اَفَلَا یَنۡظُرُوۡنَ اِلَی الۡاِبِلِ کَیۡفَ خُلِقَتۡ
১৭) তবে কি তারা উটের দিকে লক্ষ করে দেখে না? কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
وَ اِلَی السَّمَآءِ کَیۡفَ رُفِعَتۡ
১৮) আর তারা কি আসমানের দিকে দেখে না, কীভাবে তাকে ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়েছে?
وَ اِلَی الۡجِبَالِ کَیۡفَ نُصِبَتۡ
১৯) আর তারা কি পাহাড়-পর্বতের দিকে দেখে না, কীভাবে সেগুলোকে স্থাপন করা হয়েছে?
وَ اِلَی الۡاَرۡضِ کَیۡفَ سُطِحَتۡ
২০) আর তারা কি পৃথিবীর দিকে লক্ষ করে না, কীভাবে তাকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে?
فَذَکِّرۡؕ اِنَّمَاۤ اَنۡتَ مُذَکِّرٌ
২১) অতএব, (‘হে রাসূল!) আপনি উপদেশ দিতে থাকুন, আপনি তো একজন উপদেশদাতা মাত্র।
لَسۡتَ عَلَیۡہِمۡ بِمُصَۜیۡطِرٍ
২২) আপনি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নন।
اِلَّا مَنۡ تَوَلّٰی وَ کَفَرَ
২৩) কিন্তু যে কেউ বিমুখ হবে এবং নাফরমানী করবে,
فَیُعَذِّبُہُ اللّٰہُ الۡعَذَابَ الۡاَکۡبَرَ
২৪) তবে আল্লাহ পাক তাকে কঠোরতম শাস্তি দেবেন।
اِنَّ اِلَیۡنَاۤ اِیَابَہُمۡ
২৫) নিশ্চয় তাদেরকে আমারই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
ثُمَّ اِنَّ عَلَیۡنَا حِسَابَہُمۡ
২৬) এরপর তাদের হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করা আমারই কাজ।
সংক্ষিত আলোচনা
পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে আখেরাতের বর্ণনার পর এখান থেকে দৃশ্যমান পার্থিব জীবনে প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে। পৃথিবীতে আল্লাহর কত অসীম শক্তিমত্তা, অনুপম বিচক্ষণতা, চমকপ্রদ সৃষ্টিনৈপুণ্য এবং অতুলনীয় প্রকৃতি বৈচিত্র্য বিরাজমান, আর এই দৃশ্যমান জীবনের পরে যে আরো একটা জীবন রয়েছে, এই পৃথিবীর অবস্থা থেকে ভিন্ন যে আরো অবস্থা রয়েছে এবং মৃত্যুর মাধ্যমে যে বিলুপ্তি ঘটে তা যে চরম বিরূপ্তি নয় বরং এরপর আরও একটি জীবন আছে, তার নিদর্শন তুলে ধরা হচ্ছে, ‘তারা কি উটনীগুলোকে দেখে না কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, আকাশমন্ডলকে দেখে না কীভাবে তাকে উচ্চে স্থাপন করা হয়েছে, পর্বতমালাকে দেখে না যে, তা কীভাবে যমীনের বুকে পুঁতে রাখা হয়েছে এবং পৃথিবীকে দেখে না কীভাবে তাকে বিছানো হয়েছে?’
এই চারটি ক্ষুদ্র আয়াত কুরআনের প্রথম শ্রোতা আরব জাতির সাথে সম্পৃক্ত পরিবেশের কতিপয় দিক এবং সমগ্র বিশ্বজগতের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিককে একত্রিত করেছে। এগুলো হচ্ছে আকাশ, পৃথিবী, পাহাড় ও উট (সকল প্রাণীর প্রতিনিধি হিসাবে)।
এই প্রাকৃতিক উপাদানগুলো মানুষের কাছে সর্বত্র উন্মুক্ত তা সে যেখানেই থাক না কেন। আকাশ, পৃথিবী, পাহাড় ও প্রাণী- সর্বত্র বিদ্যমান। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতিতে যতটুকুই দখল মানুষের থাক না কেন, এ কয়টি উপাদান তার জগৎ ও চেতনায় অন্তর্ভুক্ত থাকবেই এবং এ জিনিসগুলোর তাৎপর্য নিয়ে যখন সে চিন্তা-ভাবনা করবে, তখন এর অন্তরালে কী আছে, তা সে বুঝতে পারবে। এর প্রত্যেকটিতে অতি প্রাকৃতিক ও অলৌকিক উপাদান নিহিত রয়েছে। এ জিনিসগুলোতে স্রষ্টার কারিগরি নৈপুণ্যের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। এই একটি বিষয়ই প্রাথমিক আকীদার দিকে ইঙ্গিত করার জন্য যথেষ্ট। এ জন্যে কুরআন সমগ্র মানবজাতির দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট করে।
আল্লাহর অসীম শক্তিমত্তা
‘তারা কি উটনীর দিকে তাকায় না কীভাবে তা সৃজিত হয়েছে?’ উট আরব জাতির প্রথম ও প্রধান জন্তু। এর মাধ্যমে তারা চলাচল ও মালপত্র বহন করে। এর গোশত খায় ও দুধ পান করে। এর পশম দিয়ে পোশাক ও চামড়া দিয়ে তাঁবু বানায়। কাজেই এটা জীবনের প্রধান ও প্রাথমিক উপাদান। এর এমন কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে, যা অন্য কোনো জন্তুর নেই। এত শক্তিমান ও এত বিশালাকৃতির জন্তু হওয়া সত্ত্বেও তা এত বিনয়ী ও অনুগত যে, একটা শিশুও তার লাগাম ধরে টানলে তার পিছু পিছু চলতে থাকে। এত বিরাট উপকারী ও সেবাদানকারী জন্তু হওয়া সত্ত্বেও তার পেছনে মানুষের অতি সামান্যই ব্যয় হয়, তার খাদ্য ও বিচরণক্ষেত্র সহজলভ্য। ক্ষুধায়, পিপাসায়, পরিশ্রমে ও দুর্যোগে এর মতো ধৈর্যশীল ও কষ্টসহিষ্ণু গৃহপালিত জন্তু আর নেই। বিরাজমান প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলাও তার এক অসাধারণ শারীরিক ক্ষমতা।
এ সমস্ত কারণে কুরআন শ্রোতাদের দৃষ্টি উটনীর সৃষ্টিবৈচিত্র্যের দিকে আকৃষ্ট করে। এটি তাদের চোখের সামনেই রয়েছে। এ নিয়ে তাদের কোনো জ্ঞান আহরনের প্রয়োজন নেই। ‘তারা উটনীকে দেখে না কীভাবে তা সৃজিত হয়েছে?’ অর্থাৎ এর সৃষ্টি ও গঠনপ্রক্রিয়া কি দেখে না এবং ভাবে না যে, কীভাবে তাকে তার কর্মের এত উপযোগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে, যার কারণে সে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য অর্জনে পুরোপুরি সফল এবং তার পরিবেশ ও করণীয় কাজের সাথে পুরোপুরি সমন্বিত! তারা তো একে সৃষ্টি করেনি। উটনী নিজেও নিজেকে সৃষ্টি করেনি। সুতরাং এটাই অকাট্যভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, তা এক অতুলনীয় নিপুণ কুশলী স্রষ্টার সৃষ্টি। উটনী সেই স্রষ্টার অস্তিত্বেরই সাক্ষী। মহান আল্লাহর পরিকল্পনা ও পরিচালনা দ্বারা যেমন এটা প্রমাণিত হয়, তেমনি এই জন্তুটির সৃষ্টি দ্বারাও প্রমাণিত হয়।
পরের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘এবং আকাশের দিকে, কীভাবে তাকে ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে?’ এ কথার অর্থ- ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তারা দৃষ্টিপাত করলে কি দেখে না, সেখানে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য নক্ষত্র। তাহলে বেহেশতবাসীদের জন্য সেখানে অসংখ্য পানপাত্র প্রস্তুত করে রাখা যাবে না কেন?
এরপরের আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে- ‘এবং পর্বতমালার দিকে, কীভাবে তাকে স্থাপন করা হয়েছে? এবং ভূতলের দিকে, কীভাবে তাকে বিস্তৃত করা হয়েছে।’ এ কথার অর্থ- সারি সারি পর্বতগুলোর দিকে তারা তাকায় না কেন? দেখে না কেন, কীভাবে বিছিয়ে রাখা হয়েছে ভূপৃষ্ঠকে। বেহেশতে বালিশ, তাকিয়া ও গালিচা বিছানো থাকবে তো এভাবেই।
বিশালত্বের কারণে ভূপৃষ্ঠ গোলাকার হওয়া সত্ত্বেও চ্যাপ্টা মনে হয়। এ কারণে তার ওপর বসবাস করা সহজ হয়েছে। এসব বলা হয়েছে কুদরতের প্রমাণ। অর্থাৎ বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এসব কিছু দেখেও আল্লাহ তাআলার কুদরত এবং বিজ্ঞসুলভ ব্যবস্থাপনা উপলব্ধি করতে পারে না। এটা উপলব্ধি করতে পারলে মৃত্যুর পর পুনরুত্থানেও যে তাঁর ক্ষমতা রয়েছে এবং পরকালে যে বিস্ময়কর ব্যবস্থাপনাও সম্ভব, তা-ও হৃদয়ঙ্গম করতে পারত। ইবনে কাসীরের মতে বিশেষভাবে এ কয়টা বিষয়ের উল্লেখের কারণ এই যে, আরবের লোকেরা উক্ত প্রান্তরে অনেক বেশি চলাচল করত। তখন তাদের সম্মুখে বেশির ভাগ এ চারটি বস্তুই থাকত- বাহন হিসাবে উট, ওপরে আসমান, নীচে যমীন এবং আশপাশে পর্বত। এ কারণে এ নিদর্শনরাজি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে বলা হয়েছে।
দাওয়াত পৌঁছে দেওয়াই শুধু দাঈর কাজ
‘অতএব তুমি উপদেশ দাও; তুমি তো একজন উপদেশদাতা, তুমি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও।’ এ কথার অর্থ- হে আমার প্রিয়তম বার্তাবাহক! আপনি এতক্ষণ ধরে বর্ণিত দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে মানুষকে কেবল উপদেশ দিয়ে যেতে থাকুন। হয়তো তাদের মধ্যে কারো কারো বোধোদয় ঘটবে। কেউ কেউ গ্রহণ করবে আপনার পথনির্দেশনা। কেননা, আপনি তো কেবল উপদেশদাতা। তাদের কর্মনিয়ন্ত্রণ তো আপনার দায়িত্বভূত নয়। এখানকার ‘তুমি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও’ কথাটি আগের বাক্যের বেগ সৃষ্টিকারক। অর্থাৎ এ রকম দায়িত্ব তো আপনাকে দেওয়া হয়নি যে, আপনি তাদেরকে আপনার উপদেশ মানিয়েই ছাড়বেন। এ রকম বলা হয়েছে অন্য একটি আয়াতেও। যেমন ‘আপনি তাদের উপর বলপ্রয়োগকারী তো নন।’
দাওয়াত অস্বীকারকারীদের প্রতি আল্লাহ তাআলার হুঁশিয়ারি
দাওয়াতকে অস্বীকারকারীরা অব্যাহতি পেতে পারে না। তাদেরকে পাকড়াও করার জন্য আল্লাহ তাআলা অবশ্যই রয়েছেন এবং সব কিছুই চূড়ান্ত পর্যায়ে আল্লাহর দিকে আবর্তিত হয়ে থাকে। এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘তবে যে ব্যক্তি পশ্চাদপসরণ করবে ও কুফরী করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সবচেয়ে বড় আযাব দেবেন।’
এই কাফেরদেরকে আল্লাহর কাছে না গিয়ে উপায় নেই এবং আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাদের কর্মফল না দিয়ে ছাড়বেন না।
শেষোক্ত আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে- ‘তাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট; অতঃপর তাদের হিসাব-নিকাশ আমারই কাজ।’ ভীতিপ্রদর্শনকে সুদৃঢ় করার জন্যই এখানে اِلَیۡنَاۤ পদটিকে উল্লেখ করা হয়েছে আগে। অর্থাৎ তাদের প্রত্যাবর্তন এক মহাশক্তিধর সত্তার সমীপে হবে, যিনি তাদেরকে শাস্তি দিতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম। আর এখানকার ‘তাদের হিসাব-নিকাশ আমারই কাজ’ কথাটির অর্থ- তাদের সত্যপ্রত্যাখ্যানের তারতম্যানুসারে উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণ করার দায়িত্বটি আমার। এখানে عَلَیۡنَا শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে অনিবার্যতা প্রকাশার্থে। অর্থাৎ হিসাব-নিকাশ করে তাদেরকে অবশ্যই তিনি শাস্তিদান করবেন, যদিও এরকম করতে তিনি বাধ্য নন। তবে তিনি প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ, যে প্রতিশ্রম্নতি ভঙ্গ করা তাঁর মহামর্যাদার অনুকূল। তাই কৃত প্রতিশ্রম্নতি পূরণার্থে শাস্তি তিনি তাদেরকে দিয়েই ছাড়বেন।