আয়াত ও তরজমা
فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا
(৮) এরপর তিনিই তাকে জ্ঞান দান করেছেন, মন্দ কাজের এবং তা থেকে আত্মরক্ষা করার।
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا
(৯) নিশ্চয় সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে আত্মসংশোধন করেছে।
وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا
(১০) এবং সে-ই ব্যর্থ হয়েছে যে নিজেকে কলুষিত করেছে।
তাফসীর
“এরপর তিনিই তাকে জ্ঞান দান করেছেন, মন্দ কাজের এবং তা থেকে আত্মরক্ষা করার।” এ আয়াত দ্বারা আল্লাহ তাআলা বুঝাতে চেয়েছেন যে, মানুষকে ভাল বা মন্দ গ্রহণ করার এক সজ্ঞান ও সজাগ শক্তি দেয়া হয়েছে, যা তার এখতিয়ারাধীন এবং যে তাকে পরিচালনা করতে সক্ষম। এ শক্তি তার অনাগত প্রকৃতি প্রদত্ত যোগ্যতাকে কল্যাণের কাজে যেমন এগিয়ে দিতে পারবে, তেমনি এগিয়ে দিতে পারবে অকল্যাণকর কাজেও। এ পর্যায়ে এসে স্বাধীনতার সাথে তার দায়িত্ববোধ সক্রিয় হয়ে উঠবে। তাকে বিবেক ও বুঝশক্তি দেয়ার সাথে বিশেষ দায়িত্ববোধও দেয়া হয়েছে। যার দ্বারা সে মন্দ কাজ থেকে নিজের আত্মরক্ষা করতে পারবে।
মানুষের ওপর আল্লাহ রহমত সদা-সর্বদা আছে বলেই তিনি তাকে প্রকৃতিগতভাবে প্রাপ্ত বুঝ ও যোগ্যতার ওপর নির্ভর করার জন্য ছেড়ে দেননি অথবা যে শক্তিকে কাজে লাগানোর এখতিয়ার তাকে দেয়া হয়েছে, সেই শক্তির ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করার জন্য তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেননি বরং রেসালাত-রূপ নেয়ামত তাকে দেয়া হয়েছে, যাতে করে সে কঠিনভাবে ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার যোগ্যতা লাভ করে এবং ঈমানের দাবী অনুযায়ী সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে চলতে পারে। একইভাবে রেসালাত (আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা ওহীর জ্ঞান) তার অন্তরের মধ্যে সঠিক পথ চেনার যুক্তিপ্রমাণ হাযির করে এবং আশেপাশের সবকিছু থেকে সে জ্ঞান পেতে পারে। এই ওহীর জ্ঞানের কারণে সে কৃপ্রবৃত্তির বলগাহীন আবেগ থেকে রেহাই পেয়ে সত্যকে তার আসল ও সঠিক চেহারায় দেখতে সক্ষম হয়। আর এভাবে তার সত্য সঠিক পথ এমনভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তার মনের মধ্যে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না। তখন সে তার সচেতন শক্তিকে উদ্ঘাটনের জন্য এবং সঠিক পথ-প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তাকে কাজে লাগিয়ে সেই পথে চলতে থাকে। মোটকথা, আল্লাহ তাআলা মানুষকে এই উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন এবং তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকে যা সে করে তাই তার কাছে আল্লাহ তাআলার দাবী এবং এতোটুকুর জন্যই আল্লাহ তাআলা তাকে মর্যাদা দান করবেন।
সাঈদ ইবনে যোবায়ের এবং ইবনে যায়েদ এই আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন এরকম- ‘আল্লাহপাক মানুষের জন্য অপরিহার্য করে দিয়েছেন মিতাচার ও অমিতাচারকে। সে যা আকাঙ্খা করে, তার অন্তরকে আল্লাহপাক সেদিকেই ধাবিত করে দেন। অথবা তিনি প্রবৃত্তিকে দান করেন সংযমী হওয়ার সামর্থ্য। হৃদয়ে সৃষ্টি করেন সংযম-স্পৃহা। অথবা অসহায়ভাবে প্রবৃত্তিকে ছেড়ে দেন দুষ্কর্মাবলীর দিকে এবং হৃদয়েও সৃষ্টি করে দেন দুর্বৃত্তি।’
হযরত ইমরান ইবনে হোসাইন বলেছেন, ‘একবার মুজাইনা গোত্রের দু’জন লোক নিবেদন করলো, হে আল্লাহর বচনবাহক! মানুষ যা করে বা করার চেষ্টা করে, তা কি তার নিয়তির বিধানানুসারে? না তা আপনার আনীত শরীয়তের বিধানানুসারে ঘটিতব্য ভবিষ্যতের কর্মযোগ? অবাধ্যতার কারণে তো আমাদের বিরুদ্ধ দলীল-প্রমাণও প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, মানুষের সকল কর্ম তার নিয়তির অনুসরণেই সম্পাদিত হয়। একথার প্রমাণ রয়েছে আল্লাহর কালামে। যেমন ‘শপথ মানুষের এবং তাঁর, যিনি তাকে সুঠাম করেছেন, অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও তার সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন।’
হযরত ইবনে ওমর বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বললেন, মানুষের অন্তঃকরণ সর্বোতোভাবে আল্লাহর করতলগত। তিনি মানবহৃদয়কে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে ঘুরিয়ে দেন। এরপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রার্থনা করলেন, হে হৃদয়সমূহের বিবর্তক! আমাদের হৃদয়সমূহকে তোমার আনুগত্যের দিকে ফিরিয়ে দাও।’ (মুসলিম)
আত্মার পরিশুদ্ধি
“নিশ্চয় সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে আত্মসংশোধন করেছে।” এখানে আত্মার পরিশুদ্ধির পথ সরাসরি মানুষ আল্লাহর কাছ থেকেই পায়। আর তখন সে যেন তাঁর নূরের আলোকে অবগাহন করতে থাকে এবং মানুষের অস্তিত্বকে ধ্বংস করা ও তাকে ভুল পথে পরিচালনার জন্য যে সকল স্রোতধারা মানব সমাজে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, সেগুলো থেকে আল্লাহ তাআলাই তাকে বাঁচান।
নাফসকে পরিপাটি করা আর পাক করা হচ্ছে এই যে, কামনাশক্তি আর ক্রোধশক্তিকে জ্ঞান-বুদ্ধির বাধ্য-অনুগত করতে হবে এবং করতে হবে খোদায়ী শরীয়তের অনুগত। যাতে রূহ আর কলব উভয়ই খোদায়ী নূরের আলোকে আলোকিত হতে পারে।
হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, আমি স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে শুনেছি, ‘ওই নফস সফল, যাকে আল্লাহ পবিত্র করে দিয়েছেন।’ জুয়াইবিরের পদ্ধতিতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইবনে জারীর। সুপরিণত সূত্রে হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম থেকে মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ এবং ইবনে আবী শায়বা বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ‘ইয়া ইলাহী! আমি তোমার নিকট আশ্রয় যাচনা করি অস্বস্তি, আলস্য, অপৌরুষ, অতিবার্ধক্য ও কবরের শাস্তি থেকে। হে আমার আল্লাহ! আমার হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে দাও সংযম ও পবিত্রতা দিয়ে। তুমিই প্রবৃত্তি-পবিত্রতাকারী হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ। তুমিই প্রবৃত্তির সকল কর্মের অধিকর্তা ও অভিভাবক। হে আমার পরম প্রভুপালক! আমি পরিত্রাণ প্রার্থনা করি ওই জ্ঞান থেকে, যা শুভপ্রসূ নয়, ওই হৃদয় থেকে যা বিনয়াবনত নয়, ওই প্রবৃত্তি থেকে যা পরিতৃপ্ত নয় এবং ওই প্রার্থনা থেকে যা গ্রহণযোগ্য নয়।’
বর্ণিত ব্যাখ্যার আলোকে আয়াতখানির মর্মার্থ দাঁড়ায়- ‘আল্লাহপাক তাঁর গুণবত্তার জ্যোতিসম্পাত দ্বারা যে নফসকে পবিত্র করেছেন, সেই নফস হয় আল্লাহ ও তাঁর বিধানে পরিতুষ্ট এবং তাঁর স্মরণ ও আনুগত্যে প্রশান্ত। সে বিরত থাকে আল্লাহ ও তাঁর পথের সকল প্রতিবন্ধকতা, সকল নিষেধাজ্ঞা থেকে। এরকম প্রবৃত্তির অধিকারী যারা, তারাই সফল।’ হাসান বসরী বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করেছে, করেছে পুণ্য ও আনুগত্যমণ্ডিত, সে-ই সফলতার অধিকারী।’ সম্ভবত হাসান বসরী এখানকার ‘যাক্কা’ শব্দসংযুক্ত সর্বনামটি ‘হা’ কে সম্পৃক্ত করেছেন এখানকার ‘মান’ এর সঙ্গে। প্রথমোক্ত ব্যাখ্যার প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, আলোচ্য আয়াতে ওই সকল লোকের অবস্থা বিবৃত হয়েছে, যারা হয়ে গিয়েছে আল্লাহর শুভদৃষ্টির লক্ষ্য। নিজস্ব অভিপ্রায় বলতে তাদের কিছুই নেই। তারা সম্পূর্ণতই আল্লাহর অভিপ্রায়নির্ভর। আর দ্বিতীয় ব্যাখ্যার প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, এখানে ব্যক্ত করা হয়েছে ওই সকল লোকের কথা, যারা সর্বোতোরূপে আল্লাহর অভিপ্রায়প্রত্যাশী। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, তাকে মহিমময় করে দেন। আর যারা তাঁর অভিমুখী হয়, তিনি তাদেরকে পথ দেখান।
পরের আয়াতে বলা হয়েছে- “এবং সে-ই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।” একথার অর্থ-আল্লাহপাক যাকে পথ দেখাবেন না, সে অবশ্যই হবে অসফল। তারা অপরিশুদ্ধ, তাই ধ্বংসের উপযুক্ত। অথবা মর্মার্থ হবে- যারা হয়েছে ভ্রষ্টপথানুগামী, তারা ডেকে এনেছে নিজেদেরই ধ্বংস।
এখানকার ‘দাসসাহা’ তথা ধূলায় ধূসরিত করার তাৎপর্য এই যে, নাফসের রশি একেবারেই কামনা আর ক্রোধের হাতে ছেড়ে দেবে, জ্ঞান আর শরীয়তের সঙ্গে কোন সম্পর্কই রাখবে না। যেন কামনা-বাসনা আর লোভ-লালসার দাসে পরিণত হয়ে পড়ে। এমন ব্যক্তি পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট এবং ঘৃণ্য।