মানবজীবনের আদি-অন্তে ছয়টি মঞ্জিল তথা ছয়টি স্টেশন রয়েছে। মানুষের জীবনের উপর আপতিত সামগ্রিক তিনটি প্রশ্নের উত্তরে ছয়টি মঞ্জিল প্রকাশ পায়।
প্রথম প্রশ্ন : আমরা ছিলাম কোথায়?
দ্বিতীয় প্রশ্ন : আসলাম কোথায়?
তৃতীয় প্রশ্ন : যাব কোথায়?
প্রথম প্রশ্নের জবাব : আমরা ছিলাম রূহ-জগতে, যাকে আলমে আরওয়াহ বা আলমে আমর বলা হয়। এটাই হলো মানব জীবনের প্রথম মঞ্জিল। এই মঞ্জিল হতে পর্যায়ক্রমে আমাদেরকে দ্বিতীয় মঞ্জিলে স্থানান্তরিত করা হয়। এই দ্বিতীয় মঞ্জিল হচ্ছে আলমে আরহাম বা মায়ের উদর। এখানে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে সর্বনিম্ন পূর্ণাঙ্গ ৬ মাস অতিবাহিত হলে পরে আমাদেরকে পরবর্তী মঞ্জিলে স্থানান্তরিত করা হয়। মোটকথা, প্রথম প্রশ্নের জবাবে আমাদের দুইটি মঞ্জিল—আলমে আরওয়াহ ও আলমে আরহামের বিবরণ চলে আসে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল—আমরা কোথায় এসেছি? এর জবাব হচ্ছে, আমরা আলমে আজসাদ তথা দুনিয়ার জগতে এসেছি। যা মানবজীবনের তৃতীয় মঞ্জিল। মানবজীবনে এই তৃতীয় স্টেশনই হচ্ছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আমাদের খালিক, মালিক, রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে স্বাধীনভাবে আমলের সুযোগ দিয়ে ছেয়ে দিয়েছেন। এ জগতে তিনি বান্দার আমলের কোনো হিসাব নেবেন না। এখানে আমলের কোনো চ‚ড়ান্ত ফলাফলও দেবেন না। এ জগতের আমলসমূহের হিসাব নেবেন তিনি পরবর্তী-জগতে। চ‚ড়ান্ত ফলাফলও প্রদান করবেন তিনি পরবর্তীতে। তবে বান্দাগণ যাতে এ জগতে সুখী-সমৃদ্ধ জীবন যাপন করতে পারে এবং পরবর্তী জগতে ভালো ফলাফলের রসদ জোগাতে পারে, সে জন্য এই দুনিয়ার জগতে তিনি সঠিক পথের দিশা দানের লক্ষ্যে অসংখ্য আসমানী কিতাব ও নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁর দেওয়া ঐশীগ্রন্থসমূহ এবং তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলগণের নির্দেশিত পথই হচ্ছে সফলতার রাজপথ। এর বিপরীত পথ ধ্বংস ও ব্যর্থতার। তাই বান্দাগণের কর্তব্য হলো, দুনিয়ার জগতে খোদায়ী বিধান ও আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের প্রদর্শিত পথ অনুসরণে জীবন পরিচালনা করা।
তৃতীয় প্রশ্ন ছিল আমরা কোথায় যাব? এর জবাবে পরবর্তী তিনটি মঞ্জিল আসে। অর্থাৎ আমরা তৃতীয় মঞ্জিল অতিক্রম করার পর পর্যায়ক্রমে আলমে বারযাখ, আলমে কিয়ামত ও আলমে আখিরাতের দিকে প্রত্যাবর্তিত হবো। মানবজীবনের তৃতীয় মঞ্জিল দুনিয়ার জীবনের পরিসমাপ্তিতে মানুষের অনিবার্য যাত্রা হয় চতুর্থ মঞ্জিল আলমে বারযাখ তথা কবর-জগতে। এই চতুর্থ স্টেশনের যাত্রাপথ কারো জন্য খুবই কষ্টকর হবে আবার কারো জন্য অতি সহজ। কবর-জগতের যাত্রাপথে মৃত্যু নামক সাঁকো পাড়ি দেওয়ার অবস্থাই নির্দেশ করবে আলমে বারযাখের তার অবস্থা কী হবে; শান্তিতে থাকবে, নাকি অশান্তিতে। মৃত্যু নামক সাঁকো পাড়ি দিয়ে চতুর্থ মঞ্জিল আলমে বারযাখে পৌঁছুলে সেখানে অবস্থান করতে হবে অনন্তকাল। সর্বশেষে যার মৃত্যু হবে তাকে অন্তত ৪০ বছর কবরে থাকতে হবে। কবর-জগতেও রয়েছে সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরপর্ব। এখানে মুনকার নেকির নামক ফিরিশতা এসে বান্দাকে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করবেন।
প্রথম প্রশ্ন হবে : তোমার রব কে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন : তোমার দ্বীন-ধর্ম কী ছিল?
তৃতীয় প্রশ্ন : মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তোমার মন্তব্য কী?
সংক্ষিপ্ত এই তিন প্রশ্নের জবাব শুধু তারাই সঠিকভাবে দিতে পারবে যারা দুনিয়ার জগতে নিজের জীবন পরিচালনা করেছে মহান রবের হুকুমমতে, মেনে চলেছে আল্লাহ তাআলার একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামের যাবতীয় বিধিবিধান এবং অনুসরণ করেছে নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-প্রদর্শিত তরীকা। পক্ষান্তরে যারা দুনিয়ার যিন্দেগিতে আল্লাহর হুকুমমতে, ইসলামী অনুশাসনের অনুক‚লে এবং নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-প্রদর্শিত তরীকা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেনি তারা এই প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পারবে না। তারা শুধু আফসোস করে করে বলবে, ‘হায়! এ প্রশ্নের জবাব কী, তা তো আমি জানি না।’
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের জবাব যারা সঠিকভাবে প্রদান করবে তাদের জন্য পরম শান্তি ও আরামের ফায়সালা করা হবে। বলা হবে—
نم كنومة العروس
অর্থাৎ বাসর-যাপনের আরাম-সুখে বিভোর হয়ে যাও। সাথে সাথে আরো বলা হবে : ‘তাদের কবরে এক সেট বেহেশতী বিছানা বিছিয়ে দাও। তাদের গায়ে একজোড়া বেহেশতী পোশাক পরিয়ে দাও। তাদের কবরের সাথে বেহেশতের সংযোগ করে দাও।’
মুমিন ব্যক্তি কবরে এমন আরাম ও শান্তিতে ঘুমাবে যে কিয়ামাত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালামের শিঙ্গার ফুৎকার-আওয়াজে তাঁর ঘুম ভাঙবে, এবং সে বলবে, ‘কে আমাকে এত আরামের ঘুম থেকে জাগাল!’
পক্ষান্তরে যারা কবরের তিন প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না তাদের কবরের জগত হবে নিদারুণ ভয় ও কষ্টের। প্রথমত তাদের কবর এত সংকীর্ণ হবে যে, এক দিকের পাঁজরের হাড় অপর দিকের পাঁজরের ভেতরে ঢুকে যাবে। দুনিয়াতে আল্লাহর বিধানের লংঘন ও নাফরমানির ধরন অনুযায়ী আরো অন্যান্য শাস্তি নাফরমান ও গুনাহগারের কবরে কিয়ামাত পর্যন্ত চলতে থাকবে। এদিকে ইঙ্গিত করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
القبر روضة من رياض الجنة او
حفرة من حفر النار
অর্থাৎ, কবর হয়তো জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান হবে, নতুবা জাহান্নামের গর্ত সমূহের একটি গর্ত হবে।
মোটকথা মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল প্রকৃত মুমিন কবর-জগত জান্নাতী আরাম ভোগ করবে আর নাফরমান ও গুনাহগার শাস্তি ভোগ করবে।
হযরত ইসরাফীলের শিঙ্গায় ফুঁৎকারের মধ্য দিয়ে আলমে বারযাখ তথা কবর-জগতের পরিসমাপ্তি ঘটবে। এবার শুরু হবে মানবজীবনের পঞ্চম মঞ্জিল আলমে কিয়ামাতের দিকে যাত্রা। আলমে কিয়ামাতের ভয়াবহ বিভীষিকা যে কত ভয়ঙ্কর হবে একটু অনুভব হয় নবীজির একটি হাদীস হতে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামাত-দিবসে সমস্ত বনী-আদম নগ্ন পা, নগ্ন দেহ ও খতনা-বিহীন অবস্থায় উঠবে।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে আম্মাজান আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল! আমরাও কি এই অবস্থায় উঠব?’ জবাবে রাসূল বললেন, ‘হ্যাঁ সকলেই এ অবস্থায় উঠবে।’ আয়েশা বললেন, ‘ আল্লাহর রাসূল! উলঙ্গ অবস্থা কতই-না লজ্জাজনক হবে!’ তখন নবীজি বললেন, আয়েশা! কিয়ামাতের ভয়াবহতা এতই ভয়ঙ্কর হবে যে, নিজের গায়ে যে জামা নেই তা সে ভাবতেও পারবে না। প্রত্যেকেই নিজের ব্যাপারে এত শঙ্কিত থাকবে যে, কেউ কারো দিকে তাকানোর কথা ভাবতেও পারবে না। বিশেষ বিশেষ নেক বান্দারা শুধু আরশের নিচে স্থান পাবেন আর বাকি সমস্ত মানুষ খোলা আসমানের নিচে অবস্থান করবে। সূর্য একেবারে মাথার কাছে চলে আসবে। ঘামের মধ্যে মানুষ হাবু-ডুবু খাবে। নিজ নিজ আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে অবস্থান করবে। কারো ঘাম টাখনু পর্যন্ত, কারো হাঁটু পর্যন্ত, কারো কোমর পর্যন্ত, কারো নাভি পর্যন্ত, কারো বুক পর্যন্ত, কারো গলা পর্যন্ত, কারো মুখ পর্যন্ত, আবার কেউ কেউ গামের মধ্যে সাঁতার কাটবে!
অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামাতের ভয়াবহতা বুঝাতে গিয়ে বলেন, কিয়ামাতের ভয়াবহ অবস্থা এতই ভীতিকর হবে যে একেবারে আপনজনেরাও কেউ কাউকে চিনবে না। মা আপন সন্তানকে চিনবে না, বাবা নিজের ছেলে-মেয়েকে চিনবে না। ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন কেউ কাউকে চিনবে না।
মোটকথা কিয়ামাতের ভয়াবহ বিভীষিকাময় অবস্থা খুবই ভয়ানক ও ভয়ঙ্কর হবে, যা বর্ণনা করে পরিপূর্ণরূপে বোঝানো সম্ভব না।
মানবজীবনের সর্বশেষ মঞ্জিল বা স্টেশন হচ্ছে আলমে আখিরাত। সেখানে মানবজীবনের পাপ-পুণ্যের চ‚ড়ান্ত ফলাফল দেওয়া হবে। মানবজীবনের সর্বশেষ অবস্থান আলমে আখিরাতে উপনীত হবার পর যে জীবন শুরু হবে তা কখনো শেষ হবে না। হিসাব-নিকাশ শেষ হলে পরে আল্লাহ তাআলা মৃত্যুকে ভেড়ার মতো একটি প্রাণীর আকৃতিতে বেহেশত ও দোযখের মাঝখানে আনবেন এবং বেহেশত ও দোযখের বাসিন্দাদের সামনে তাকে জবাই করে দেবেন। ঘোষণা করবেনÑএরপর থেকে কারো মৃত্যু হবে না। এই ঘোষণা শুনে বেহেশতবাসীরা আরো আনন্দিত হবে আর জাহান্নামীরা আরো চিন্তিত হবে। বেহেশ্তবাসীরা এজন্য আরো আনন্দিত হবে যে তারা পরম শান্তির নিবাস বেহেশত লাভ করেছে, তা আর কখনোই মৃত্যুর দ্বারা হাতছাড়া হবে না। আর জাহান্নামীরা আরো চিন্তিত হবে এই ভেবে যে, তাদের প্রাপ্ত শাস্তি ও কষ্ট কখনো মৃত্যুর দ্বারা অবদমিত হবে না।
মোটকথা আখিরাতের জগতে যারা জান্নাত লাভে সৌভাগ্যবান হবে তাদের জন্য থাকবে সেখানে চাহিদার চেয়েও অধিক আয়েশ-আরামের ভোগ্য সামগ্রী। নয়ন-জোড়ানো ও তৃপ্তিদায়ক এমনসব সামগ্রী সেখানে তাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে যা দুনিয়ার কোনো চোখ দেখেনি, যার বিবরণ কোনো কান শোনেনি, যার কথা কোনো মানব-অন্তরে কখনো উদ্রেকও হয়নি। মোটকথা নেক বান্দাদের জন্য বেহেশতে এমন আয়েশ-আরামের সুব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে যার তুলনা দুনিয়ার কোনো ভোগ্য সামগ্রীর সাথে হতে পারে না। পক্ষান্তরে নাফরমান বান্দাদের জন্য এমন শাস্তি ও কষ্টের আয়োজন করে রাখা হয়েছে যার সাথে দুনিয়ার কোনো কষ্ট ও শাস্তির তুলনা হতে পারে না।
চলবে…