ہَلۡ اَتٰىکَ حَدِیۡثُ الۡغَاشِیَۃِ
১. (হে রাসূল!) আপনার নিকট সেই সর্বগ্রাসী ঘটনার (কিয়ামাতের) কোনো সংবাদ পৌঁছেছে কি?
وُجُوۡہٌ یَّوۡمَئِذٍ خَاشِعَۃٌ
২. সেদিন অনেক চেহারাই লাঞ্ছিত হবে।
عَامِلَۃٌ نَّاصِبَۃٌ
৩. ক্লিষ্ট-ক্লান্ত থাকবে।
تَصۡلٰی نَارًا حَامِیَۃً
৪. তারা জ্বলন্ত অগ্নিতে পতিত হবে।
تُسۡقٰی مِنۡ عَیۡنٍ اٰنِیَۃٍ
৫. তাদেরকে উত্তপ্ত প্রস্রবনের ফুটন্ত পানি পান করানো হবে।
لَیۡسَ لَہُمۡ طَعَامٌ اِلَّا مِنۡ ضَرِیۡعٍ
৬. কাঁটাপূর্ণ ঝাড় ব্যতীত অন্য কোনো খাদ্য তাদের ভাগ্যে জুটবে না।
لَّا یُسۡمِنُ وَ لَا یُغۡنِیۡ مِنۡ جُوۡعٍ
৭. তা তাদেরকে হৃষ্ট-পুষ্ট করবে না এবং তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তিও করবে না।
সংক্ষিপ্ত আলোচনা
এ সূরাটি অত্যন্ত গভীর ও প্রশান্ত ভাবের উদ্দীপক কতিপয় সুললিত ছন্দায়িত বাণীর সমষ্টি, যা মানুষকে চিন্তা-ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে, একই সাথে মনে আশা ও শংকার উদ্রেক করে এবং আখিরাতের হিসাব-নিকাশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ সূরা মানুষের মনকে দুটো ভয়াবহ ময়দানে নিয়ে যায়। একটা হলো আখিরাত, তার বিশাল জগৎ এবং তার মর্মস্পর্শী দৃশ্যাবলি। অপরটি হলো, দৃশ্যমান সৃষ্টিজগতের সুবিশাল ময়দান, তার বিভিন্ন সৃষ্টির ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আল্লাহর নিদর্শনাবলি। এরপর আখিরাতের হিসাব-নিকাশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। সেই সাথে, আল্লাহ তাআলার নিরংকুশ আধিপত্য এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁর কাছে ফিরে যাওয়ার অনিবার্য বাধ্যবাধকতাও স্পষ্ট করে তুলে ধরে। এই সমস্ত তত্ত্ব ও তথ্য অত্যন্ত প্রভাবশালী, ভাবগম্ভীর কিন্তু কার্যকর ভঙ্গিতে ব্যক্ত করা হয়েছে, প্রশান্ত কিন্তু গুরুগম্ভীর ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে।
‘আপনার নিকট সেই সর্বগ্রাসী ঘটনার (কিয়ামাতের) কোনো সংবাদ পৌঁছেছে কি?’ সূরাটি এরূপ ভাষায় শুরু হয়েছে এ জন্য যে, এ দ্বারা মানুষের মনকে যেন আল্লাহর দিকে ফেরানো যায় এবং বিশ্ব নিখিলে দৃশ্যমান তাঁর নিদর্শনাবলি, আখিরাতে তাঁর হিসাব গ্রহণ ও সুনিশ্চিত প্রতিফল প্রদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যায়। সূরার শুরুতে একটা জিজ্ঞাসাবোধক পদও রয়েছে। এই জিজ্ঞাসা আসলে ইতিবাচক বক্তব্য দেয়া ও তার গুরুত্ব উপলব্ধি করানোর জন্যই। এ দ্বারা এই মর্মে সূক্ষ্ম ইঙ্গিতও করা হচ্ছে যে, আখিরাতের ব্যাপারে সাদামাটাভাবে ইতিবাচক বক্তব্য দেয়া ও স্মৃতিচারণ করা ইতিপূর্বে বহুবার হয়েছে।
নামকরণ ও ফযীলত
এক. الْغَاشِيَةِ কিয়ামতের অন্যতম একটি নাম। الْغَاشِيَةِ অর্থ : আচ্ছন্ন করে নেয়া, আবৃত করা ইত্যাদি। কিয়ামতকে এ নামে নামকরণ করার কারণ হলো সেদিন মানুষকে কিয়ামতের ভয়াবহতা আচ্ছন্ন করে নেবে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
দুই. হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমুআর নামাযে সূরা জুমুআ-সহ এ সূরা পাঠ করতেন। (মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী)
সূরার আমল
যদি কোনো ব্যক্তি সূরা গাশিয়াহ পাঠ করে খাদ্য-দ্রব্যের উপর ফুঁ দেয়, তবে ঐ খাদ্য-দ্রব্যের ক্ষতি থেকে তাকে হেফাজত করা হয়। দেহের কোনো অংশে ব্যথা হলে এ সূরা পাঠ করে দম করলে ব্যথা দূর হয়।
তাফসীর
প্রথমে বলা হয়েছে ‘তোমার নিকট কি কিয়ামতের সংবাদ পৌঁছেছে?’ প্রশ্নটি স্বীকৃতিসূচক। এর সহজ অর্থ- হে আমার রাসূল! আপনার নিকট নিশ্চয় পৌঁছেছে মহাপ্রলয়ের সংবাদ। الْغَاشِيَةِ অর্থ : আচ্ছন্ন করে নেয়া, আবৃত করা ইত্যাদি। অর্থাৎ সেই মহাবিপদ, যা মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে এবং তার ভয়ংকর মূর্তি ও বিভীষিকাময় দৃশ্য মানুষকে হতবুদ্ধি করে ফেলবে। সেদিন ধ্বংস হয়ে যাবে সমগ্র সৃষ্টি। ইবনে আবি হাতেম সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূল সা. জনৈকা মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন ওই মহিলা পড়ছিল-ہَلۡ اَتٰىکَ حَدِیۡثُ الۡغَاشِیَۃِ। রাসূল সা. দাঁড়িয়ে তা শুনলেন এবং বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার কাছে এ খবর পৌঁছেছে।’ অর্থাৎ কিয়ামতের সংবাদ পৌঁছেছে।
জাহান্নামের চিত্র
এরপর কিয়ামতের কিছু বিবরণ দেয়া হচ্ছে। ‘সেদিন অনেকের মুখমণ্ডল হবে ভীতসন্ত্রস্ত, কঠোর শ্রমে বিব্রত, শ্রান্ত, ক্লান্ত, তীব্র আগুনে দগ্ধ। তাদেরকে পান করতে দেয়া হবে ফুটন্ত ঝর্ণার পানি। কাঁটাযুক্ত শুকনো ঘাস ছাড়া তাদের জন্য আর কোনো খাদ্য থাকবে না। সেই কাঁটাযুক্ত ঘাস পুষ্টি সাধনও করবে না, ক্ষুধাও নিবৃত্ত করবে না।’
এখানে বেহেশতের নিয়ামতের বিবরণ দেয়ার আগে আযাবের বিবরণ দেয়া হয়েছে। কেননা ‘আচ্ছন্নকারী মহাদুর্যোগ’ রূপী কিয়ামতের পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে এর ঘনিষ্ঠতম সাদৃশ্য বিরাজমান। কারণ, কিয়ামতের ময়দানে বহু মুখমণ্ডল ভীতসন্ত্রস্ত ও শ্রান্ত-ক্লান্ত থাকবে। অনেকের অনেক আমলও থাকবে কিন্তু শিরক অথবা আমল বিনষ্টকারী কোনো পাপের কারণে তা আল্লাহর কাছে প্রশংসনীয় হবে না, তার পরিণামও সন্তোষজনক হবে না, ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছু জুটবে না। কেবল তার মনোকষ্ট, ক্লান্তি ও অবসাদই বাড়বে। কেননা, সে যা কিছু কষ্ট করেছে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নয় বরং অন্যান্য স্বার্থ অর্জনের জন্য করেছে। সে যা কিছু পরিশ্রম করেছে, নিজের জন্য, নিজের সন্তানদের জন্য, দুনিয়ার জন্য এবং দুনিয়ার লোভের খাতিরে করেছে। অতঃপর এই শ্রমের ফল পেয়েছে। পৃথিবীতে পেয়েছে বঞ্চনা ও হতাশা। আর আখিরাতে পেয়েছে আযাব। চরম লাঞ্ছনা, ব্যর্থতা ও হতাশার সাথে সে তার চূড়ান্ত পরিণতির মুখোমুখি হয়েছে। আর এই লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, আযাব ও কষ্টের সাথে সাথে জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হতে হবে।
‘উত্তপ্ত ঝর্ণার পানি তাকে পান করানো হবে।’ অর্থাৎ চরম উত্তপ্ত ও উষ্ণ পানি।
সুদ্দী সূত্রে ইবনু আবী হাতিম বর্ণনা করেছেন, এখানকার ‘اٰنِيَةٍ’ শব্দটির অর্থ সর্বোচ্চ মাত্রার উষ্ণতা। কেউ কেউ বলেছেন, সৃষ্টিলগ্ন থেকে দোযখ ওই অত্যুষ্ণ প্রস্রবণের উপরে জ্বলছে। তাফসীরবেত্তাগণ লিখেছেন, পিপাসার্ত জাহান্নামীদেরকে পান করানো হবে এমন উত্তপ্ত পানি, যা একটা পর্বতগাত্রে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে গলে যাবে পুরো পর্বত।
জাহান্নামে কাঁটাযুক্ত খাদ্যের ব্যাখ্যা
‘শুষ্ক কাঁটাযুক্ত ঘাস ছাড়া তাদের আর কোনো খাদ্য থাকবে না।’ নহশল সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইবনু আহাদ বর্ণনা করেছেন, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনু আব্বাসের উক্তি উল্লেখ করে জুহাক বিবৃত করেছেন, রাসূল সা. বলেছেন ‘ضَرِيْعٍ’ (কণ্টকময় গুল্ম) এমনই বস্তু, যা পিলু বৃক্ষের চেয়েও তিক্ত। বাসী মৃতদেহ অপেক্ষাও অধিক দুর্গন্ধযুক্ত এবং আগুনের চেয়েও অধিক উত্তপ্ত। বিষাক্ত ও কণ্টকাকীর্ণ। এই কণ্টকময় উদ্ভিদ যদি কাউকে খাওয়ানো হয়, তবে সে তাকে না উদরস্থ করতে পারবে, না পারবে উগলে ফেলে দিতে। বরং তা আটকে থাকবে কণ্ঠদেশে। ওই উদ্ভিদ ভক্ষণ করলে স্বাস্থ্যের উন্নতি যেমন হবে না, তেমনি পরিতৃপ্ত হবে না ক্ষুন্নিবৃত্তিও। এমনতর বিপদের মধ্যে আবার পান করানো হবে উত্তপ্ত পানি।
সাঈদ ইবনু যুবায়েরের উক্তি উদ্ধৃত করে ইবনু আবী হাতেম বর্ণনা করেছেন ‘ضَرِيْعٍ’ (কণ্টকময় গুল্ম) অর্থ যাক্কুম বা কণ্টকময় উদ্ভিদ। হযরত আবু দারদা থেকে তিরমিযী ও বায়হাকী লিখেছেন, রাসূল সা. বলেছেন, জাহান্নামীরা তখন আক্রান্ত হবে এমন অনন্ত ক্ষুধায় যে, তা যেন হয়ে যাবে সকল শাস্তির সমতুল। মুজাহিদ, ইকরামা ও কাতাদা বলেছেন, ‘ضَرِيْعٍ’ এমন এক কাঁটাভরা গাছ, যার শিকড়গুচ্ছ মৃত্তিকা স্পর্শমুক্ত। কুরায়েশরা একে বলে ‘শাবরক’। এর বিশুষ্ক অবস্থাকেই বলে ‘ضَرِيْعٍ’। এটা একটা অতি নিকৃষ্ট খাদ্য। কালাবী বলেছেন, ‘শাবরক’ যখন শুকিয়ে যায়, তখন তার কাছে চতুষ্পদ জন্তুরাও ভিড়ে না। ইবনু আবী জায়েদ বলেছেন ‘ضَرِيْعٍ’ বলে পৃথিবীর যাবতীয় শুষ্ক, কণ্টকময়, পত্রপুষ্পহীন ঝোপঝাড়গুলোকে বুঝায়। আর পরবর্তী পৃথিবীর ‘ضَرِيْعٍ’ হবে ভীষণ উত্তপ্ত ও কণ্টকময়।
ভাষ্যকারগণ বলেন, আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর পৌত্তলিকেরা বলতে শুরু করল, আমাদের উটগুলো তো ‘ضَرِيْعٍ’ খেয়ে খেয়েই বেড়ে ওঠে, হৃষ্ট-পুষ্ট হয়। উট সাধারণত ভক্ষণ করে সতেজ লতাগুল্ম। শুকিয়ে গেলে তারা আবার এর ধারে কাছেও ঘেঁষে না। জাহান্নামে তো থাকবে এগুলোই। তাদের এমন অপবচনের প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয় পরবর্তী আয়াত। অর্থাৎ তা তাদেরকে হৃষ্ট-পুষ্ট করবে না এবং তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তিও করবে না।
সুতরাং উল্লিখিত ব্যাখ্যার যেটিই সঠিক হোক, ‘গিসলীন’ ও ‘গাসসাকের’ মতো এটিও দোযখের এক ধরনের খাদ্য। এটি সেই সব রকমারি খাদ্যের একটি, যা পুষ্টও করে না, ক্ষুধাও নিবৃত্ত করে না।
পরিশিষ্ট
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দুনিয়ায় বসে আমরা আখিরাতের এই আযাবের প্রকৃতি কী রকম, তা বুঝতে পারব না। এসব গুণের বর্ণনা দেয়ার উদ্দেশ্য এই যে, আমাদের মানবীয় অনুভূতিতে যন্ত্রণার যে সর্বোচ্চ পরিমাণ কল্পনা করার অবকাশ রয়েছে, তা যেন কল্পনা করতে সক্ষম হই। এই যন্ত্রণা অপমান, লাঞ্ছনা, দুর্বলতা, ব্যর্থতা, হতাশা, আগুনের দহন, প্রচণ্ড উত্তপ্ত পানি দ্বারা পিপাসা নিবৃত্তি ও আগুনের দহন জ্বালা পোড়ানোর চেষ্টা এবং পুষ্টও করে না ক্ষুধাও নিবৃত্ত করে না এমন খাদ্য খাওয়া এই সব কিছুর সমাবেশ। এই সব কয়টি যন্ত্রণার একত্র সমাবেশে আমাদের চিন্তায় সর্বোচ্চ পরিমাণ যন্ত্রণার ধারণা পাওয়া সম্ভব। এই আযাবের প্রকৃতি একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা তা থেকে আমাদের পানাহ দিন। আমীন।