তাফসীরে সূরা গাশিয়া [আয়াতক্রম : ০৮-১৬]

 

وُجُوۡہٌ یَّوۡمَئِذٍ نَّاعِمَۃٌ

৮. সেদিন অনেক চেহারাই আনন্দে উৎফুল্ল হবে।

لِّسَعۡیِہَا رَاضِیَۃٌ

৯. তাদের (দুনিয়ার জীবনের) কর্মতৎপরতায় সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হবে।

فِیۡ  جَنَّۃٍ  عَالِیَۃٍ

১০. সুউচ্চ জান্নাতে।

لَّا تَسۡمَعُ  فِیۡہَا  لَاغِیَۃً

১১. সেখানে তারা কোন বাজে কথা শ্রবণ করবে না।

فِیۡہَا عَیۡنٌ جَارِیَۃٌ

১২. সেখানে প্রবাহিত রয়েছে ঝর্ণাসমূহ,

فِیۡہَا سُرُرٌ  مَّرۡفُوۡعَۃٌ

১৩. উঁচু, উঁচু শয্যা পাতা রয়েছে।

وَّ اَکۡوَابٌ مَّوۡضُوۡعَۃٌ

১৪. প্রস্তুত থাকবে পান-পাত্রসমূহ।

وَّ نَمَارِقُ مَصۡفُوۡفَۃٌ

১৫. সমানভাবে বিছানো রয়েছে গালিচাসমূহ।

وَّ زَرَابِیُّ مَبۡثُوۡثَۃٌ

১৬. এবং স্থানে স্থানে রয়েছে আরাম কেদারা।

 

তাফসীর

পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে জাহান্নামী ও তাদের দূরবস্থার কথা আলোচনার পর কিয়ামতের দিন জান্নাতীরা তাদের সৎআমলের প্রতিদানস্বরূপ যে নিয়ামতপূর্ণ সুউচ্চ জান্নাত পাবে এবং তাতে যে সুখ-সাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশে থাকবে সে কথা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এটাই জান্নাত, তোমাদেরকে যার অধিকারী করা হয়েছে, তোমাদের কর্মের ফলস্বরূপ। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে প্রচুর ফল-মূল, তোমরা তা হতে আহার করবে।’ [সূরা যুখরূফ, আয়াতক্রম : ৭৩-৩]

বেহেশতের বর্ণনা

‘সেদিন অনেকের মুখমণ্ডল হবে উৎফুল্ল ও উজ্জ্বল। নিজের চেষ্টা-সাধনার জন্য তারা সন্তুষ্ট হবে।’

এখানে এই অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে, বেহেশতে কিছু লোকের মুখমণ্ডলে প্রাচুর্য ও আনন্দের লক্ষণ পরিস্ফুট হবে, সন্তোষ ও তৃপ্তির আলামত ফুটে উঠবে। সেই সব মুখমণ্ডল আপন প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট হবে, আপন কৃতকর্মের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। কেননা তারা তাদের কল্যাণময় ফল ভোগ করতে সক্ষম হয়েছে। সেখানে তারা নিজেদের আমলে আল্লাহকে সন্তুষ্ট দেখে পরম আত্মিক তৃপ্তি উপভোগ করবে। সৎ ও কল্যাণকর কাজের প্রতি নিজে পরিপূর্ণ তৃপ্তি ও আস্থা বোধ করা, তার সুফল ভোগ করা, অতঃপর আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নিয়ামতের মধ্যদিয়ে তার ফলাফল বাস্তবে প্রত্যক্ষ করার মতো মনের তৃপ্তিদায়ক অবস্থা আর কিছু হতে পারে না। এ কারণেই কুরআন সৌভাগ্যের এই দিকটিকে বেহেশতে যে ভোগের প্রাচুর্য ও পরিতৃপ্তির ব্যবস্থা রয়েছে, তার আগে উল্লেখ করেছে।

এরপর বেহেশত ও তাতে সৌভাগ্যবানদের জন্যে যে নিয়ামতসমূহ নির্ধারিত রয়েছে তার বর্ণনা দিয়েছে। প্রথমেই বলা হয়েছে- ‘তারা উচ্চ বেহেশতে থাকবে।’ অর্থাৎ তা অবস্থানগতভাবেও উচ্চ, মান-মর্যাদায়ও উৎকৃষ্ট। আর উচ্চতার ধারণা মানুষের অনুভূতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

‘সেখানে তারা কোনো বাজে কথা শুনবে না।’ এখানে ‘لَّا تَسۡمَعُ’ অর্থ তারা শুনবে না। অর্থাৎ শুনবে না ওই মুখমণ্ডলধারীগণ। অথবা এখানে সম্বোধিতজন হতে পারেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এমতাবস্থায় বক্তব্যটি দাঁড়াবে- হে আমার প্রিয়তমজন! জান্নাতের অভ্যন্তরে আপনি কাউকে অর্থহীন, শিষ্টাচার-বহির্ভূত কথা বলতে শুনবেন না। ‘لَاغِیَۃً’ অর্থ অসার বাক্য, অর্থহীন কথা।

এ বক্তব্যে এমন এক পরিবেশের কথা ফুটে উঠেছে, যে পরিবেশ সম্পূর্ণ নিরিবিলি, নিরাপদ, তৃপ্তিকর, শান্তিদায়ক ও সন্তোষে পরিপূর্ণ। সব রকমের বাজে কথা, অশুভ কথা থেকে সে পরিবেশ মুক্ত। এটাই একমাত্র নিয়ামত, এটাই একমাত্র সুখ ও সৌভাগ্য। ইহকালীন জীবন ও তার আজেবাজে কথা, ঝগড়াঝাটি, হট্টগোল, ভিড়, সংঘর্ষ, চিৎকার, শোরগোল, গোলযোগ, অরাজকতা ইত্যাদি যখন কল্পনা করা হয়, তখন তার পাশাপাশি এই অনাবিল শান্তির প্রকৃতি উপলব্ধি করা যায়।

এ বাক্যটির মর্ম থেকে এ কথাও প্রতিভাত হয় যে, পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব-সংঘাতমুক্ত মুমিনদের জীবন বেহেশতী জীবনেরই একটি অংশ। দুনিয়ায় এ রূপ দ্বন্দ্ব-সংঘাতমুক্ত জীবন-যাপন করে তারা আসলে বেহেশতের সেই নিয়ামতসমৃদ্ধ জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকেন।

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নিয়ামতসমূহ

পরের আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা মানুষের ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে তৃপ্তি দিতে সক্ষম এমন নিয়ামতসমূহের বিবরণ দিয়েছেন, যা দুনিয়ার মানুষ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম। অথচ বেহেশত তো বেহেশতবাসীর উন্নত মনমানসিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, যার প্রকৃত রূপ ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়।

সেই বিবরণের প্রথম কথা হলো, ‘সেখানে বহমান ঝর্ণা রয়েছে।’

এখানকার ‘عَیۡنٌ’ (ঝর্ণা বা প্রস্রবণ) শব্দটিতে তানভীন প্রযুক্ত হয়েছে মাহাত্ম্য প্রকাশার্থে। অর্থাৎ জান্নাতে প্রবাহিত হতে থাকবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত স্রোতস্বিনী, ওই স্রোতস্বিনীসমূহের প্রবাহে থাকবে নিরবচ্ছিন্ন মধু, কর্পূর, দুধ অথবা সুরাবিশিষ্ট পৃথক পৃথক ধারা।

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে ইবনে হিব্বান, হাকিম, বায়হাকী ও তবরানী বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জান্নাতের স্রোতস্বিনীসমূহ উৎসারিত হতে থাকবে মিশকের গিরিমালা থেকে।’

প্রবহমান পানি চেতনা ও অনুভূতিতে প্রাণপ্রবাহ ও উচ্ছল আত্মার জোয়ার আনে। চেতনার অতলান্তে প্রবিষ্ট এই গোপন দৃষ্টিকোণ থেকে এটি উপভোগ্য বস্তু বটে।

পরের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘সেখানে রয়েছে উচ্চ আসনসমূহ।’ এ কথার অর্থ- জান্নাতবাসীদের আসনসমূহ হবে সমুন্নত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। এ রকম ব্যাখ্যা করেছেন হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে আবু তালহা রাযি.। আর হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে আহমদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজা বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জান্নাতীদের দুটি শয্যার মধ্যে ব্যবধান হবে আকাশ-পৃথিবীর দূরত্বের মতো’। তিরমিযীর বর্ণনায় এসেছে, ‘পাঁচ শত বছরের পথের ব্যবধানের কথা’। তিনি আরো লিখেছেন, ‘শয্যাগুলির পারস্পরিক মর্যাদাগত ব্যবধান হবে আকাশ-পৃথিবীর ব্যবধানের মতো।’

ইবনে আবিদ দুনইয়া বর্ণনা করেছেন, হযরত আবু উমামা রাযি. বলেছেন, ‘যদি উপরের শয্যার চাদর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তবে চল্লিশ বছরেও তার প্রান্ত পৌঁছতে পারবে না নিচের শয্যা পর্যন্ত।’ বিশুদ্ধ সূত্রে হযরত আবু উমামা রাযি. থেকে তবরানী বর্ণনা করেছেন, ‘শয্যার চাদরের প্রান্ত উপর থেকে নিচে পৌঁছতে সময় লাগবে দুই শত বছর।’

বাগবী রহ. লিখেছেন, হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. বলেছেন, ‘ওই সুখাসনগুলোর তক্তা হবে স্বর্ণের এবং তার প্রান্ত হবে জমরুদ, ইয়াকুত ও মোতির। আসনগুলো হবে অত্যুচ্চ। কিন্তু জান্নাতবাসীরা তাতে উপবেশন করার ইচ্ছা প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো অবনমিত হবে। আবার তার উপরে উপবেশন করার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো উঁচু হয়ে যাবে আগের মতো।

‘পানপাত্রসমূহ সুসজ্জিত হবে।’ অর্থাৎ সারিবদ্ধভাবে পানের জন্য প্রস্তুত থাকবে, চাওয়ারও প্রয়োজন হবে না, প্রস্তুত করারও প্রয়োজন হবে না। হেলান দেয়ার বালিশসমূহ সারবদ্ধ থাকবে। ‘نَمَارِقُ’ শব্দের অর্থ আরামে হেলান দেয়ার মতো বালিশ বা গদি। মূল্যবান কোমল বিছানা পাতা থাকবে। ‘زَرَابِیُّ’ অর্থ মখমলের বিছানা। ‘কার্পেটসমূহ’ এখানে সেখানে পাতা থাকবে, তা যেমন আরামদায়ক হবে, তেমনি হবে নয়নাভিরাম।

উল্লিখিত সবকটি জিনিসই এমন নিয়ামত, যার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অনেক কিছুই মানুষ পৃথিবীতে দেখতে পায়। এ সব সাদৃশ্যময় জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে করে তা মানুষের উপলব্ধি-ক্ষমতার আয়ত্ত্বাধীন আসে। তবে সেগুলোর প্রকৃতি এবং বেহেশতের আসবাবপত্রের প্রকৃতি কেমন হবে তা নির্ভর করবে সেখানকার অধিবাসীদের অভিরুচির ওপর। যে সৌভাগ্যশালী বেহেশতবাসীকে আল্লাহ তায়ালা এই অভিরুচি দান করবেন, তাদের ওপর।

পরিশিষ্ট

আখিরাতের আযাব ও নিয়ামতের প্রকৃতি আসলে কেমন হবে, তা নিয়ে সূক্ষ্ম মূল্যায়ন বা গবেষণায় প্রবৃত্ত হওয়া নিরর্থক। কেননা, কোনো জিনিসের প্রকৃতি উপলব্ধি করা নির্ভর করে উপলব্ধির ক্ষমতা ও সমার্থক জিনিসটা কী ধরনের, তা জানা ও বোঝার ওপর। পৃথিবীবাসী যে চেতনা ও অনুভূতি দ্বারা কোনো কিছুকে উপলব্ধি করে, সে অনুভূতি এ পৃথিবীর পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং এখানকার জীবনের প্রকৃতির সীমাবদ্ধতায় বন্দী। তারা যখন আখেরাতের জগতে পৌঁছে যাবে, তখন সকল আবরণ উঠে যাবে, বাধাবিঘ্ন অপসারিত হয়ে যাবে এবং আত্মা ও বোধশক্তি স্বাধীন হবে এবং শুধুমাত্র অভিরুচির পরিবর্তনের কারণে বহু শব্দের এখানে যে অর্থ ছিল, ওখানে তা থেকে ভিন্ন অর্থ হবে। আজ আমরা যা বুঝতেই পারি না কেমন করে সংঘটিত হবে, তা সেখানে বাস্তবিকভাবেই সংঘটিত হবে।

এ সমস্ত বিবরণ দেয়ার উদ্দেশ্য শুধু এই যে, আমাদের বর্তমান কল্পনাশক্তি যে সর্বোচ্চ পরিমাণের স্বাদ, আনন্দ ও সুবিধা কল্পনা করতে সক্ষম, তা যেন কল্পনা করে। যতদিন আমরা এ পৃথিবীতে আছি, ততদিন আমাদের আস্বাদন ও উপলব্ধির ক্ষমতা এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। এসব নিয়ামতের প্রকৃতি আখিরাতে কী তা আমরা ততদিন বুঝব না, যতদিন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর সন্তোষ ও অনুগ্রহ দ্বারা ধন্য না করবেন এবং আমরা সেগুলো কার্যত উপভোগ করব।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT