ছয় মঞ্জিল প্রসঙ্গ : আলমে আজসাদ বা দুনিয়ার জগত (৯ম পর্ব)

বিয়েশাদির আয়োজনে তাকওয়া অবলম্বন জরুরি

পূর্বেই বলা হয়েছে, বিয়ে হলো দাম্পত্য জীবনের প্রথম ধাপ। একই সঙ্গে তা মুবারক একটি সুন্নত-আমলও। কিন্তু আমলটিকে আজ আমরা তামাশায় পরিণত করেছি। বিয়ের আয়োজন-অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত আড়ম্বরপূর্ণতার মধ্য দিয়ে গুনাহের অসংখ্য দরোজা যেন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বেগানা-নারী পুরুষের অবাধ সম্মিলনের মাধ্যমে বিয়ের অনুষ্ঠানকে পর্দাহীনতার একটি মজমায় পরিণত করা হয়। বর্তমান জমানায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফটো ও ভিডিও ধারণ। যা গুনাহের স্থায়িত্ব দানে অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অথচ দাম্পত্য জীবনের প্রথম এই ধাপটিতে উচিত ছিল পূর্ণাঙ্গ শরীয়ার অনুসরণ করা, যাতে করে নতুন দম্পতির পরবর্তী জীবনটুকুতে বরকত, সুখ ও সমৃদ্ধি আসে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিয়ের অনুষ্ঠান-সহ সকল কাজ-কর্মে গুনাহের কাজ বর্জন করার তওফীক দান করুন। আমীন।

বিয়ের আয়োজনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে অবলম্বন করার বিষয়টি হলো তাকওয়া। খেয়াল করুন, জনাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিবাহের খুতবার মধ্যে যে তিনটি আয়াতে মুতাবাররাকাহ তিলাওয়াত করতেন, সেগুলোতে তাকওয়া অবলম্বনের সবিশেষ নির্দেশনা আছে। এ থেকে বোঝা যায়, বিয়ে-শাদির আয়োজনে আনন্দ-উদযাপনের পাল্লায় পড়ে তাকওয়ার দিকটি ভুলে গেলে চলবে না।

সেই তিনটি আয়াত খেয়াল করুন—

১. সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো যেমনভাবে তাঁকে ভয় করা উচিতআর তোমরা মুসলিম না হয়ে কক্ষণো মৃত্যুবরণ কোরো না।”[1]

২. সূরা নিসার শুরুর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- হে মনুষ্য সমাজ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একটি মাত্র ব্যক্তি হতে পয়দা করেছেন এবং তা হতে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর সেই দুজন হতে বহু নরনারী ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নামে তোমরা পরস্পর পরস্পরের নিকট (অধিকার) চেয়ে থাকো এবং সতর্ক থাকো জ্ঞাতিবন্ধন সম্পর্কে, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন।”[2]

৩. সূরা আহযাবে ইরশাদ হয়েছে- হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সরল সঠিক কথা বলো।”[3]

এই তিনটি আয়াতে যে-কথাটি আল্লাহ তাআলা সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তাঁর বান্দাকে বলেছেন, সেটি হলো তাকওয়া, খোদাভীতি, আল্লাহকে ভয় করা। বান্দার ভেতরে যদি তাকওয়ার এই গুণটি থাকে, সে যদি আল্লাহ তাআলাকে যথাযথভাবে ভয় করতে পারে, তাহলে ইসলামের যাবতীয় বিধিনিষেধ মেনে চলতে তাকে কোনো বেগ পেতে হবে না। ফলে দাম্পত্য জীবনের হকগুলোও সে যথাযথভাবে আদায় করতে পারবে। স্বামী হলে স্ত্রীর জন্য, আর স্ত্রী হলে স্বামীর জন্য নিজের ভেতর অপার্থিব এক মুহাব্বাত ও দায়বদ্ধতা লালন করবে। কুরআনের ভাষায় যেটাকে বলা হয়েছে মাওয়াদ্দাহ ও রাহমাহ, ভালোবাসা ও দয়া। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আর কোনো মনোমালিন্য থাকবে না। থাকবে কেবল ভালোবাসা। এর ফলশ্রুতিতে পরিবারেও আসবে শান্তি। অশান্তির কোনো বালাই থাকবে না সেখানে। কেননা, বান্দা তাকওয়া অবলম্বন করেছে। আর তাকওয়াই সকল অশান্তি-অনাচার আর জুলুমবাজি দূরীকরণের সর্বোত্তম মহৌষধ।

আমরা উল্লিখিত আয়াতত্রয় এবং এর তরজমার দিকে আবারও খেয়াল করি। দেখুন, আয়াতে মুতাবাররাকাহগুলোতে ভয়পোষণের শক্ত তাকিদ রয়েছে। আত্মোন্নয়নের সহজ পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আমরা মানবপ্রক্রিয়ার ছয় মানযিলের যে মানযিলে অবস্থান করছি, তা হলো- আলমে আজসাদ। এখানে সর্বপ্রথম অবলম্বনের বিষয়টিই হলো এই ভয় এবং তাকওয়া। আল্লাহকে ভয় করা ছাড়া আমরা কেউই সফলতা ও শান্তি লাভ করতে পারব না। আমরা সবাই যদি তাকওয়া অবলম্বন করে ফেলতে পারি, তাহলে দাম্পত্য জীবনে যেমন অশান্তি থাকবে না, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রেও এর প্রভাব পড়বে। একটি শান্তিময় সমাজ আমরা গড়ে তুলতে পারব।

তাকওয়া হলো জীবনসাধনায় সিদ্ধি লাভের চাবিকাঠি

জীবনে যদি সফলকাম হতে চান, তাহলে তাকওয়া অবলম্বনের বিকল্প নেই। তাকওয়াই হলো জীবনসাধনায় সিদ্ধি লাভের চাবিকাঠি। এখন এই খোদাভীতিটা নিজের ভেতরে কীভাবে উৎপন্ন করবেন এবং সর্বদা জাগরূক রাখবেন? এর উপায় হলো তিনটি-

১. খোদাভীরু মনীষী যাঁরা, যাঁরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছেন, তাঁদের সান্নিধ্য ও সুহবতে নিজেকে নিয়োজিত রাখা।

২. অতীতের খোদাভীরু ও আল্লাহওয়ালা বুযুর্গদের জীবনী পাঠ করা। তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।

৩. উপরের দুই পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে ইলমে মারিফাত তথা আল্লাহর পরিচয় লাভ করা।

দেখুন সাহাবায়ে কেরামের যিন্দেগী কেমন ছিল। তাঁরা ছিলেন এই উম্মতের প্রথম প্রজন্ম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবিশেষ সান্নিধ্য ও সুহবত লাভে তাঁরা ধন্য হয়েছিলেন। আর আল্লাহর রাসূল তো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুত্তাকী ও খোদাভীরু ব্যক্তিত্ব। তাঁর সুহবত থেকে সাহাবায়ে কেরামও হাসিল করেছিলেন সর্বোচ্চ স্তরের তাকওয়া। হাসিল করেছিলেন ইলমু মারিফাতিল্লাহ। তাকওয়ার এতটাই উচ্চস্তরে তাঁরা পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে ঘোষণা দানের মাধ্যমে তাঁদের ওপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, আল্লাহ তাঁদের ওপর খুশি, তাঁরাও আল্লাহ তাআলার ওপর খুশি।

তাকওয়া অর্জনের ফলে সাহাবায়ে কেরাম সত্যবাদিতায়, উদারতায়, ভদ্রতায়, নম্রতায়, দয়া-দাক্ষিণ্যে, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতায় অনাগত সকল প্রজন্মের আদর্শ আইডলে পরিণত হয়েছিলেন।

তাকওয়ার পরিচয়

তাকওয়ার মূল অর্থ- বিরত থাকা বা বেঁচে থাকা। তাকওয়ার সর্ব নিম্নস্তর হলো, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কোনো জিনিসকে শরিক করা থেকে বেঁচে থাকা। সাধারণভাবে আল্লাহ পাকের নাফরমানি তথা কুফরি থেকে বেঁচে থাকা।

আর উত্তম স্তরের তাকওয়া হলো, অন্তরকে অনর্থক সবধরনের ক্রিয়াকলাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখা, আল্লাহ তাআলার মহব্বত দিয়ে অন্তরকে ভরপুর করা।

তাকওয়ার প্রসিদ্ধ দুটি প্রকার হলো, ১. তাকওয়া বিত তাআত, ২. তাকওয়া বিল মাসিয়াত।

তাকওয়া বিত তাআত হলো, যথাযথ মর্যাদা সহকারে ইখলাস ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার যাবতীয় নির্দেশনাবলি অব্যাহতভাবে পালন করতে থাকা। যেখানে রিয়া বা লোকদেখানোর বিন্দুমাত্র অবকাশও থাকবে না।

আর তাকওয়া বিল মাসিয়াত হলো, সব ধরনের গুনাহের কাজ থেকে একমাত্র আল্লাহ তাআলার ভয়ে বিরত থাকা।

আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে একবার হযরত উবাই ইবনু কাব রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আমীরুল মুমিনীন, আপনি কি কখনো এমন রাস্তা অতিক্রম করেছেন, যা পরিপূর্ণভাবে কাঁটাযুক্ত?’ হযরত উমর বললেন, ‘অনেক অনেক বার এমন হয়েছে।’ উবাই ইবনু কাব বললেন, ‘তাকওয়া এর নামই। দুনিয়াটা হলো পাপের কাঁটায় পরিপূর্ণ। তাই দুনিয়াতে এমনভাবে নিজের জীবনকে পরিচালিত করতে হবে, যাতে করে পাপের কাঁটায় বিদ্ধ হতে না হয়।’

 

[1] সূরা আলে ইমরান : ১০২

[2] সূরা নিসা : ১

[3] সূরা আহযাব : ৭০

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT