দুআ লাভের মাধ্যম তিনটি : ১. মুহাব্বাত রাখা, ২. খিদমাত করা, ৩. সম্মানের প্রতি খেয়াল রাখা।
খিদমাতের বরকতে মর্যাদাবৃদ্ধি
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আপন চাচাতো ভাই ও উম্মুল মুমিনীন হযরত মাইমুনা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র ছোটোবোন লুবাবাতুল কুবরার ছেলে ছিলেন। আট বছর বয়সে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমাতে নিয়োজিত হন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এই ছোট্ট সাহাবীর খিদমাতে মুগ্ধ হন। তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মাওলায়ে পাকের দরবারে দুআ করেন। ফলে আল্লাহপাক তাঁকে ফিকহ ও তাফসীর শাস্ত্রের সর্বোচ্চ জ্ঞান দান করেন এবং তিনি এ উম্মাতের শ্রেষ্ঠ ফকীহ ও মুফাসসিরের উপাধি লাভে ধন্য হন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের সময় তাঁর বয়স মাত্র তের বছর ছিল।
খিদমাতের বরকতে মর্যাদা বৃদ্ধির আরো একটি ঘটনা
হযরত আফরা রাদিয়াল্লাহু আনহা একজন নারী-সাহাবী। মা মুসলমান, বাবা তখনও কাফির ছিলেন। হযরত আফরার দুই ছেলে। একজন মুয়ায অপরজন মুয়াউয়্যিয। একজনের বয়স ৮ বছর আর অপরজনের বয়স ১০ বছর। মমতাময়ী মা আফরা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলের মুহাব্বাতে সন্তান-দুটিকে খিদমাতে নববীতে উৎসর্গ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমাতের বরকতে সন্তান-দুটির অন্তরে জিহাদের প্রবল আকাঙ্ক্ষা ও শাহাদাতের প্রেরণা জাগ্রত হয়। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেন-কখনো জিহাদের সুযোগ আসলে ইসলামের বড় বড় দুশমনকে হত্যা করবেন। হঠাৎ শোনা গেল জিহাদের দামামা। ইসলামের প্রথম জিহাদ। মদীনার অনতিদূরে ঐতিহাসিক বদরপ্রান্তরে সংঘটিত হচ্ছে। মুয়ায ও মুয়াউয়্যিযের দৃঢ় সংকল্প-তাঁরা এ জিহাদে অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু তাঁদের যে জিহাদে অংশগ্রহণের বয়স হয় নাই! কৌশল অবলম্বন করে তাঁরা জিহাদে শরীক হলেন। এবার তাঁদের লক্ষ্য-ইসলামের প্রধান শত্রু আবু জাহল। রণাঙ্গনে দুই শিশু মুজাহিদ! কিন্তু আবু জাহলকে তো তাঁরা কখেনো দেখেননি! শত্রুশিবিরের কোনটা আবু জাহল, তাঁরা চিনবেন কীভাবে? একজন সাহাবীকে জিজ্ঞস করলেন। ওই সাহাবী তাদেরকে দেখিয়ে দিলেন আবু জাহলকে। আবু জাহলকে দেখতে পেয়েই ক্ষুধার্ত সিংহের মতো দুই শিশু-মুজাহিদ ঝাঁপিড়ে পড়লেন আল্লাহর এই দুশমনের ওপর। ধরাশায়ী করে ফেললেন ইসলামের প্রধানতম শত্রুকে। অতঃপর আবু জাহলের মাথা কেটে দরবারে নববীতে হাজির করেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু। পরবর্তীতে হযরত মুয়ায ও মুয়াউয়্যিয-উভয়ই শাহাদাতের মর্যাদা লাভে ধন্য হন। হযরত আফরা রাদিয়াল্লাহু আনহাও দুই শহীদের মায়ের মর্যাদা অর্জনে সৌভাগ্যবান হন।
মা বাবার করণীয়
ছোট্ট বয়সেই সন্তানদের নেক আমল ও নেক সুহবত অর্জনের প্রতি মা বাবার সজাগ দৃষ্টি রাখা একান্ত কর্তব্য। নাবালিগ অবস্থায় সন্তানের নেক আমলের সওয়াব মা-বাবার আমলনামায় যোগ হবে। উদাহরণত, সন্তান যদি নাবালিগ অবস্থায় হজব্রত পালন করে, তাহলে এই হজের সওয়াব মা-বাবা পাবেন। সন্তান বালিগ হওয়ার পর তার উপরে হজ ফরয হলে তাকে পুনরায় হজ আদায় করতে হবে। এ বিষয়ে কারো কারো মধ্যে একটি ভুল ধারণা লক্ষ্য করা যায়। তাঁরা মনে করে থাকেন, মা-বাবা হজ না করে থাকলে নিজে হজ করা যাবে না। অথবা নিজের বিবাহের পূর্বে হজ করা যাবে না। এটি একটি নিছক ভুল ধারণা। বরং প্রত্যেক আকিল-বালিগ নর-নারী যদি হজ আদায় পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তার উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো নিজের হজব্রত পালন করে নেওয়া। চাই সে বিবাহিত হোক কিংবা না হোক, চাই তার মা-বাবা হজ করুন অথবা না করুন।
প্রত্যেক মা-বাবার এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যে, সন্তান যেন অতিরিক্ত ঘুমে, অথবা মোবাইল ব্যবহারে কিংবা অনর্থক কোনো কাজে লিপ্ত হয়ে ইহজীবনের পুঁজিকে নষ্ট না করে ফেলে। তাই অভিভাবকের কর্তব্য হলো, দৈনন্দিন আমলের (কাজের) রুটিন তৈরি করে দেওয়া এবং তা বাস্তবায়নে কড়া নজরদারি রাখা।
সন্তানদের যাবতীয় ভালো কাজে তাদের প্রশংসা করা উচিত, যাতে আমলে ভাটা না পড়ে। পক্ষান্তরে কোনো মন্দ কাজে জড়িত হতে দেখলে তাদেরকে একান্তে এনে সেই খারাপ কাজের অনিষ্টতা ও এর কুফল বুঝিয়ে কৌশলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। বিশেষ করে হিংসা, নিন্দা, গৌরব-গরিমা, লোভ-লালসা, অহংকার, দম্ভ, অধৈর্য, অকৃজ্ঞতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, সুদ, ঘোষ, মদ, জোয়া, বিদআত, কুফর, শিরক, প্রাণীর ছবি তোলা ও অঙ্কন করা, যিনা-ব্যবিচার, হস্তমৈথুন, সমকামিতা, কুদৃষ্টি ইত্যাদির অনিষ্টতা ও ক্ষতি সম্পর্কে সন্তানদেরকে সতর্ক করা। কেননা এগুলো হচ্ছে হারাম ও মহাপাপ। এগুলো সন্তানের ভবিষ্যৎকে অন্তহীন অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে। জীবনকে করে তুলবে দুর্বিষহ এবং আখিরাতকেও করে দেবে বরবাদ।
সন্তানের সামনে মা প্রশংসা করবেন বাবার, আর বাবা প্রশংসা করবেন মায়ের। ফলে মা-বাবার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা বাড়বে।
গুনাহের পরিচিতি ও ক্ষতিসমূহ
হিংসা : কাউকে আল্লাহপাক কোনো নিয়ামাত দিয়েছেন, আল্লাহপ্রদত্ত তার এই নিয়ামাতকে নষ্ট করার চেষ্টা করা অথবা এ নিয়ামাত নষ্ট হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করাকে হিংসা বলে।
এই হিংসা মানুষের নেক-আমলকে ধ্বংস করে দেয়। কেননা, হাদীস শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান, ‘হিংসা মানুষের নেক-আমলকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয় যেরূপ আগুন কাঠকে জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলে।
পরনিন্দা : কারো এমন দোষের কথা তার অগোচরে আলোচনা করা যা তার সামনে আলোচনা করলে সে তাতে অসন্তুষ্ট হয়। এটা একটি জঘন্যতম পাপ। এটিকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো গুনাহের কাজ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
লোভ : প্রত্যেকের জন্য ভাগ্যে যতটুকু বরাদ্দ রয়েছে, এরচেয়েও বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করাকে লোভ বলে। এই লোভ মানুষের জন্য দুনিয়া-আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। এ প্রসঙ্গে এক লোভী ব্যক্তির ঘটনা আল্লামা রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেছেন।
জনৈক লোভী ব্যক্তি হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে আবেদন করল, ‘হে আল্লাহর নবী মূসা! আপনি আল্লাহপাকের নিকট আমার জন্য এই দুআ করুন, আমি যেন পশু-পাখির ভাষা বুঝতে পারি। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তার জন্য দুআ করলেন। আল্লাহপাক দুআ কবুল করলেন। এবার ঐ লোকটি পশু-পাখির ভাষা বুঝতে পারে। এই লোকের একটি পালিত কুকুর ও একটি মোরগ ছিল। একদিন মোরগ ও কুকুরের মধ্যে কথা হচ্ছিল। আর মালিক পাশে থেকে শুনছিল এবং তাদের কথা বুঝতে পারছিল। মোরগ ও কুকুরের আলোচনার বিষয় ছিল এরূপ—
মোরগ : আমি মালিকের পড়ে থাকা খাবারগুলো খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি।
কুকুর : আরে! তুমি তো খেয়েদেয়ে বেশ ভালো আছ। আর আমি সারারাত মালিকের বাড়ি ও সম্পদ পাহারা দিই অথচ আমাকে কিছুই খেতে দেয় না। অন্তত তোমার সাথে খাবারে আমাকে একটু শরীক করো।
মোরগ : ভাই, তোমার জন্য তো স্পেশাল খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যাবেলায় মালিকের গাধা মারা যাবে। তুমি তুষ্ট হয়ে খেতে পারবে। এ কথা শুনে লোভী মালিক সন্ধ্যার পূর্বেই গাধাটা বিক্রি করে দিল। কুকুরের ভাগ্য আজও খাবার জুটল না।
পরের দিন সকালে মোরগ যখন ফেলে দেওয়া খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছিল তখন কুকুর এসে বলল, ‘আজ তুমি আমাকে কিছু খেতে দাও।’ তখন মোরগ বলল, ‘আজ রাতে মালিকের গাভী মারা যাবে। তুমি তো মজা করে গোশত খেতে পারবে অথচ আমি তো গোশত খেতে পারি না।’ লোভী মালিক আজও তাদের আলোচনা শুনল। এবং রাত নামার পূর্বেই গাভীটি বিক্রি করে দিল। তৃতীয় দিন কুকুরটি উপোস অবস্থায় মোরগকে বলল, ‘আমি আজও কিছু খেতে পাইনি।’ মোরগ বলল, ‘আজ মালিকের ঘোড়াটি মরে যাবে। তুমি ইচ্ছেমতো খেতে পারবে।’ এ কথা শুনে লোভী মালিক তৎক্ষণাৎ ঘোড়াটিও বিক্রি করে দিল। এবার কুকুরটি মোরগকে তিরস্কার করে বলতে লাগল-‘তুমি শুধু আমাকে মিথ্যা লোভ দেখালে। বাস্তবে আমার ভাগ্যে শুধু উপোস থাকা ছাড়া কিছুই জুটল না।’ মালিক তাদের এ কথাগুলোও শুনছিল। এবার মোরগ কুকুরকে বলল, ‘চিন্তা করো না, আজ তোমার মালিক মরে যাবে। আর লোকজন একত্রিত হয়ে শিরনির আয়োজন করবে। অনেক প্রকারের খানা পাকানো হবে। শিরনি ও খানা খেয়ে লোকজন হাড্ডি ও উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলে দেবে আর তুমি খুব মজা করে এগুলো খেতে পারবে।’ লোভী মালিক এ কথাগুলো শুনে বিচলিত হয়ে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে আসল এবং ঘটনার পূর্ণ বিবরণ খুলে বলল। হযরত মূসা তাকে বললেন, ‘তুমি গাধা, গাভী ও ঘোড়া বিক্রি করেছ মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু জেনে রেখো, তাকদীরের বিষয়ে কারো হাত নেই।’ এ কথা বলার সাথে সাথে ঐ লোভী ব্যক্তিটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।
সুপ্রিয় পাঠক! এটাই হচ্ছে ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’-এর বাস্তব উদাহরণ। আল্লাহ তাআলা ঐ সমস্ত পাপকাজ থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।