আজসাদ এটি জাসাদুন শব্দের বহুবচন। এর অর্থ হলো দেহ। কোনো বস্তুতে তিনটি জিনিস পাওয়া গেলে তাকে দেহ বলা হয়। এক. দৈর্ঘ্য, দুই. প্রস্থ, তিন. গভীরতা। যেহেতু দুনিয়ার অধিকাংশ বস্তুই দেহবিশিষ্ট, তাই দুনিয়ার জগতকে আলমে আজসাদ বলা হয়। আর দুনিয়া শব্দটি দুনুউন থেকে নির্গত। যার অর্থ নিকটবর্তী। দুনিয়া যেহেতু আখেরাতের নিকটবর্তী তাই দুনিয়াকে দুনিয়া বলে অবহিত করা হয়।
বর্তমান দুনিয়া বৃদ্ধকালে উপনীত হয়ে গেছে। সাইয়্যিদুনা আদম আলাইহিস সালাম থেকে নূহ আলাইহিস সালামের যুগ পর্যন্ত দুনিয়া শৈশব থেকে কৈশোরকালে ছিল। তাই তখন কোনো কওমের উপর আযাব-গজব আসেনি। হযরত নূহ আলাইহিস সালামের যুগ হতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যুগ পর্যন্ত ছিল দুনিয়ার যৌবনকাল। আর এযুগেই শরীয়তের বিধিবিধান পালনের নির্দেশ ছিল। কিন্তু অবাধ্যতার চরম অবস্থা প্রদর্শনে শুরু হয় আযাব-গযবের ধারা। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ পর্যন্ত দুনিয়ার বৃদ্ধকাল। আর এ কাল চলতে থাকবে দুনিয়া ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত। ধ্বংসের নিকটবর্তী দুনিয়া হলো মানবজীবনের তৃতীয় মানযিল আলমে আজসাদের কর্মক্ষেত্র এবং এর ফলাফল উপভোগ করা হবে আলমে আখিরাতে। আলমে আজসাদে মাতৃগর্ভ হতে সর্ব প্রথম পৃথিবীতে আগমনকারী হলো হযরত আদম আলাইহিস সালামের সন্তান কাবিল। দ্বিতীয় সন্তান হলেন হযরত হাবিল। এই দুনিয়ার জগতের প্রথম খুনি হলো কাবিল। সে তার সহোদর ভাই হাবিলকে হত্যা করে জাহান্নামী হয়েছে। এ জগতে কুফরী ও নাফরমানি শুরু হয় কাবিল ও তার উস্তাদ ইবলিসের মাধ্যমে।
আলমে আজসাদে সন্তান শুভাগমনের পর মা–বাবার করণীয়
নবজাতকেরা মূল্যবান রত্ন। দেশ ও জাতির ভবিষ্যত ও আল্লাহপ্রদত্ত বড় নিয়ামত। এই সন্তান আলমে আজসাদে শুভাগমনের পর অভিভাবকের বিশেষভাবে করণীয় কাজ হচ্ছে ছয়টি।
(১) ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দেয়া। কেননা হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হাসান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্মের পর তাঁর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দিয়েছিলেন। এই আযানের দ্বারা সন্তান অনেক রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকে এবং শয়তান পালিয়ে যায়।
(২) উত্তম অর্থবোধক নাম নির্বাচন করা। কেননা নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান নাম আল্লাহপাকের নিকট প্রিয়। এক্ষেত্রে নবী-রাসূলগণের নামের আকারে নাম রাখা যেতে পারে। তবে ফিরিশতাগণের নামের আকারে নাম রাখা মাকরূহ। ভুলবশত কারো খারাপ নাম রাখা হয়ে গেলে তা পরিবর্তন করে পুনরায় উত্তম অর্থবোধক নাম রাখা। কেননা কিয়ামত দিবসে আল্লাহপাক অনেক মানুষকে উত্তম নামের কারণে মাফ করে দেবেন।
(৩) সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে আকীকা করা। ছেলে হলে দুইটি ছাগল, মেয়ে হলে একটি ছাগল জবেহ করে আকীকা সম্পন্ন করা। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সন্তান স্বীয় আকীকা দ্বারা বন্ধনকৃত হয়। অতএব যতক্ষণ পর্যন্ত আকীকা করা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তাতে বরকতসমূহ প্রকাশিত হয় না এবং সে বিভিন্ন বিপদাপদ থেকে নিরাপদ হয় না।
(৪) তাহনীক করা। অর্থাৎ খেজুর অথবা মিষ্টিজাতীয় জিনিস চিবিয়ে বাচ্চার তালুতে অল্প করে দেয়া আর এটা কোনো নেক মানুষের দ্বারা করানো।
(৫) সপ্তম দিনে মাথা মুণ্ডানো। চুলের ওজন পরিমাণ সোনা-রুপা অথবা তৌফিক অনুসারে অন্য জিনিস সাদাকাহ করা।
(৬) খতনা করানো। বালিগ হওয়ার পূর্বে খতনা করানো সুন্নাত। বালেগ হওয়ার পর খতনা করাতে গেলে সতর রক্ষা করা যাবে না অথচ সতর ঢাকা ফরয। খতনা করা এটা সুন্নতে ইবরাহীমীর অন্তর্ভুক্ত। কাবে আহবার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ১৩ জন নবী খতনা করা অবস্থায় এ পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। (১) হযরত আদম আলাইহিস সালাম (২) হযরত শীষ আলাইহিস সালাম (৩) হযরত ইদরীস আলাইহিস সালাম (৪) হযরত নূহ আলাইহিস সালাম (৫) হযরত সাম আলাইহিস সালাম (৬) হযরত লূত আলাইহিস সালাম (৭) হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম (৮) হযরত মূসা আলাইহিস সালাম (৯) হযরত শুআইব আলাইহিস সালাম (১০) হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম (১১) হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম (১২) হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম (১৩) সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান, ‘হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ৮০ বছর বয়সে কাদুস দ্বারা নিজের খতনা নিজেই করেছেন।’
যদি কোনো পুত্রসন্তান পুরুষাঙ্গের সামনের অংশের সুপারি চামড়ামুক্ত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে, তাহলে তার খতনা করার প্রয়োজন নেই। খতনার এই গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত ও শিআরে ইসলামকে বাস্তবায়নে প্রত্যেক মুসলমানকে যত্নবান থাকা চাই।
প্রাসঙ্গিকভাবে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। ছেলেসন্তান জন্ম নিলে খুশি হওয়া আর মেয়েসন্তান জন্ম নিলে নাখোশ হওয়া উচিত নয়। ছেলেসন্তানের জন্মকে শুভ আর মেয়ে সন্তানের জন্মকে অশুভ মনে করাও ঠিক নয়। কেননা এটা বর্বর যুগের অমানবিকতার বহিঃপ্রকাশ। মেয়েসন্তানও আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি নেয়ামত। অতএব মেয়ে সন্তানের মাকে কোনোভাবেই তিরষ্কার করা যাবে না। মেয়েসন্তান জন্ম দেয়ায় মাকে তালাক দিয়ে আল্লাহপাকের অসন্তুষ্টির পথ চেয়ে নেয়া উচিত হবে না।
প্রাসঙ্গিক মাসআলা
অনেকেই এই ধারণা রাখেন যে, সন্তান জন্ম নেয়ার পর ৪০ দিন পর্যন্ত মায়ের জন্য নামায, রোযা ও অন্যান্য আমলসমূহ আদায় করা যাবে না। কিন্তু এটা নিছক ভুল ধারণা। এ বিষয়ের মাসআলা হলো : বাচ্চার জন্মের পর যে রক্ত বের হয়, তাকে নেফাস বলে। আর নেফাসের সর্বনিম্নকোনো সময়সীমা নেই। তাই যখন রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে তখনই নবজাতকের মাকে গোসল করে পাকপবিত্র হয়ে নামায-রোযাসহ অন্যান্য ইবাদাত স্বাভাবিকভাবে পালন করে যেতে হবে। গোসলে সমস্যা হলে তায়াম্মুম করেও আমলসমূহ চালিয়ে যেতে হবে। নেফাসের সর্বোচ্চ সময়সীমা আমাদের হানাফী মাযহাব মতে ৪০ দিন। ৪০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও যদি রক্ত ঝরতে দেখা যায়, তাহলে সেটা হবে রোগজনিত রক্ত। যাকে ইস্তেহাযা বলা হয়। আর ইস্তেহাযা অবস্থায়ও স্বাভাবিকভাবে আমল চালিয়ে যাওয়া আবশ্যক।