তাফসীরে সূরা আ‘লা [আয়াত-ক্রম : ১-৫]

 

سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى

(১) (হে রাসূল!) আপনি আপনার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন।

الَّذِي خَلَقَ فَسَوَّى

(২) যিনি সৃষ্টি করেছেন আবার সুঠামও করেছেন।

وَالَّذِي قَدَّرَ فَهَدَى

(৩) আর যিনি (প্রাণী মাত্রের জন্যে তার উপযোগী বস্তুসমূহের) ব্যবস্থা করেছেন এবং পথনির্দেশ করেছেন।

وَالَّذِي أَخْرَجَ الْمَرْعَى

(৪) এবং যিনি ঘাষ উৎপন্ন করেছেন,

فَجَعَلَهُ غُثَاءً أَحْوَى

(৫) পরে তাকে কৃষ্ণবর্ণের খড়কুটোয় পরিণত করেছেন।

সূরার নামকরণ ও ফযীলত

الْأَعْلَي (আল-আ‘লা) মহান আল্লাহর একটি সিফাত বা গুণবাচক নাম, যার অর্থ সুউচ্চ। প্রথম আয়াতে উল্লিখিত গুণবাচক নাম থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরাতুল আ‘লা ছাড়াও এ সূরার আরেকটি নাম হলো ‘সূরাতু সাব্বাহা’।

হযরত আলী রাযি. থেকে ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেছেন যে, এই সূরাটি ছিল রাসূল সা.-এর খুবই প্রিয়। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সা. দুই ঈদ ও জুমুআর নামায সূরা আ‘লা ও সূরা গাশিয়া দিয়ে পড়তেন। কখনো কখনো ঈদ ও জুমুআ একই দিনে অনুষ্ঠিত হতো এবং তিনি সে ক্ষেত্রে উভয় নামায এই দুই সূরা দিয়ে পড়তেন।

যেহেতু এই সূরাটি সমগ্র বিশ্বজগতকে ইবাদাতের স্থান হিসাবে চিহ্নিত করে, তার সর্বত্র বিশ্বপ্রভুর তাসবীহ ও গুণগান ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয় এবং তাকে আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণার একটা স্থান হিসাবে তুলে ধরে, তাই রাসূল সা.-এর কাছে এটি প্রিয় হওয়ারই কথা।

তাফসীর

‘سَبِّحِ اسْمَ’ অর্থ তুমি নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো। ‘رَبِّكَ الْأَعْلَى’ অর্থ তোমার সুমহান প্রতিপালকের। এভাবে প্রথমোক্ত আয়াতখানির মর্মার্থ দাঁড়ায়-হে আমার রাসূল! আপনি আপনার প্রতিপালকের ওই সকল নামের মাধ্যমে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন, যে নামগুলো সুনির্ধারিত কেবল তাঁর সুমহান সত্তার জন্য। অনুপযুক্ত, অযথার্থ এবং অপবিত্র (অংশীবাদিতা মিশ্রিত) নামে কখনো তাঁকে ডাকবেন না। আবার তাঁর জন্য নির্ধারিত নামে ডাকবেন না অন্য কাউকে অথবা কোনো কিছুকে। তাঁর নামোচ্চারণ করবেন অতি সম্মান ও গুরুত্বের সঙ্গে।

উকবা ইবনু আমির আল-জুহানী রাযি. বলেন, যখন فسَبِّحِ بِسْم رَبِّكَ العَظِيم অবতীর্ণ হলো তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, اجعلوها في ركوعكم-‘এটা তোমরা রুকুতে (পাঠ করার জন্য) গ্রহণ করে নাও।’ তারপর যখন سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَي অবতীর্ণ হলো তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, اجعلوها في سجودكم-‘এটা তোমরা সিজদায় (পাঠ করার জন্য) গ্রহণ করে নাও।’ (আহমাদ : ৪/১৫৫, আবূ দাঊদ : ৮৬৯)

পরের আয়াতে বলা হয়েছে-‘যিনি সৃষ্টি করেন ও সুঠাম করেন।’ ‘الَّذِي خَلَقَ’ অর্থ : ‘যিনি সৃষ্টি করেন।’ এখানে কর্মর্পদ রয়েছে অনুক্ত। অর্থাৎ তিনি সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন-মৌলিক পদার্থসমূহ, মহাকাশ, মহাপৃথিবী, প্রাণী উদ্ভিদ, জড়-অজড়, আশ্রয়সাপেক্ষ, আশ্রয়নিরপেক্ষ-সব। যেমন : কোনো কোনো সৃষ্টি আবার স্বনির্ভর নয়, একক অথবা যৌথভাবে অন্যের উপরে নির্ভরশীল। যেমন : রঙ, শব্দ, অবস্থা, পরিস্থিতি, পরিমাপ ইত্যাদি। মানুষের কর্ম, অর্থাৎ কর্মজগতের স্রষ্টাও আল্লাহ তাআলাই। ‘فَسَوَّى’ অর্থ : ‘এবং সুঠাম করেন।’ অথবা ‘পরিগঠন করেন স্বীয় অভিপ্রায়ানুসারে।’ কিংবা-তিনি সৃষ্টি করেন সুশৃঙ্খলতা ও সুবিন্যস্ততার চাহিদা অনুসারে। এরকম ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতেই বলা হয়েছে-যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, এর চেয়ে উৎকৃষ্ট সৃষ্টি অসম্ভব।

এর পরের আয়াতে (৩) বলা হয়েছে ‘এবং যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করেন ও পথনির্দেশ করেন।’ এখানে ‘وَالَّذِي قَدَّرَ’ অর্থ : ‘এবং যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করেন।’ কারী কাসায়ী কথাটিকে পাঠ করতেন ‘وَالَّذِي قَدَرَ’-অর্থাৎ তিনি সকল সম্ভাব্য সৃষ্টিতে সমর্থ। তবে প্রসিদ্ধ পাঠ হচ্ছে-‘قَدَّرَ’ তাশদীদযুক্ত ‘দাল’ সহযোগে। ইমাম বাগাবী রহ. লিখেছেন, ‘قَدَّرَ’ ও ‘قَدَرَ’ সমঅর্থসম্পন্ন। অর্থাৎ আল্লাহপাক তাঁর সতত স্বাধীন অভিপ্রায়ানুসারে সকল সৃষ্টির জাতি, শ্রেণি, বৈশিষ্ট্য, নিয়তি, নিয়ন্ত্রণ, আকৃতি-প্রকৃতি-অবস্থা, কর্ম, উপজীবিকা, প্রবৃদ্ধি-স্থিতি-সবকিছু নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহ তাআলা আকাশ-পৃথিবী সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর পূর্বে সৃষ্টি করেছেন সকল সৃষ্টির তকদীর। সে সময় তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে। (মুসলিম)

হযরত ইবনু উমর রাযি. বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা. বলেছেন, সকল কিছুকে করা হয়েছে ভারসাম্যপূর্ণ। এমনকি বোধবুদ্ধি এবং সতর্কতা-অসতর্কতাকেও। ‘فَهَدَى’ অর্থ : ‘এবং পথনির্দেশ করেন।’ অর্থাৎ যে যে পথে যেতে চায়, আল্লাহ পাক তাকে সেই পথেই পরিচালিত করেন। মুজাহিদ রহ. বলেন, ‘فَهَدَى’ অর্থাৎ মানুষকে ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎপথের সন্ধান দিয়েছেন এবং জীব-জন্তুকে চারণ ভূমি ইত্যাদির সন্ধান দিয়েছেন। যেমন : অন্য এক আয়াতে মূসা আ. সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি ফিরআউনের নিকট গিয়ে বলেছিলেন-

رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَى

অর্থাৎ আমাদের প্রতিপালক হলেন তিনি, যিনি বস্তু মাত্রকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, এরপর পথনির্দেশ করেছেন।

হযরত শাহ আবদুল কাদির রহ. লেখেন, ‘প্রথমে আল্লাহ তাআলা তাকদীর তথা ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেছেন এবং তদনুযায়ী দুনিয়ায় আনয়ন করেছেন।’ যেন দুনিয়াতে আগমনের পথ বলে দিয়েছেন তিনি। আর হযরত শাহ আবদুল আযীয রহ. লেখেন, ‘আল্লাহ তাআলা প্রতিটি ব্যক্তির জন্য পূর্ণতার একটা পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অতঃপর তাকে সে পূর্ণতা অর্জনের পথও নির্দেশ করেছেন।’

এরপরের আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে-‘এবং যিনি ঘাষ উৎপন্ন করেছেন (৪), পরে তাকে কৃষ্ণবর্ণের খড়কুটোয় পরিণত করেছেন (৫)।’ ইবনু আব্বাস রাযি. বলেন, غثاء أحـوى অর্থ হলো هشیما متغیرا অর্থাৎ পঁচা খড়কুটো। মুজাহিদ, কাতাদা এবং ইবনু যায়েদ রহ. থেকেও এইরূপ বর্ণিত আছে।

ইবনু জারীর রহ. বলেন, কোনো কোনো আরবী ভাষাপণ্ডিতের ধারণা হলো, এই আয়াতের ইবারত মূলত এইরূপ হবে যে, والذي أخرج المرعى أحـوى فجعله غثاء অর্থাৎ যিনি কালোপনা সবুজ তৃণ উৎপন্ন করেছেন। অতঃপর তা শুষ্ক খড়কুটোয় পরিণত করেন।

ইবনু জারীর রহ. বলেন, তবে এই ব্যাখ্যাটি সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ, তা অন্য সকল মুফাসসিরের ব্যাখ্যার পরিপন্থি। সুতরাং পূর্ণ আয়াতের ব্যাখ্যা দাঁড়ায়-আল্লাহ তাআলা প্রথমে নিতান্ত সবুজ-সুদর্শন ঘাসপাতা মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ধীরে ধীরে তাকে করে দিয়েছেন শুষ্ক এবং কালো, যাতে শুদ্ধ করে দীর্ঘ দিন জন্তুর জন্য সঞ্চয় করে রাখা যায় এবং শুষ্ক ক্ষেত কাটার পরও যেন তা কাজে লাগে।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT