আয়াত ও তরজমা
وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا
(১) শপথ সূর্যের এবং তার কিরণের।
وَالْقَمَرِ إِذَا تَلَاهَا
(২) শপথ চন্দ্রের, যখন তা সূর্যের পেছনে ছোটে।
وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَاهَا
(৩) শপথ দিনের, যখন সে তাকে আলোকিত করে।
وَالنَّهَارِ إِذَا جَلَّاهَا
(৪) শপথ রাতের, যখন সে তাকে আচ্ছাদিত করে।
وَالسَّمَاءِ وَمَا بَنَاهَا
(৫) শপথ আসমানের এবং যিনি তা নির্মাণ করেছেন তাঁর।
وَالْأَرْضِ وَمَا طَحَاهَا
(৬) শপথ পৃথিবীর এবং যিনি তাকে বিস্তৃত করেছেন তাঁর।
وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا
(৭) শপথ মানুষের এবং শপথ তাঁর, যিনি তাকে সুঠাম করেছেন।
সূরার নামকরণ ও আমল
সূরার প্রথম আয়াতের “الشَّمْسِ” শব্দ থেকেই উক্ত সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরায় সফলকামদের বৈশিষ্ট্য এবং ব্যর্থদের ব্যর্থতার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে।
যে ব্যক্তি কোন কর্মের পরিণতি সম্পর্কে অবগত হতে চায়, সে যেন রাত্রিকালে পবিত্র পোশাক পরিধান করে কেবলামুখী হয়ে সূরা আস শামস, সূরা ওয়াল লাইল, সূরা ওয়াত ত্বীন এবং সূরা এখলাছ সাতবার করে পাঠ করে এবং আল্লাহ পাকের দরবারে বিনীত হয়ে এ আরজী পেশ করে যে, হে আল্লাহ! আমাকে এ কাজটির পরিণতি জানিয়ে দাও। এভাবে এ আমলটি সাতদিন করবে। এ আমল সম্পর্কে কাউকে অবহিত করবে না। আশা করা যায় আল্লাহ পাক এর বরকতে তার কাম্য বিষয় সম্পর্কে তাকে অবগত করবেন।
সংক্ষিপ্ত আলোচনা
ছোট্ট সূরাটির মধ্যে আল্লাহ তাআলা বিশ্ব-প্রকৃতির মধ্য থেকে বেশ কয়েকটি সুন্দর ছবি অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও মানব সৃষ্টির রহস্য ও তার প্রকৃতিগত শক্তিনিচয়, তার ঝোঁক প্রবণতা, তার পছন্দ ও ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে তার নিজস্ব দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে এক বিশদ আলোচনা ফুটিয়ে তুলেছেন, যা সূরাটিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
এরপর আলোচনা এসেছে সামুদ জাতির ইতিহাস নিয়ে। কিভাবে তারা তাদের রাসূলকে মিথ্যাবাদী সাজালো, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত উটনীকে কিভাবে পা কেটে দিয়ে হত্যা করলো, তার পরিণতিতে কিভাবে তাদের ওপর ধ্বংস ও সামগ্রিক অধঃপতন নেমে এলো। এগুলো সবই ছিল সে হতভাগাদের ব্যর্থতা ও ধ্বংসের উদাহরণ, যারা পাপাচারী তাদের পাপ কাজ করার জন্য আল্লাহ তাআলা কিছু ঢিল দেন, যার কারণে বহু পাপ কাজে তারা লিপ্ত হয়ে যায়। আল্লাহর ভয়-ভীতিকে তারা শিকেয় তোলে রাখে, যেমন এই সূরার প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই সাফল্য লাভ করলো সে, যে নিজেকে পবিত্র রেখেছে এবং ব্যর্থ হলো সে, যে তার নফসকে কলুষিত করেছে।
তাফসীর
সূরাটিতে আল্লাহ তাআলা ধারাবাহিকভাবে তাঁর সাতটি বড় বড় মাখলুক নিয়ে কসম করেছেন। এই কসমের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে- সৃষ্টিলোকের সব কিছুর মধ্যেই যে বিশেষ বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, তা ফুটিয়ে তোলা এবং সেদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, যাতে মানুষ সে সব কিছুর তাৎপর্য বুঝার চেষ্টা করে এবং এগুলোর সাথে মানুষের সম্পর্ক কী তা নিয়ে ভাবতে পারে।
সূর্য ও চন্দ্রের শপথ
প্রথমেই আল্লাহ তাআলা সূর্য ও তার উজ্জ্বল আলোকের শপথ করেছেন। এটা আল্লাহ তাআলার একটি অন্যতম বড় মাখলুক এবং নিদর্শন। সাধারণভাবে সূর্যের কসম খাওয়া হয়ে থাকে, কিন্তু এখানে সূর্যের কসম খাওয়ার সাথে সাথে দিকচক্রবালে উদীয়মান সদ্যস্নাত প্রভাত-বেলার এই স্নিগ্ধ আলো বড়োই মধুর, বড়ই মনোমুগ্ধকর একথা বলা হয়েছে। আরও মিষ্টি লাগে তখন যখন শীতের সকালের স্বচ্ছ আকাশে উদীয়মান সূর্য মুঠো মুঠো রূপালী আলো ছড়িয়ে শীতক্লিষ্ট শরীরগুলোকে উত্তপ্ত করে তোলে। আর গ্রীষ্মকালে এশরাকের নামাযের সময়ে প্রভাতের আলোর সৌন্দর্য বড়ই চমৎকার লাগে, যেহেতু দুপুরের প্রাণান্তকর তাপের ছোঁয়া লাগার পূর্বেই এ সময়ের সুশীতল স্নিগ্ধতা হৃদয়-মনকে পুলকিত করে। এ আলোর ছটায় আশপাশের সবকিছু স্বচ্ছ ও আলোয় ঝলমল হয়ে ওঠে।
অবশ্য কাতাদাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন- এখানে ‘দ্বুহা’ দ্বারা সারা দিন উদ্দেশ্য। ‘কামুস’ অভিধানে লেখা রয়েছে ‘দ্বাহিয়্যাতু’ অর্থ- ক্রমবর্ধমান দিবস। ‘দ্বুহা’ এবং ‘দ্বিহা’ উভয় শব্দের অর্থ- দ্বিপ্রহরের পূর্বক্ষণ।
‘শপথ চন্দ্রের, যখন তা সূর্যের পর আবির্ভূত হয়’। বলা বাহুল্য চন্দ্র উদ্ভাসিত হয় সূর্যাস্তের পরেই। আর তার এ অবস্থা থাকে চান্দ্রমাসের প্রথম অর্ধাংশে। অথবা কথাটির মর্মার্থ হবে- ওই সময়ের চন্দ্রের শপথ! যখন তা হয় ষোলো কলায় পরিপূর্ণ, প্রায় সূর্যের মতো উজ্জ্বল ও গোলাকার। আর চন্দ্রের এরূপ সৌন্দর্য ফোটে চান্দ্রমাসের তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখের রাতে।
চাঁদের সাথে মানুষের মনের গভীর ভালোবাসা বহু প্রাচীন কাল থেকে কিংবদন্তীর মতো প্রচলিত রয়েছে। এ ভালোবাসা মানব মনের গভীরে প্রথিত। চাঁদের এ আলো মানুষের মনের গহীনে বরাবরই প্রেম-ভালোবাসার আবেগ জাগায়।
এই চাঁদনী রাতেই প্রেমিক মন আল্লাহ তাআলার মহব্বতের সুধা পান করে তাঁর প্রেমগাথা গাইতে গাইতে মুগ্ধ আবেগে আত্মহারা হয়ে যায়, বিধৌত হয়ে যায় তার কলুষিত মন। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোকে অবগাহন করে প্রেমাস্পদ আল্লাহ তাআলার আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে পরম পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়ে।
দিন ও রাতের শপথ
‘শপথ দিবসের, যখন সে তাকে প্রকাশ করে’। একথার অর্থ- শপথ দিবসের, যা উজ্জ্বল করে দেয় সূর্যকে, অথবা অন্ধকারকে, কিংবা পৃথিবীকে। সমুজ্জ্বল করার সঙ্গে এখানে দিবসের সম্পৃক্তি ঘটেছে রূপকার্থে।
কুরআন পাক বিশেষভাবে আরও যে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে তা হচ্ছে, সূর্য উদয়ের সাথে সাথে আশেপাশের সব কিছু আলোকজ্জ্বল হয়ে যায় এবং এগুলো মানুষের হৃদয়ানাভূতিতে বিপুল সাড়া জাগায়। মানুষের অবচেতন মনে তার অজান্তেই আলোকোজ্জল দিন এমন এক আনন্দানুভূতি সৃষ্টি করে, যা ব্যক্ত করতে মানুষের ভাষা সত্যিই অক্ষম। মানুষের জীবনে দিনের আলোর প্রয়োজন ও প্রভাব যে কতো গভীর, তা প্রত্যেক মানুষই জানে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই দিনের সৌন্দর্য ও তার প্রভাব সম্পর্কে উদাসীন থাকে। এজন্যই এখানে তাদের অনুভূতিতে সাড়া জাগানোর উদ্দেশ্য এবং কতো ব্যাপকভাবে এসব জিনিস মানুষের জীবনে ক্রিয়াশীল, সে বিষয়ে সজাগ করার জন্য এই বিষয়গুলোর অবতারণা করা হয়েছে।
এমনি করে কসম খেয়ে বলা হয়েছে, ‘রাতের কসম যখন তা পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে ফেলে’। আচ্ছন্ন করে ফেলা উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ করার বিপরীত। রাতের ঢেকে ফেলা বলতে বুঝায় রাতের আগমনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাওয়া। যেমন দিনের আলো মানুষের মনকে প্রভাবিত করে, তেমনি রাতের অন্ধকারও বিভিন্নভাবে মানুষের মনের ওপর ক্রিয়াশীল।
আকাশ ও পৃথিবীর শপথ
‘শপথ আকাশের এবং যিনি তা নির্মাণ করেন, তাঁর’। লক্ষণীয়, এখানে আকাশের উল্লেখ করা হয়েছে তার সৃষ্টিকর্তার আগে। তাই প্রশ্ন জাগে, এটা কি সৌজন্য বিরোধী নয়? স্রষ্টার পূর্বে সৃষ্টির উল্লেখ কি সমীচীন? এর উত্তরে বলা যায়- হ্যাঁ, এটাই তো নিয়ম। এ হচ্ছে ছোট থেকে বড়র দিকে, নিচু থেকে উচ্চতার দিকে যাত্রার প্রক্রিয়া। অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে গমনই তো অধিক সৌজন্যসম্মত ও সমীচীন।
এর পরের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘শপথ পৃথিবীর এবং যিনি তাকে বিস্তৃত করেছেন, তাঁর’। এখানেও ‘মা’ অব্যয়টি ব্যবহৃত হয়েছে ‘মান’ অর্থে। অর্থাৎ ভূমি ও তার সম্প্রসারণকারীর শপথ। অথবা শপথ ভূপৃষ্ঠের এবং ভূপৃষ্ঠস্থিত সকল কিছুর। এরূপে ব্যাখ্যারীতি প্রযোজ্য হবে পরবর্তী আয়াতেও।
পরের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘শপথ মানুষের এবং তাঁর, যিনি তাকে সুঠাম করেছেন’। একথার অর্থ- শপথ মানবপ্রবৃত্তির এবং তাঁর, যিনি প্রবৃত্তির স্রষ্টা ও বিন্যাসক। তিনিই তো মানব প্রবৃত্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বৈপরীত্যের সমতা, সুসাম্য ও যথা-উপযোগিতা।
সকল সৃষ্টবস্তুর মধ্যে সৃষ্টি-নৈপুণ্যের বিশেষ বিশেষ দিক চিন্তাশীল হৃদয়কে সত্যিই চমৎকৃত করে, কিন্তু মানব সৃষ্টির মধ্যে যে নৈপুণ্য বর্তমান রয়েছে তার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে চিন্তা করলে মানুষ দেখতে পাবে যে, এর কোনো একটিকেও যদি নিজস্ব স্থান থেকে সরিয়ে অন্য কোনো জায়গায় স্থাপন করা হয়, তাহলে গোটা দেহযন্ত্রটা বিকল হয়ে যাবে। মহা শিল্পী আল্লাহর সৃষ্টি পরিকল্পনার এ এক অত্যাশ্চর্য দিক যে, দেহযন্ত্রের মধ্যে যে যন্ত্রাংশটি যেখানে সর্বাধিক খাপ খায়, সেখানেই সেটিকে বসানো হয়েছে। এর যেকোনো বিকল্প চিন্তা শুধু বিপর্যয়ই ডেকে আনতে পারে। তারপর তার মধ্যে তিনি দিয়েছেন যুগপৎ পাপ-প্রবণতা ও আল্লাহভীতি এমতাবস্থায় সে-ই সাফল্যমণ্ডিত হবে, যে নিজের প্রবৃত্তিকে পবিত্র রাখলো। আর ব্যর্থতায় ভরে গেলো তার জীবন, যে এ প্রবৃত্তিকে অন্যায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে কলুষিত ও অপবিত্র করলো।