থ মানবতার প্রতি দয়াপরবশ হওয়ার জন্যও একে অপরকে উপদেশ দিচ্ছে।’

দাস আযাদ করার ফযীলত

আলোচ্য (১৩নং) আয়াতে বলা হয়েছে- ‘এটা হচ্ছে দাসমুক্তি’। ‘ফাককু রকাবাতিন’ এর শাব্দিক অর্থ- গ্রীবামুক্তি। মর্মার্থ- দাসমুক্তি। বক্তব্যটি সাধারণার্থক। এর অর্থ একজন ক্রীতদাসকে পূর্ণরূপে মুক্ত করে দেওয়া, অথবা তাকে মুক্ত করে দেওয়া তার মূল্য পরিশোধ করে। অথবা লিখিত শর্তে মুক্তি প্রাপ্য দাসকে মুক্তির ব্যাপারে আর্থিক সহায়তা দান। কিংবা যে ক্রীতদাসের মুক্তিপণের কিছু অংশ অপরিশোধিত অবস্থায় আছে, তার সেই অপরিশোধিত অংশ পরিশোধ করে দেওয়া। অর্থাৎ সকল ধরনের ক্রীতদাস মুক্তিই আলোচ্য আয়াতের বক্তব্যভূত।

মক্কায় ইসলামের চরম দুর্দিনে এ আয়াতগুলো নাযিল হয়। ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধান চালু করার জন্যে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রক্ষমতা তখনও রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাতে আসেনি আর সেই সময় সাধারণভাবে আরবের সে সমাজে দাস-প্রথা চালু ছিল। আরব উপদ্বীপের বাইরে অনেক জায়গাতেও এ বিশ্রী প্রথা চালু ছিল। তখনকার দিনে দাসদেরকে অত্যন্ত কঠিনভাবে খাটানো হতো। তারপর এক সময় তাদের মধ্যে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন। যেমন : আম্মার ইবনে ইয়াসের ও তাঁর পরিবার, বেলাল ইবনে রাবাহ, সোহায়ব এবং আরও অনেকে (আল্লাহ তাআলা তাঁদের সবার ওপর সন্তুষ্ট থাকুন)। তাঁদের দাম্ভিক মুনিবরা তাঁদের ওপর অশেষ নির্যাতন চালাতো। ইসলাম গ্রহণ করার পর এই নির্যাতন আরো বাড়িয়ে দিলো। তাঁদের এই দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্ত করার একটিই পথ ছিল আর তা হলো, হৃদয়হীন নিষ্ঠুর মুনিবদের থেকে তাঁদেরকে খরিদ করে মুক্ত করে দেয়া। আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহু ছিলেন সেই প্রথম ব্যক্তি, যিনি এ ব্যাপারে সবার আগে এগিয়ে আসেন এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে পাওয়া আল্লাহর এই ডাকে সাড়া দেন। দাস-মুক্তি ও অন্যান্য হুকুম পালনের ব্যাপারে তার সাহসিকতাপূর্ণ কাজ আজও এক নযীরবিহীন দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।

হযরত বারা ইবনে আজীব রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, একবার এক বেদুইন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহান সংসর্গে উপস্থিত হয়ে বললো, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কিছু করতে বলুন, যা আমাকে নিয়ে যাবে জান্নাতে। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমার কথা ছোট্ট, কিন্তু এর আবেদন বিশাল। ঠিক আছে, ক্রীতদাস মুক্ত করো। মুক্ত করে দাও গ্রীবা।’ বেদুইন বললো, কর্ম দু’টো কি এক নয়? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘ক্রীতদাস মুক্ত করার অর্থ- পুরোপুরি একজন ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দেওয়া। আর গ্রীবা মুক্ত করার অর্থ- কোনো ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীকে মুক্তিপণ পরিশোধের ব্যাপারে আর্থিকভাবে অংশ গ্রহণ। আর শোনো, ক্রীতদাস মুক্ত করার সামর্থ্য যদি তোমার না থাকে, তবে অনাহারীকে আহার করিয়ো। পানি পান করিয়ো পিপাসার্তকে। সৎকর্মের আদেশ দিয়ো এবং বিরত থাকার উপদেশ দিয়ো অসৎকর্ম থেকে। তাও যদি না পারো তবে জিহ্বাকে সংযত রেখো। ভালো কথা ছাড়া মন্দ কথা বলো না।’ (বায়হাকী)

ধর্যের অনুশীলন ও দয়া দেখানোর উপদেশ

‘এরপর সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যারা ঈমান এনেছে। যারা পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবর অবলম্বনের এবং দয়া-দাক্ষিণ্যের।’ বাক্যটির যোগসূত্র রয়েছে ‘বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি’ অথবা ‘এটা হচ্ছে দাসমুক্তি’ এর সাথে। এখানে ‘ছুম্মা’ (তদুপরি, অতঃপর) হচ্ছে অনুক্রমিক অব্যয়। এর পূর্বাপর বিষয় হয় পৃথক পৃথক। দাসমুক্তি, অনুদান ইত্যাদি পুণ্যকর্ম ও ঈমান পৃথক পৃথক বিষয়। তবে ঈমান হচ্ছে যাবতীয় পুণ্যকর্মের ভিত্তি।

এরপর বলা হয়েছে ‘এরাই তো পরম সৌভাগ্যবান।’ অর্থাৎ এসব লোক বড়ই সৌভাগ্যবান এবং মোবারক, যারা মহান আরশের ডান দিকে স্থান পাবে এবং তাদের আমলনামা দেয়া হবে ডান হাতে।

এরপর বলা হয়েছে ‘তারাই হবে অগ্নিতে অবরুদ্ধ।’ অর্থাৎ এমন আগুন যা তাদেরকে ঘিরে রাখবে। এর অর্থ এটাও হতে পারে যে, যখন তারা দোযখের আগুনে শাস্তি পেতে থাকবে, তখন তার দরজাগুলো বন্ধ থাকার কারণে তার তাপ বের হওয়ার কোনো রাস্তা থাকবে না, অথবা এর অন্য অর্থ এটা হতে পারে যে, ওরা সে আযাবের জায়গা থেকে কোনোভাবেই আর বেরিয়ে আসতে পারবে না। কেননা আল্লাহরই হুকুমে ও ব্যবস্থাপনায় তাদের ওখানে আবদ্ধ থাকা। অতএব, সে প্রতিবন্ধকতা দূর করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অবশ্য দুটি অর্থ একে অন্যের পরিপূরক; বিরোধী নয়।

এই স্বল্প পরিসরে মানুষের সীমিত শক্তি ও ব্যাখ্যার যোগ্যতায় উপস্থাপিত এগুলোই হচ্ছে মানব-জীবনের মৌলিক সত্য, যা ঈমানী দৃষ্টিকোন থেকে নির্ধারিত হয়ে আছে এবং এগুলো কুরআনের বিশেষ বর্ণনাভংগি ও একক ব্যখ্যায় বর্ণিত চরম সত্য।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT