কুরবানী ও আকীকা প্রসঙ্গ
প্রশ্ন : আমাদের মহল্লার মসজিদের ইমাম সাহেব এক জুমুআর বয়ানে বলেছেন, কুরবানী ওয়াজিব হবার জন্য অতিরিক্ত সম্পদ এক বছর যাবত মালিকানায় থাকা জরুরি। কিন্তু এলাকার অন্য আলেমগণ বলছেন, তাঁর বক্তব্য সঠিক নয়। এ ব্যাপারে সঠিক সমাধান জানতে চাই। এবং কোন ধরনের সম্পদ কুরবানীর নেসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে তাও জানালে উপকৃত হবো।
—আব্দুল মতিন, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ
উত্তর : কুরবানীর নেসাব পুরো বছর মালিকানায় থাকা জরুরি নয়। বরং কুরবানীর তিনদিন (১০, ১১, ১২ যিলহজ) কারো কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। আর টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, ব্যাবসায়িক পণ্য, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজন-অতিরিক্ত বাড়ি ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো যদি সাড়ে সাত ভরি সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের হয়, তাহলে কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যাবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯৬; ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া : ১৭/৪০৫; রদ্দুল মুহতার : ৬/৩১২)
প্রশ্ন : সাধারণত দেখা যায় যে, কুরবানীর পশু ক্রয়ের সময় বাজারে গিয়ে মানুষ পশুর দাঁত উঠেছে কি না তা যাচাই করে থাকে। প্রশ্ন হলো, পশুর উপযুক্ততা প্রমাণের ক্ষেত্রে দাঁত ওঠা না-ওঠা ধর্তব্য কি না? নাকি সঠিকভাবে পশুর বয়স যাচাই করা আবশ্যক?
—হুসাইন আহমদ, ছাতক, সুনামগঞ্জ
উত্তর : কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য উট কমপক্ষে ৫ বছর, গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছর এবং ছাগল ১ বছর বয়সের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি এমন মোটাতাজা হয় যে, দেখতে এক বছর বয়সের মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী শুদ্ধ হবে। তাই কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য পশুর উপরোক্ত বয়স ও অবস্থা যাচাই করা আবশ্যক। তবে পশুর দাঁত ওঠা বা না-ওঠা পশুর বয়স যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৬; সহীহ মুসলিম : ২/১৫৫; ফাতাওয়ায়ে কাযীখান : ৩/৩৪৮)
প্রশ্ন : কুরবানীর পূর্বে ভারত থেকে বাংলাদেশে অনেক গরু আমদানি হয়। এ সময় অনেক গরু চোরাই পথেও নিয়ে আসা হয়। এমতাবস্থায় কেউ যদি চোরাই পথে আসা গরু জানা সত্তে¡ও ক্রয় করে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী কি শুদ্ধ হবে?
আব্দুর রহমান, দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ
উত্তর : চোরাই পথে আসা পশু ক্রয় করে কুরবানী করা জায়েয। তবে চোরাকারবারিতে জড়িত হওয়ার কারণে যেহেতু রাষ্ট্রীয় আইন লংঘন হয় এবং এতে জান মাল ও ইজ্জতহানি ঘটার আশঙ্কা থাকে, তাই এ ধরনের পেশায় জড়িত হওয়া অনুচিত। (সূরা বাকারা : ১৯৫, ২৭৫; কিতাবুন নাওয়াযিল : ১৬/১৫৭)
প্রশ্ন : গত বছর আমরা সাতজন মিলে কুরবানী করার জন্য একটি গরু ক্রয় করি। সবাই সমানহারে প্রতি অংশের টাকাও পরিশোধ করেছি। কিন্তু ঘটনাক্রমে পশুটি কুরবানী করার পূর্বে একজন অংশীদার তার অংশ থেকে বের হয়ে যায় এবং আমাদের সাথে কুরবানী করবে না বলে জানায়। তখন আরেকজন অংশীদার খোঁজ করেও না পেয়ে বাকি ছয়জন মিলে আমরা ওই গরুটি কুরবানী করে ফেলি। জানতে চাই, আমাদের কুরবানীটি আদায় হয়েছে কি না?
—শফিকুর রহমান, মৌলভীবাজার রোড, শ্রীমঙ্গল
উত্তর : কোনো অংশীদার বের হয়ে যাওয়া কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার প্রতিবন্ধক নয়। তাই প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনাদের ছয় জনের কুরবানী শুদ্ধ হয়েছে। তবে যে অংশীদার বের হয়ে গেছে তাকে তার অংশের টাকা ফেরত দেওয়া আবশ্যক। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৭; রদ্দুল মুহতার : ৬/৩১৫; কেফায়াতুল মুফতি : ১২/৯৪)
প্রশ্ন : আমরা পাঁচজন মিলে কুরবানী করার জন্য একটি গরু ক্রয় করেছি। আমি চাচ্ছি এই গরুর অবশিষ্ট দুই অংশ দ্বারা আমার ছেলের আকীকা আদায় করব। জানতে চাই, এভাবে একই পশু দ্বারা কুরবানী ও আকীকার নিয়ত করা শুদ্ধ কি না? এবং এ ক্ষেত্রে কুরবানী ও আকীকা উভয়টি আদায় হবে কি না?
—শাহিন মিয়া, গোলাপগঞ্জ, সিলেট
উত্তর : কুরবানীর পশুর এক বা একাধিক অংশে আকীকার নিয়ত করা জায়েয। এবং এতে কুরবানী ও আকীকা উভয়টিই আদায় হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৯; ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩৫১; ফাতাওয়ায়ে শামী : ৯/৪৭২; ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ : ১৫/৬০৯)
পবিত্রতা প্রসঙ্গ
প্রশ্ন : আমি দাঁতের সমস্যার কারণে গত বছর কৃত্রিম দাঁত লাগিয়েছি। এখন ওযু ও গোসলের সময় ওই কৃত্রিম দাঁতের হুকুম কী হবে? ঐ দাঁত খুলে কি সেখানে পানি পৌঁছানো জরুরি?
—আব্দুল্লাহ আল মামুন, ভার্থখলা, সিলেট
উত্তর : কৃত্রিম দাঁত সাধারণত দুই প্রকারের হয়ে থাকে। এক. স্থায়ী, যা খোলা যায় না। তা আসল দাঁতের মতোই, ওযু ও গোসলের সময় তা খোলার প্রয়োজন নেই। দুই. অস্থায়ী, যা চাইলে সহজেই খোলা যায়। ওযুর সময় ওই দাঁত খুলে কুলি করা সুন্নত। তবে ফরয গোসলের সময় তা খুলে সেখানে পানি পৌঁছানো আবশ্যক। নতুবা ফরয গোসল আদায় হবে না। (গুনয়াতুল মুতামাল্লি : ৪৬; রদ্দুল মুহতার : ১/২৮৬; ফাতাওয়ায়ে উসমানী : ১/৩১৪)
প্রশ্ন : ভোট প্রদানের সময় ভোটারের বৃদ্ধাঙুলির নখে এক প্রকার কালি লাগানো হয়। যা সাধারণত খুব সহজে নখ থেকে ওঠে না। প্রশ্ন হলো, এই কালি নখে থাকা অবস্থায় ওযু ও ফরয গোসল আদায় হবে কি না?
—শারাফাত হুসেন, কাজীটুলা, সিলেট
উত্তর : ভোটের সময় আঙুলে যে কালি লাগানো হয়, তা সাধারণত কলমের কালির মতোই হয়ে থাকে। এ কারণে নখের উপর কোনো ধরনের শক্ত আবরণ পড়ে না। তাই এ কালি নখে থাকা অবস্থায় ওযু ও ফরয গোসল শুদ্ধ হবে। তবে যদি এমন কালি ব্যবহার করা হয় যা শক্ত ও কঠিন হওয়ার কারণে নখে পানি পৌঁছতে বাধা প্রদান করে, তাহলে ওই কালি-সহ ওযু ও ফরয গোসল শুদ্ধ হবে না। (ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া : ১/২৭৭; ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/৪; রদ্দুল মুহতার : ১/২১১)
সালাত প্রসঙ্গ
প্রশ্ন : আমি কুরআনের একজন হাফেজ। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখি মহল্লার মসজিদের ইমাম সাহেব ছুটিতে তাঁর বাড়ি গিয়েছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে একজন তোতলা ব্যক্তি নামাযের ইমামতি করছেন। নামাযে তিলাওয়াতের সময় তাঁর তোতলামি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। জানার বিষয় হলো, তোতলা ব্যক্তির ইমামতি শুদ্ধ হবে কি না এবং আমি তাঁর পেছনে ইক্তেদা করতে পারব কি না?
—মারুফ আহমদ, রাজনগর, মৌলভীবাজার
উত্তর : যদি তোতলামির কারণে হরফের শুদ্ধ উচ্চারণ না হয় এবং এ কারণে অর্থেরও পরিবর্তন ঘটে তাহলে তাঁর পেছনে শুদ্ধ তেলাওয়াত করতে সক্ষম ব্যক্তিদের ইক্তেদা শুদ্ধ হবে না। এ ধরনের ব্যক্তি ইক্তেদা করলে কারো নামাযই শুদ্ধ হবে না। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/১৪৩; ফাতাওয়ায়ে শামী : ৩/৩২৭; ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ : ৩/১১১)
প্রশ্ন : কেউ যুহরের ফরয নামাযের পূর্বের চার রাকাত সুন্নাতে মুআক্কাদা আদায়ের সময় যদি ভুলে প্রথম বৈঠকে দরূদ শরীফ পড়ে ফেলে তাহলে কোনো সমস্যা হবে কি না? এবং এ কারণে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে কি না?
—শরীফুল ইসলাম, শমসের নগর, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার
উত্তর : প্রশ্নোক্ত চার রাকাত সুন্নত এক সালামে পড়া আবশ্যক। তাই প্রথম বৈঠকে ভুলে দরূদ শরীফ পড়ে ফেললে সাহু সিজদা আবশ্যক হবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/১৭২; রদ্দুল মুহতার : ১/৬৩৩; আহসানুল ফাতাওয়া : ৩/৪৯০)
বিবিধ প্রসঙ্গ
প্রশ্ন : অনেক ছেলেকে হাতে মেহেদি ব্যবহার করতে দেখা যায়। জানতে চাই, ছেলেদের জন্য মাথার চুল ও দাড়ি ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গে মেহেদি ব্যবহার জায়েয কি না? এবং মেহেদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি না?
—আসমা আক্তার, সোজা মেমোরিয়াল কলেজ
উত্তর : মহিলারা যেকোনো অঙ্গে মেহেদি ব্যবহার করতে পারেন। তবে পুরুষদের জন্য মাথার চুল ও দাড়ি ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গে মেহেদি ব্যবহার করা জায়েয নেই। (ফাতাওয়ায়ে কাযীখান : ৩/৪১২; আদ্দুররুল মুখতার : ৬/২২৬; ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১৯/৪৫৬)
উত্তর প্রদায়ক : ইফতা বিভাগ, বরুণা মাদরাসা